somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রচিত হলো স্বপ্ন-আকাশ

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছুটা অনিশ্চয়তা আর দ্বিধা থাকলেও শুরুটা হলো বন্ধুত্বের পূর্ণ উদ্যম দিয়ে। চঞ্চল উশ্রিংখল উনিশের তাড়নায় ছোট ছোট কিছু অনুভূতি, কিছু অভীপ্সা কি করে যে এতটা উদ্দীপিত মনন হয়ে ধরা দিলো বুঝতেই পারিনা। পলিটিকাল শোডাউন, মিছিল, ডিপার্টমেন্টাল ইজম ছেড়ে তারুণ্য ধারণ করবে বিতর্ক নামক সৃষ্টিশীল এক শিল্পকে। অনেকটাই চ্যালেঞ্জ। মফস্বলে তো বিতর্ক বলতে কেবল উপস্থিত বক্তৃতাকেই বুঝতাম। তার উপর বড় কোন জাতীয় অনুষ্ঠানে আয়োজক হিসেবে কাজ করার আগ্রহ থাকলেও বিন্দু মাত্র অভিজ্ঞতা নেই। বন্ধু হীমের আহ্বানে বন্ধুরা মিলে নিজ বিভাগে একটা বিতর্ক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছি । তবে শ্রাবণ আর বাবু ছাড়া বিতর্ক করার অভিজ্ঞতা বিশেষ কারো নেই। তবে আমাদেরই কেউ ভালো আবৃত্তি জানতাম,কেউ গান, কেউ ভালো উপস্থাপনা, কেউ ভালো সংগঠক, কেউ ভালো পোট্রেইট আঁকতে পারি। অর্থাৎ চেষ্টাটা ছিল যে প্রত্যেকের সৃষ্টিশীল আঁচড়ে বড় কিছু করা। যাত্রা শুরু হল একটি স্বপ্নের ম্যাথম্যাটিকস ডিপার্টমেন্ট ডিবেটিং সোসাইটি (MDDS)। আজকের এই লেখাটিতে MDDS বাহুল্য হলেও জেইউডিও তে আগমন ও এর প্রসারণে MDDS কে অস্বীকার করাটা কঠিন।
২০০৬ এর মাঝামাঝিতে হীম নিয়ে গেলো টিএসসিতে আনন্দনের রুমে। আমরা গণিত বিভাগেরই প্রায় ২৩ জন। উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন একটি বিতর্ক সংগঠন হয়েছে যারা সামনে একটি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন করবে। সৃষ্টিশীল কিছু ছেলে লাগবে। এতোবড় একটি আয়োজন যেখানে নাকি প্রায় ৩০টির উপরে বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করবে! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিতর্ক সংগঠনের নাম এর আগে শুনিনি। বিতর্ক বরাবরই খুব স্মার্ট একটা শিল্প। টেলিভিশনে ছাত্রছাত্রীদের বিতর্ক করতে দেখতাম, কি চমৎকারভাবে এরা নিজেদের বক্তব্যকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপন করে। তখন ভাবিনি যে নিজে কখনো এভাবে টেলিভিশনে বিতর্ক করবো, শ্রেষ্ঠ বক্তা হবো। তবে ইচ্ছাটা প্রবল ছিল। আনন্দনের কক্ষে প্রবেশ করে কালো মতো একজন ভাইয়াকে দেখলাম। চেহারায় তেমন বিশেষত্ব না থাকলেও কণ্ঠে আবেদন প্রবল , আর চাহনিতে একটা দৃঢ়তা রয়েছে। মামুন ভাই। কাছে ডাকল। বিমোহনী কিছু কথায় মুগ্ধ হলাম। শেষ কথাটি ছিল “we can do it and just do it” … হয়তো তিনি সাধারণ মানুষের মতই গুণে- ত্রুটিতে একরকম ছিলেন তবে ওনার চমৎকার স্পৃহা জাগানিয়া কথা আমাদের কাছে তাঁকে দেবত্বের আসনে আসীন করলো। মামুন ভাইকে তেমন চিনতাম না। এর আগে ওই একই বছরের (২০০৬) এর ফেব্রুয়ারিতে মুক্তমঞ্চে ওনার একটা রম্য বিতর্ক দেখেছিলাম । একজন মানুষ কিভাবে এতো চমৎকার করে কথা বলতে পারে কিভাবে যুক্তির নান্দনিক ছোঁয়ায় দর্শক শ্রোতাদের হৃদয় কেড়ে নিতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমান মামুন ভাই।

