আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু।
আজকে হেথায় চামচিকে আর পেঁচারা
আসবে সবাই, মরবে ইঁদুর বেচারা। ’
ছোট বেলায় সুকুমার রায়ের "হ য ব র ল" গল্পটি পড়ার ছলে নেড়ার বলা এই ছড়াটি অনেক পড়েছি। "বাদুড়" শব্দটি কতবার যে বলেছি তার কোনো হিসেব নেই। কিন্তু এই বাদুড় সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি। বাদুড় সম্পর্কে জানতে গিয়েই আজকের এই "বাদুড় সমাচার"
বাদুড় Animalia জগতের, Chordata পর্বের, Mammalia শ্রেনীর, Eutheria অধঃশ্রেণীর, Laurasiatheria মহাবর্গ এবং Chiroptera বর্গের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রানী। Chiroptera বর্গের আবার Megachiroptera (বড়বাদুড়) ও Microchiroptera (ক্ষুদেবাদুড়) নামের দুটি শ্রেণিবিভাগ রয়েছে।
বাদুড় কোন পাখি নয়। বাদুড় হলো একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রানী যারা আকাশে উড়তে সক্ষম। পৃথিবীতে প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে যা পৃথিবীতে অবস্থানরত স্তন্যপায়ী প্রানীদের ২০ ভাগ। বাদুড়ের মুখ দেখতে অনেকটা শিয়ালের মুখের মতো, খরগোশের মতো বড় বড় দুটো কান, ছাতার মতো অদ্ভুত দুটি ডানা।
পুরানো কুয়া, সড়কের কালভার্ট, দেয়ালের ফাটল, গাছের খোঁড়ল, , পাথরের ফোঁকর, গুহা-গহবর, পোড়ো-দালান, পুলের তল, সড়কের কালভার্ট, বড় বড় গাছ ইত্যাদিই হলো বাদুড়ের আস্তানা। এসব জায়গায় সাধারণত এদের স্তূপীকৃত মল ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়ায়। কোনো প্রকার বিঘ্ন না ঘটলে এরা বহু বছর একই জায়গায় থাকে। বাদুড় এর সবচেয়ে বড় কলোনী বলা হয় টেক্সাস এর ব্র্যাকেন গুহা কে(Bracken Cave, Texas)ধারণা করা হয় এই এক গুহাতেই প্রায় ২০ মিলিয়ন বাদুড় রয়েছে।
বাদুড়ের ঘ্রাণশক্তি ও শব্দবোধ অত্যন্ত তীব্র। এরা খাদ্য ও বাসস্থানের খোঁজে ঘ্রাণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করে। অনেকের ধারনা বাদুড় দৃষ্টিহীন যা একদম ঠিক নয়। চামচিকা ও মিশরীয় Rousettus aegyptiacus(কলাবাদুড়) প্রতিধ্বনিভিত্তিক স্থান নির্ণয় পদ্ধতি অবলম্বন করে। চামচিকারা মুখ ও নাকের মাধ্যমে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ উৎপাদন করে। আর মিশরীয় কলাবাদুড় জিহবার মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন করে। চলার সময় বাদুড় ক্রমাগত মুখ নাক দিয়ে শব্দোত্তর তরঙ্গের শব্দ তৈরি করে এবং সেই শব্দ তার চারপাশ থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসলে বাদুড় সেই প্রতিধ্বনি থেকেই আশেপাশের সম্ভাব্য বাধা-বিঘ্ন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে ও তা এড়িয়ে চলতে পারে। ফলে অতি সহজেই এরা শিকার ধরতে পারে এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারে। সাধারনত সব বাদুড়ই নিশাচর বা গোধূলিচর তবে কোনো কোনো কলা বাদুড় দিনের বেলাতেও উড়ে।
