সাধারন ভাবে বুঝি - ধর্ম হলো জীবন চলার পথ, যার বাইরে যাবার অর্থ হলো বিশ্বাসের জলাঞ্জলী। যা বুঝি না তা হলো, কেন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভয় দেখিয়ে এই চলার পথকে আমাদের সামনে মরুভুমির মতো করে তোলেন? সাধারন ভাবে আরো বুঝি " বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর" তাই যা বিশ্বাস করি সেটাকে আকড়ে ধরে রাখার জন্য প্রানপনে চেষ্টা করি, কিন্তু প্রায়শই দেখি "সংশয়ে সঙ্কল্প সদা টলে"। এর সাথে অবশ্য পাছে লোকে কিছু বলার কোন সম্পর্ক নেই। সোজা কথায় কি তাহলে দাড়াচ্ছে না যে, ধর্মীয় বোধের নিজস্ব ভিত্তিটা বোধহয় ততটা শক্ত নয় আমার। আসলেই কি তাই, দেখা যাক, আমার কি বলার আছে।
অনেক দিন পর কিছু লেখার চেষ্টা করছি। এজন্য সুদুর অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী আমার এক ভাইকে স্মরন করেই আজকে লিখতে বসলাম। ভেবেছিলাম মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক মানসিক দ্বন্দ্ব বা টানাপোড়েন নিয়ে কিছু লিখবো। কারন এটা আমার নিজস্ব মনোজগতের অনেকখানি সবসময় ছেয়ে থাকে। পরে এই ভাবনা বাদ দিয়ে নিজের ভাবনা গুলো নিয়ে লেখায় মনস্থির করলাম। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কোনভাবেই তর্কের উদ্রেক না করে কিছু কথা বলে যেতে চাই। শুরুতে যে কথাগুলো বললাম, ধর্ম বিষয়টা বোধ করি এগুলোর সাথে অঙ্গাঅঙ্গি বা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
বিশ্বাস, জীবন চলার পথ, এবং খাটি মানুষ বা মন্যুষত্ব - এই তিনটি বিষয় যে কোন ধর্মের মুল মন্ত্র বলে আমি বিশ্বাস করি। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এই তিনটি ই যদি ধর্মরিতী র সব, বা অনুশাসনের সব হয়ে থাকে তাহলে প্রথা গুলো কেন "আবশ্যিক, পালনীয় ও ঐচ্ছিক" এই তিনভাগে বিভক্ত হয়ে নিয়মে পরিনত হওয়ার কি ই বা দরকার ছিলো? এর উত্তর খুজতে গেলে বোধহয় সময় তথা অভিজ্ঞতার এর সাথে একটা সম্পর্ক খুজে পাই। পড়াশোনার একটা স্তর পর্যন্ত মনে করতাম, এটা ওটা পড়ে কি লাভ হচ্ছে? কেবল মাত্র ঐ স্তর টা পার হয়ে এসে নয়, তার ও অনেক দিন পরে বুঝেছি, আসলে ঐ স্তরের কাজ ছিলো আমার মনন কে গড়ে তোলা বা ভিত্তির কাজ দেয়া।
জীববিজ্ঞানে পড়া অক্সিজেনের কাজ, রসায়নে পড়া অক্সিজেনের কাজ, এগুলো অক্সিজেন সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছে, এর পরে যখন মাসুদ রানা পড়েছি, তখন আসলে আগের শিক্ষা গুলো কে সিড়ি ধরে পরের গুলো আমার মনন কে গড়ে তুলেছে। তাই সময়, পর্যবেক্ষন, অভিজ্ঞতা লাভ এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনের চিন্তা করার ক্ষমতা, ব্যাপ্তি এবং বিকল্প চিন্তার প্রসারতা বাড়ে। এটা আমার বিশ্বাস, কিন্তু সবাইকে এ বিশ্বাসের সাথে একমত হতে হবে এটা যেমন আশা ও করি না তেমন আমার এটাই যে চরম সত্যি সে দাবী ও করি না। যে ছাত্র রসায়ন বা জীববিজ্ঞানের আগেই মাসুদ রানা পড়েছে সে কি সিড়ি ছাড়া উঠতে পারে নি? অবশ্যই পেরেছে। আবার এর উলটো টাও দেখা যায়, সব পড়ে, বৈধভাবে পরীক্ষায় রেকর্ড পরিমান নম্বর পেয়ে ও অনেকের জীবনের শিক্ষা টা কোন মনন তৈরী তে তাকে সাহায্য করে নি। আসলে বলতে চেয়েছিলাম, বয়স বা অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে সাধারন ভাবেই মানুষের উপলব্ধি র ক্ষমতা, চিন্তার প্রসারতাএবং মননের ব্যাপ্তি বাড়ে।
তাই ধর্মীয় অনুশাসন কেন চাপিয়ে দেয়া হয় সেটা বোধহয় আমার অনুজ দের চেয়ে কিছুটা হলে ও ব্যাপ্তির দিক দিয়ে বুঝি। আসলে মানুষের মৌলিক দু একটি প্রবনতার মধ্যে গুরুত্বপুর্ন একটি হল পরিবর্তনের প্রতি মনের বাধা (Resistance to Changes)। আরেকটি হলো চিন্তা/ভাবনা, কথা ও কাজের মধ্যে অমিলের প্রবনতা। আমার বিশ্বাস ও অনুভবে মনে হয়, মানষের এই দুটি বোধকে স্তিমিত করার জন্য ই, ধর্মীয় অনুশাসনের উৎপত্তি। কারন মানুষের এই দুটি বোধ ই বিশ্বাস ও খাটি মানুষ হিসাবে জীবন চলার পথের অন্তরায়। যার মধ্যে মন্যুষত্বের লক্ষন নেই তাকে অনুশাসনের বেড়াজালে নিয়ে এসে বদল করা যায় কিংবা যায় না এবং যার মধ্যে বিশ্বাসের অভাব নেই তার জন্য কোন অনুশাসনের দরকার হয় না - এই দুটি তত্ত্বের মধ্যে তার্কিক আলোচনা, তুলনামুলক বিশ্লেষন ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে চলেও গোলশুন্য ড্র ফলাফল প্রসব করতে পারে।