শুরু হল কেন্দ্রীয় বিতর্ক সংগঠনের সহযাত্রী হয়ে পথচলা। বছরের শেষে অনেক বড় একটি অনুষ্ঠান আয়জিত হল। সহযোগিতায় বাংলাদেশের তৎকালীন একটি জাতীয় বিতর্ক সংগঠন “ন্যাশনাল ডিবেট ফেডারেশন” । অনেক গুণীজনের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হল। পরিচিত হলাম স্বনামধন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি, JnUDS, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়,চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরও কিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বিতার্কিকদের সঙ্গে।
আগ্রহটা বেড়ে গেলো। কিন্তু ভয়! স্কুল- কলেজে তো উপস্থিত বক্তৃতা ছাড়া বিতর্কের আর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। একবার ক্লাস সিক্সে মৌসুমি শিশু বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিতর্ক করেছিলাম তবে সেই অভিজ্ঞতা (!) বলার মতো না। জেইউডিও এর সদস্য ফর্মে সদস্যতার ৩ টি অপশন ছিল ১। বিতার্কিক ২। আয়োজক ৩। উভয়... দ্বিধা ছিল বিতার্কিক হিসেবে সদস্যতা নিলে এগিয়ে যেতে পারবো কিনা। বন্ধু হীমের অসীম স্পৃহা পেলাম। মামুন ভাই আর আদনান ভাই ও আমার কণ্ঠ আর উচ্চারণের প্রশংসা করলেন। সাহস দিলেন শুরু করতে। শুরু হলো বিতর্কের সঙ্গে বিতার্কিক হিসেবে যাত্রা। অনুশীলন সেশনে প্র্যাকটিস করে যাচ্ছি। আন্তঃব্যাচ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলাম। তথ্য আছে, যুক্তি আছে, কথা বলার ক্ষমতাও আছে। জাস্ট আত্মবিশ্বাসটি নেই যে ৫/৭ মিনিট ডায়াসে দাড়িয়ে নিরবিচ্ছিন্ন শুদ্ধ বক্তব্য দিতে পারবো কিনা।
বই খাতা নিয়ে ছুটে গেলাম এম এইচ হলের এ ব্লকের ৩২০ নম্বর রুমে, ছোট খাটো ফর্সা গড়নের একজন মানুষ থাকে ওই রুমে। চূড়ান্ত অহংকারী মনে হয়। কমন রুমে উনার টিটি খেলা দেখলে মুখের এক্সপ্রেশন দেখলে এমন ভাব যে উনি টেবিল টেনিসের শচীন টেন্ডুলকার। তবে ফ্রেন্ড সার্কেলে বেশ চঞ্চল দেখতাম তাঁকে। কে জানতো, বিতর্কের সরাসরি গুরু হিসেবে সেই মানুষটিই একসময় আমার বিতর্ক জীবনের বর্ণীল অধ্যায়ে এক অনবদ্য চরিত্র হয়ে থাকবেন। মানুষটি মুকসিমুল আহসান অপু।, বর্তমানে এনটিভির এক স্বনামধন্য সাংবাদিক।

বিতর্ক করার আগ্রহ আছে তবে ক্লাবটিও নতুন তেমন অভিজ্ঞতাও নেই। অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে চললাম বিতর্ক শেখার অভিপ্রায়ে। সেই সাথে তারুণ্যের সবুজ আবাহনে চেতনার শুদ্ধতায় এগিয়ে চলল জেইউডিও। সৃষ্টিশীল বোধের বিকাশে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার দম্ভে এগিয়ে চললাম আমরা বিতর্ক নামক এই আধুনিক বাচ্যিক , যৌক্তিক , নান্দনিক ও মননশীল শিল্পটিকে আন্দোলনে রূপ দেয়ার অনিমেষ স্পৃহায়।