বাদুড় সাধারণত ফল ও ফলের রস, পতঙ্গ, মাকড়সা, মাছ, ব্যাঙ, ছোট সরীসৃপ ও পাখি, ক্ষুদে বাদুড় ও অন্যান্য ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রানী খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে। তবে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চলে রয়েছে রক্তচোষা বাদুড়। এরা উষ্ণরক্তবিশিষ্ট প্রাণীর রক্ত পান করে। সব থেকে চমৎকৃত তথ্য হলো একটি মাঝারি সাইজ এর বাদুড় ঘন্টায় যে পরিমাণ পোকা খায় তা একজন মানুষের এক রাতে ২০ টা পিজ্জা খাওয়ার সমান। তাছাড়া ব্যাট কনজারভেশান ইন্টারন্যাশনাল এর মতে, ১৫০ টি বাদুড় বছরে ফসলের জন্য ক্ষতিকর যে পরিমাণ পোকা খেয়ে ফেলে তা কৃষক কে অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
বাদুড়ের গর্ভধারণকাল ৩-৫ মাস। শীতের শেষ বা গ্রীষ্মের শুরুতে বাচ্চা প্রসব করে। বছরে একবারই মা বাদুড় বাচ্চা প্রসব করে। সাবালক না হওয়া পর্যন্ত বাচ্চারা প্রথম ২-৩ মাস মায়ের শরীরেই সেঁধে থাকে।
ওকল্যান্ড চিড়িয়াখানার তথ্যানুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাদুড় হচ্ছে Megachiroptera শ্রেণিগত ফ্লাইং ফক্স(Flying fox) বা কলা বাদুড়,Pteropus giganteus। এদের ডানার মাপ 5 থেকে 6 ফুট (1.5 থেকে 1.8 মিটার), এবং ওজন 2.2 ফাউন্ড। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের তথ্যমতে Megachiroptera শ্রেণীগত ক্ষুদ্রতম বাদুড় হচ্চে long-tongued fruit বাদুড়। এদের ডানার মাপ 10 ইঞ্চি (২5.4 সেন্টিমিটার) এবং ওজন প্রায় আধা আউন্স (14 গ্রাম)।
ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান মিউজিয়াম অব জিউলজি'র তথ্যমতে পৃথিবীর সবথেকে ছোট বাদুড় হচ্ছে Microchiroptera শ্রেণীগত false vampire অথবা spectral বাদুড়। এদের ডানার মাপ 40 ইঞ্চি (1 মিটার) এবং ওজন 5 থেকে 6.7 আউন্স (145 থেকে 190 গ্রাম)। আর Microchiroptera শ্রেণীগত ক্ষুদ্রতম বাদুড় হচ্ছে bumblebee বাদুড়। এদের ডানার মাপ 1.25 ইঞ্চি (3 সেমি) এবং ওজন প্রায় ২ গ্রাম (0.07 আউন্স)।
বাদুড় রাতের আধারে চুপিসারে আমাদের ফলগাছের কিছু ফলের ভাগ নিলেও বুনো গাছপালার পরাগায়ণ, বীজ-বিস্তরণ ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের দ্বিগুন সহায়তা করে।
বাদুড়ের কোনো কোনো প্রজাতি জলাতঙ্কের ভাইরাসবাহী। তাই সাবধান যদি কখনো আপনি ভুল করে বাদুড়ের গুহায় ঢুকে পরে তাদের অবস্থার ব্যাঘাত ঘটান কিংবা কোনো বাদুড় আচমকা পথ হারিয়ে আপনার উপর পরে আপনার শরীরে কামড় বসিয়ে দেয় তাহলে
জলাতঙ্করোধী টিকা আপনার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পরবে।
শেষ করছি বাদুড় নিয়ে তিনটি মজার তথ্য দিয়ে:-
♦দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকানরা বাদুড় কে প্রশিক্ষণ দিয়ে বোমা ফেলার জন্য চেষ্টা করেছিল।
♦চীন এবং জাপানে বাদুড় আর হ্যাপিনেস একই শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়। এই দুই দেশে "হ্যাপিনেস" এবং "বাদুড়" এই দুই শব্দকেই "ফু(fu) " দিয়ে বোঝানো হয়।
♦বেশিরভাগ বাদুড় বিশ্রাম, ঘুম, মিলিত হওয়া এবং বাচ্চা জন্ম দেয়ার কাজটি করে উল্টা হয়ে।
তথ্যসূত্রঃ
১. https://www.livescience.com/
২. https://en.wikipedia.org/
৩. https://www.bigganbangla.com/
৪. http://bn.banglapedia.org/
ছবিঃ ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৮:১২