এ জন্যই শুরুতে বলে নিয়েছি, আমি কেবল আমার বিশ্বাসের কথা ই বলবো। কাউকে হেয় করা, জোর করা বা ভয় দেখাবো না। এটা আমি সর্বান্তঃকরনে বিশ্বাস করি, উপলব্ধি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসতে হয়। বাইরের প্রভাব গুলো অনুঘটকের কাজ করে মাত্র, কোনভাবেই সেগুলো বিক্রিয়ার মুল উপাদান হতে পারে না।
খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ীর কথা শুনেছি, যিনি প্রথম দশ রোজায় এক খতম সহকারে তারাবী শেষ করে পরবর্তী ২০ রোজায় সন্ধ্যার পরের ব্যবসাজনিত কার্যক্রমে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন। অর্থ্যাৎ, প্রতিদিন তিন পারা করে খতম হয় তারাবীর সময়। তিনি ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে যা শোনেন তার মানে বোঝেন না। দাড়ি রাখা রাসুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) এর সুন্নত মনে করে দাড়ি রেখেছেন। রাসুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) ব্যবসা করতেন বিধায় তিনি ও ব্যবসা করে প্রশান্তি লাভ করেন। চোখে সুরমা, পাঞ্জাবী তে আতর, ইফতারে খেজুর অবশ্যই থাকতে হবে তার। বৎসরান্তে হজ্ব করা বাধ্যতামুলক মনে করেন, কিন্তু যাকাতের হিসেব করার সময় সম্পদের হিসেব কে বাৎসরিক ইনকাম ট্যাক্সের সম্পদের হিসেব ও স্মরন রাখেন না। সরকারের ট্যাক্স ফাকি দেয়ার জন্য অনেক খরচ করে উকিল নিয়োগ করেন, তাও ভালো যে যাকাতের হিসেবের জন্য তাকে নিয়োগ দেন না। আনুমানিক হিসাব করে যাকাত দেন। দুঃখজনক হলে ও সত্য, তিনি রাসুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) দ্বারা প্রতিপালিত অন্য নিয়মগুলো, যেমন - ওজনে হেরফের না করা, মিথ্যা কথা না বলা, গুদামজাত/কৃত্রিম সংকট তৈরী না করা, সংযমের মাসে দাম বৃদ্ধিজনিত লোভ পরিত্যাগ ইত্যাদি সম্পর্কে জানেন না, জানলেও কাকের চোখ বন্ধ করে রাখার মতো মানেন না।
সারাংশ করতে গেলে বলা যায় যে, অবশ্য পালনীয়, পালনীয় ও ঐচ্ছিক এর মধ্যে সবগুলো ঐচ্ছিক কাজগুলোর মধ্যে পছন্দনীয় সবগুলো মন দিয়ে করেন, খরচ বাচবে এ ধরনের পালনীয় গুলো কিছু কিছু করেন, এবং অবশ্য পালনীয় মানবিক কাজগুলো করার সময় নিজের মন কে কাকের চোখ মনে করেন। আমি মোটেও ব্যবসায়ী বিদ্বেষী কেউ নই। কিন্তু তাদের জ্বালায় যে আমার মতো অনেকের প্রান ওষ্টাগত তা তো অস্বীকার করার উপায় ও নেই।
আসলে একটা উদাহরনে অনেক কিছুই একসাথে দেখা গেলো বলে এটাকে ই উপস্থাপন করলাম। আমি যে তার চেয়ে ভালো কিছু তা দাবী করার ধৃষ্টতা রাখি না। আসলে নিজেকে সাবধান করার জন্য ই এতো কিছু বললাম, এতো কিছু লিখলাম। হয়তো ব্যবসা করার সাহস, ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই নেই বলে তার অনেক খুত দেখতে পেলাম। আমাকে যিনি বা যারা প্রতিনিয়ত দেখেন তারা এর চেয়ে বেশী খুত আমার মধ্যে দেখেন। আমার বিশ্বাস কে পুনরোজ্জিবীত করার একটা প্রয়াস নিলাম মাত্র।
খাটি মানুষ হতে চাইলে ই যে হওয়া যায় না, তার কারন বোধহয় আমাদের সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা অনিয়ম গুলো, কিংবা অনিয়মকারীদের আপাত ভালো থাকা যা অহরহ আমাদের চোখে পড়ে। আসলে বোধহয় সময়, বয়স কিংবা অভিজ্ঞতা ই আমাদের কোন একটা সময়ে বলে দেবে যে আমাদের জন্য কোনটা ভালো। মহান আল্লাহ্তায়লার কাছে দোয়া চাই যে, তিনি আমাদের দেখার শক্তি দিন, বোঝার বুদ্ধি দিন, খাটি মানুষের রাস্তায় পথ চলার মানসিক শক্তি ও সাহস দিন। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