বিতর্ক জানতে হলে জানতে হয় বাজার অর্থনীতি কি? সাম্যবাদ কি? গনতন্ত্র কি? নারীবাদ কি? বানিজ্যিক ঘাটতি কি? এসব অনেক কি এর ভিড়ে নিজেকে সত্যি সত্যিই জ্ঞান সাগরের তীরে বসে বালু নাড়াচাড়া করা জ্ঞানশূন্যই মনে হল তবে সেটা জ্ঞানের অপ্রতুলতার, নিউটনের কথা মতো বদান্যতার নয়। শোয়েব ভাইয়ের কথা অস্বীকার করবো না। এমডিডিএস এর সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে একবার উনি পিঠে হাত রেখে মুচকি হেসে ভারী গলায় বলেছিলেন “যাত্রা শুভ হোক”... পরবর্তীতে আমরা যাত্রাসঙ্গী না থাকলেও ওনার মতো এতো বড় একজন মানুষের আশীর্বাদ আমাকে বিতার্কিক হওয়ার পথে অনেক বেশী আলোড়িত করেছে। আর যেই সব “কি” নিয়ে দ্বিধা ছিল তার সবগুলি হাতে কলমে দীক্ষা পাই মুকসিমুল আহসান অপু ভাইয়ের কাছ থেকে। পত্রিকা, কারেন্ট অ্যাফেয়ারস, সাধারণ জ্ঞানের বই প্রভৃতি (তখন ইন্টারনেট ততটা সহজপ্রাপ্য ছিল না ) নিয়ে ছুটে যেতাম অপু ভাইয়ের কাছে। বিতর্কের প্রায় সব কিছুরই প্রাথমিক ধারনা আমি ওনার কাছ থেকে শিখি। এমনকি বাইরে কোনো বিতর্ক প্রতিযোগিতা থাকলে আগের দিন ওনার রুমে গিয়ে বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারনাও নিয়ে আসতাম। পরবর্তীতে হয়তো অনেক অর্জন এসেছে, সেই প্রাপ্তি গুলোর চেয়েও অপু ভাইয়ের দীক্ষা প্রাপ্তিটা আমার কাছে অনেক বেশী কিছু ছিল।
চির শ্রদ্ধাবনত থাকবো সেই সাত জন স্বপ্নদ্রষ্টা কে যাদের মাধ্যমে স্বপ্ন আকাশের নীল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক ইতিহাসে। মামুন ভাই, রাজন দা, অপু ভাই, আদনান ভাই, মুস্তাফিজ ভাই, শায়ের ভাই ও বন্ধু সৈকত। এই সাতজনের নিঃস্বার্থ নিরলস প্রচেষ্টায় গঠিত এই সংগঠনটি বাংলাদেশের বিতর্ক অঙ্গনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সগৌরব অবস্থানের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখেছি ২০০৯ এ যখন ছাত্ররাজনীতির ভয়াবহ অস্থিতিশীলতায় প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই চরম নৈরাজ্য তখন জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশনের অকুতভয় বিতর্ক সৈনিকেরা আয়োজন করে জাতীয় বিতর্ক উৎসব। নেতিবাচক অনেক খবরের ভিড়েও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইতিবাচক পদক্ষেপ প্রশংসিত হয় দারুণভাবে।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য না হলেও যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম স্বপ্ন আকাশের নীলকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে ভুবনময় তাদের কীর্তি অনস্বীকার্য। স্নিগ্ধা আপু, মৌসুমি আপু, বন্ধু তিতাস, সাইফ ভাই, সুজন ভাই, ইরতেজা, বন্ধু হীম, মেহেদী, শ্রাবণ, বাবু, সামির, ইকবাল, স্বর্ণা, শর্মী, লোপা, স্মৃতি আপু এদের অকুণ্ঠ শ্রম ও মনন সদ্য ভূমিষ্ঠ এই সংগঠনকে উজ্জীবিত করেছে এগিয়ে চলার দুর্বার স্পর্ধায় ।
তারুণ্য প্রসূত অনেক খুনসুটির সাক্ষী হয়ে আছে তিতাস ও মেহেদী। একই সাথে কাজ করতে গিয়ে ভুলবোঝাবুঝি , অভিমান, অনুযোগ ছাড়াও অদৃশ্য একবন্ধনে যেন অটুট ছিল সবার প্রাণ। ২০০৬ এর সেই অসাধারণ বর্ণাঢ্য কিংবদন্তী আয়োজনে বন্ধু হীমকে আবিস্কার করেছিলাম দুরন্ত সাংগঠনিক এক ব্যক্তিত্ব রূপে যা আমাদের সবার কাছেই অনুসরনিয় ছিল। ইরতেজার চমৎকার বিতর্ক, মামুন ভাইয়ের দৃপ্ত বক্তব্য, আদনান ভাইয়ের বারোয়ারি অসাধারণত্ব আমাদের বিতর্ক সত্তাকে জাগিয়ে তুলেছিল অদম্য ভাবে।
২০০৭। সভাপতি মুস্তাফিজ ভাই, সাধারণ সম্পাদক অপু ভাই। কর্মদীপ্ত কিছু ছেলে আছে সংগঠনে। তবে অর্থের পবল অভাব। একটা সফল আয়োজন করতে হলে কিছু অর্থ সহযোগিতারও প্রয়োজন। নতুন এই সংগঠনের জন্য কে এগিয়ে আসবে দ্বিধা ছিল। অপার স্নেহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছি ডঃ এটিএম আতিকুর রহমান স্যারের। যিনি প্রতিষ্ঠাকালিন সময় থেকে আজ পর্যন্ত জেইউডিও এর গর্বিত মডারেটর। নিজেদের চাঁদা দিয়েই ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ আয়জিত হল ভাষাদিবস উন্মুক্ত বিতর্ক প্রতিযোগিতা। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিতার্কিক অংশগ্রহণ করলো এই আয়োজনে। সেই সঙ্গে ছিল একটি অসাধারণ প্রদর্শনী বিতর্ক।
আয়োজনটি ছোট হলেও আমার কাছে এটা স্মৃতির অধ্যায়ে এক বর্ণীল ক্ষণ। বারোয়ারি বিতর্ক হবে। বিষয় ‘একুশ মানেই...’ । কি নিয়ে বিতর্ক করবো স্থির করলাম। কিন্তু শুরুটা কিভাবে করবো বুঝতে পারছিলাম না। মামুন ভাইয়ের কাছে গেলাম। ভাইয়া বলল আমি যেন প্রকৃত বিষয়টি প্রকাশ করার জন্য বিতর্ক করি এবং তা যেন কখনোই পুরস্কার অর্জনের জন্য না হয়। আমি স্থির করেছিলাম বলবো চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রহসনের দংশনে একুশ এখন স্রেফ ভ্রষ্টামী। শুরুটাও করলাম এভাবে যে আমি এই আয়োজনে পুরস্কার অর্জনের জন্য আসিনি। প্রকৃত কিছু বোধকে প্রকাশ করতে এসেছি। বিতর্ক করলাম। ৫ জন বিচারক ছিলেন। সবার কাছেই চ্যাম্পিয়ন হলাম। তবে আতিক স্যার আমাকে কোনো মার্ক প্রদান করলেন না। উনি বললেন যে যেহেতু আমি বলেছি যে আমি পুরস্কার অর্জনের জন্য আসিনি তাই আমাকে মার্ক প্রদান করাটা ঠিক হবে না। তবে বিতর্ক শেষে জাজমেন্ট থেকে বেরিয়ে উনিও আমার বিতর্কের অনেক প্রশংসা করেছেন। ফলাফল এমন হল যে, প্রায় সব জাজের কাছেই বেশী মার্ক পেয়েও যেই ৫ জন কে পুরস্কৃত করা হল আমি তাদের মধ্যে নেই। খুব মন খারাপ হয়েছিল। মামুন ভাইয়ের কাছে অসন্তোষও প্রকাশ করেছিলাম। ভাইয়া আমার এই উদ্ধত আচরণে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আমাকে অনেক বোঝালেন যে হয়তো এই ঘটনাটিই আমার বিতর্ক স্বত্বাকে অপ্রতিরোধ্য ভাবে জাগিয়ে তুলবে । আজ স্বীকার করবো ঐদিনের ওই পুরস্কার আমার না মিললেও বিতর্কের যেই তীব্র আগ্রহ আমার মধ্যে গ্রথিত হয়েছিল সেটা ওই ঘটনারই অবদান। আজ ওইদিনটিকে যেভাবে স্মরণ করতে পারছি , যেই অসামান্য আগ্রহে এগিয়ে যেতে পেরেছি সেদিনের সেই পুরস্কার হয়তো সেটি পারতো না। হয়তো অর্জনের থলেতে একটা বেশী ক্রেস্ট জমা পড়তো তবে বিতর্ক চেতনায় ততটা সমৃদ্ধি ভিড় করতো না। চির কৃতজ্ঞ মামুন ভাই ও আতিক স্যারের কাছে।
লেখাটি আত্মজীবনী না হলেও নিজেরই বেশী উদাহরণ আসছে বলে অনেকের মনে লেখাটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আসলে একজন বিতার্কিক হিসেবে আমার জন্ম ও বিকাশ এবং সংগঠন হিসেবে জেইউডিও এর প্রতিষ্ঠা ও পথচলা একই সুত্রে গাঁথা । আমার মতো হয়তো অনেক সাধারণ ছেলে মেয়ে যারা ১০ জনের সামনে দাড়িয়ে ৫ মিনিট কথা বলতে গেলে হাতপা শক্ত হয়ে যেত, শরীরে কাঁপুনি উঠে যেত , তারা আজ সুনিপুণ উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে, সমগ্র বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত বিতার্কিক হিসেবে নিজেদের পরিচিত করেছে, অসাম্প্রদায়িক প্রশস্ত মানসিকতা ধারণ করেছে হৃদয়ে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছে বিপ্লবী সত্ত্বায়। এই সব চেতনার বিকাশে শিক্ষার অনন্য আলয় হিসেবে কাজ করেছে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশন।

বিতার্কিক সৃষ্টির কারিগর জেইউডিও। তাই হয়তো অনেক সংগঠন স্কুল কলেজে বিতর্ক করে আসা বিতার্কিকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তাদের ছেঁকে তুলে নিয়ে তাদের দিয়ে বিতর্ক করিয়ে অনেক ট্রফি অর্জন করে এবং দম্ভিত ভঙ্গিমায় পদচারন করে বিতর্কের ভুবনে, তাদের মতো ট্রফি সর্বস্বতা আমাদের নেই। ১০০টি ট্রফি অর্জনের চেয়েও একজন সাধারণ ছেলেকে বা মেয়েকে একজন প্রতিষ্ঠিত বিতার্কিক কিসেবে গড়ে তোলাটাই জেইউডিও এর কাছে বেশী গৌরবের। কারণ জেইউডিও বিশ্বাস করে ট্রফি হয়তো শেলফে সাজিয়ে রাখা যায়, তবে একজন মানুষের মধ্যে বিতর্কের চেতনা শেলফে নয় হৃদয়ে গ্রথিত রাখা যায় অবিনশ্বর রূপে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেমন একটি স্বকীয় আইডেন্টিটি, জেইউডিও ও যাত্রা শুরু করেছে একটি আলাদা আইডেন্টিটি হিসেবে। কোনো ধরণের জাতীয় বিতর্ক সংগঠনের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেইউডিও নয়। যদিও এরকম কিছু চাপ এসেছিল তবে তা জেইউডিও এর স্বকীয় স্বত্বাকে গ্রাস করতে পারেনি। আমরা কখনো কোনো বিশেষ জাতীয় বিতর্ক সংগঠনের অধস্তন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করিনি, করিনা, ভবিষ্যতেও করবো না। হয়তো এর জন্য আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকুলতা, বৈরিতা তথা বিরাগভাজনতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অনেক জায়গায় ভালো বিতর্ক করার পরেও ট্রফি অর্জন হয়নি। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কোন বড় অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রকল্প সহায়তা, অর্থ সহায়তা যেমন পেয়েছে আমরা তেমনটি পাইনি।

২০০৯। সভাপতি বন্ধু সাইয়েদ মোঃ তাফহীম, সাধারণ সম্পাদক বন্ধু মাসুম রেজা মেহেদী । সহসভাপতি হিসেবে আমি আর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সিউল, তানজিল দায়িত্ব গ্রহণ করি। আমাদের পঞ্চপাণ্ডবের অভিবাবক হিসেবে ক্যাম্পাসে ছিলেন ভীষ্মসম অপু ভাই। পাশাপাশি সহযোদ্ধা হিসেবে সুজন ভাই, ইরতেজা , সামির, ফিরোজ, রাজীব। জেইউডিও এর প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের পরে উপরিউক্ত মানুষদের অগ্রগণ্য ভুমিকায় জেইউডিও সমগ্র বাংলাদেশের বিতর্ক অঙ্গনে বিস্তৃত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বপ্ন- আকাশের নীল বিস্তৃত হয়েছে সর্বত্র। বিতর্ক শেকার জন্য জেইউডিও এর নিজস্ব কোন রুম ও ছিল না টিএসসি তে। তবে ছিল অদম্য ইচ্ছা। তাই প্রতি সপ্তাহের সোম, মঙ্গল ও বুধবার বিকেল ৪টা থেকে প্রাত ৭.৩০ পর্যন্ত বিতর্কের নিরবিচ্ছিন্ন অনুশীলনই ছিল আমাদের ভবিষ্যৎ অর্জনের সঞ্জীবনী শক্তির আধার। মামুন ভাই, মুস্তাফিজ ভাই, অপু ভাইদের সৃষ্টি জেইউডিও কে তারুণ্যের আলোয় উদ্ভাসিত করে দুর্বার গতিময় করে হীম, কৌশিক, মেহেদী, সিউল, ইরতেজা, সুজনরা। আর সেই গতিময়তাকে অহংকারে রূপ দেয় জেইউডিও এর সব চেয়ে মেধাবী প্রজন্ম সৈকত, জাফর, রেহনুমা, ফিবা, নূর, পলাশরা। তাদের মেধাবী কৃতিত্ব জেইউডিওকে সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শক্তিশালী একটি সংগঠন হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছে।

এই প্রজন্মের উল্লিখিত বিতার্কিকদের কারোরই স্কুল কলেজে বিতর্ক করার অভিজ্ঞতা ছিল না। অথচ স্পর্ধা নিয়ে বলতে পারি, বিতর্কের মান, অর্জন ও শৈল্পিকতা ও ব্যকরনে এরা প্রত্যেকেই সমগ্র বাংলাদেশের তৎকালীন সময়ের প্রথম সারির বিতার্কিক।

২০১০। সভাপতি মেহেদী ও সাধারণ সম্পাদক আমি। ধ্যান জ্ঞান তখন বিতর্ক। আমাদের ধর্ম তখন বিতর্ক। আমাদের উদ্দেশ্য তখন বিতর্ক। স্বপ্ন দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুল কলেজেরও সংসদীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন করবো। ইচ্ছে ছিল একটি সার্ক ট্যুর আয়োজন করবো। স্বপ্ন ছিল চলমান অগ্রগন্যতাকে সূর্যসোপানে নিয়ে যাবো সমৃদ্ধির পথ ধরে। জেইউডিও বিভিন্ন হল ও বিভাগীয় সংগঠনের তত্ত্বাবধায়ন করবে, প্রায় প্রতিটি বিভাগ ও হলে জেইউডিও এর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় যাত্রা শুরু করবে অভ্যন্তরীণ বিতর্ক ক্লাব গুলো। জেইউডিও এর সহযোগী সংগঠন হিসেবে অনেক ক্লাব যাত্রা শুরু করে ২০১০ এ। অনেক ক্লাব জেইউডিও এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আয়োজন করে আন্তঃব্যাচ, আন্তঃ ক্লাব, অন্তক্লাব বিতর্ক প্রতিযোগিতা। স্কুল কলেজের সংসদীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও সার্ক ট্যুরের স্বপ্ন আমরা দেখলেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি ওই বছর। তাই পরবর্তী বছর তানিয়া- পলাশ কমিটি না বাস্তবায়ন করে জাহাঙ্গীরনগরে বিতর্কের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। আমাদের দৃপ্ত অঙ্গীকার গুলোকে বাস্তব ও জীবন্ত করে আমাদের উত্তরসূরিরা।
সেই স্বপ্ন আকাশের পরিধি এখন বাস্তবের আকাশকেও ছাপিয়ে। আমরা অতীত হয়েছি। আমাদের বিতর্ক জীবনে এখন স্মৃতির পর্দা। অথচ একই সাথে যাত্রা শুরু করা জেইউডিও ছুটে চলেছে অনন্তকাল আপন মহিমার উদ্দীপ্ত অহংকারে, মননের সৃজনী নিনাদে। আমাদের রেখে যাওয়া জেইউডিও কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরম্পরায় মেধার স্পর্ধিত তাড়নায় আলোর মশাল ধরেছে শুভ, তাইয়েব, মৌসুমি, হিমু, শুভ্র, দিপু, সাব্বিররা। ক্রেস্টের অর্জনের পাশাপাশি এখনো সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন বিতার্কিক, বিতর্ক আন্দোলনের নির্ভীক সৈনিক হয়ে তারা শ্লোগান তুলে যায় যুক্তির ও সত্যের।


আর তারুণ্যের শুদ্ধ উপলব্ধিতে জেইউডিও প্রতিটি বিতার্কিকের চেতনায় রচনা করে এক একটি সুবিশাল স্বপ্ন –আকাশ ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×