somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমুদ্র জীবনের গল্প (মোবাইল কথন)

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাত্র অল্প কদিনের সমুদ্র যাত্রায় অনেক দেশ ঘুরার সৌভাগ্য হইছে। বিভিন্ন দেশে যায়া সবার আগে যেটা খুজি তা হইল মোবাইল সিম। ১০/১৫ দিন পর যদি বাসায় একটু ফোন করে মন খুলে কথাই না বল্লাম তাইলে ক্যামনে হবে? এমনিতে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য শিপ এ স্যাটেলাইট ফোন থাকে। খুবই কস্টলি। পার মিনিট প্রায় ৭০/৮০ সেন্ট। বর্তমান সময়ে বাইরের দেশের অনেক নামিদামি শিপিং কোম্পানী জাহাজের ক্রু এবং অফিসারদের জন্য 24/7 ইন্টারনেট সুবিধা দেয়। এর ফলে পৃথিবীর যে কোন ল্যাটিচিউড, লংগিচিউড থেকে আপনি যোগাযোগ রাখতে পারবেন। বাংলাদেশি জাহাজ গুলোতে এই সুবিধা এখনো হয়নি। হয়তো আরো ৫/৭ বছর লাগবে। যাউকগা, কি জানি বইলতেছিলাম।
আমার প্রথম ভয়েজ ছিল পাশের দেশ ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের একটা পোর্ট। ওই পোর্টে গিয়েই ১০ ডলার খরচা করে সিম কিনলাম। ভিতরে ৫০০ রুপী। কিন্নাই দেশে নগদে ফোন। একটু পর দেখি মোট্টে আর ৩০০ রুপী আছে। তাও ভালো কথা তো কইছি। কিন্তু দুঃখিত হইলাম যখন দেখি জনগন এক দেড় ঘন্টা টানা কথা বলতাছে কিন্তু ব্যালেন্স শেষ হয়না। বিষয় কি? পরে জানতে পারলাম যে ৩০ রুপী মত খরচ করে একটা প্যাকেজ খরিদ করলে এক মাসের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে ২ রুপী/মিনিটে কথা বলা যায়। এমনিতে যা ১৫ রুপী। এমন ধরা খাই গেলামরে। :((:((:(( কিন্তু এমন ভাব নিলাম যে ধুর মিয়া ২ টেইক্কা কথা কিছু শুনা যায়। আমিতো এক্কেরে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার কথা কইলাম। হাহ। তারপর থেকে যেকোন খানে গেলে সিম কিনে আগে জনমত যাচাই করি। কোন অফার আছে নি তা জানার জন্য।
ওই পোর্ট থেকে যাওয়ার পর সিমটা যত্ন করে রেখে দিলাম। নেক্সট টাইম ইন্ডিয়া আসলে আবার কাজে দিবে। আউটার থেকেই বাসায় ফোন করা যাবে। ৩ মাসের মাথায় আবার ইন্ডিয়া যায়া কল করতে গিয়া মাথা নস্ট। সিমের কাগজপত্র নাই তাই সিম বাতিল। দেশের কথা খুব মনে পড়লো। ওখানে তো সামান্য কাগজের জন্য কেউ সিম বাতিল করে না। উল্টা রিচার্জ করলে ৩০০/৪০০ % বোনাস দেয়। তোরা পুরাই ছুটুলোক।




দেশে থাকলে আর কিছু করতে পারতাম বা না পারতাম, পেট ভইরা কথা তো কইতে পারতাম। /:)/:)ভারতের প্রত্যেকটা প্রদেশ একেকটা দেশ। কেউ এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে কল করতে চাইলে তার জন্য রোমিং চার্জ প্রযোজ্য হবে। লোকাল চার্জ না। কিন্তু প্রত্যেকটা অপারেটরের ইন্টারনেট খুবই সস্তা। অপারেটর ভেদে গড়ে ৯০ থেকে ২০০ রূপীর মধ্যেই সারা মাস আনলিমিটেড নেট ইউজ করা যায়। তাই পরের বার আর ধরা খাই নাই। কল অফারের ঝামেলায় না যায়া নেট কিনে ফেলতাম আর ধুমায়া স্কাইপে, এফ বি আর জালে জালে ঘুরতাম। রাশিয়াতে গিয়াও এই সুবিধা পাইছি।:P:):D
রাশিয়ার মুদ্রা রুবল। ১ ডলার প্রায় ৩০ রুবল। কিন্তু ওখানে জিনিসপত্রের যে দাম। পুরা মাথা খারাপ। আর বাংলাদেশে মিনিমাম কলরেট পার মিনিট ২২ রুবল। আমাদের জাহাজের স্যাটেলাইট কলের প্রায় সমান। কিন্তু ইন্টারনেটের ব্যাপার আলাদা। সারাদিন যাই ইউজ করেন বিল আসবে ৮.৫ রুবল। ১ কিলো বাইটের জন্য যা ৫০০ মেগার জন্যেও তাই। আর স্পীড তো সেই...... প্রায় ৪০ KB/S ধুমাইয়া নাটক নামাইলাম কিছু আর কথা তাতো চলছেই....;)
এরপর ইরানে গিয়ে একটা অস্থির অভিজ্ঞতা হইলো। এখানে সিম কিনতে হয়না। সিম ভাড়া পাওয়া যায়। ৫ ডলার। সাথে ৪০০০০ রিয়েল। জ্বি। ফরটি থাউজেন্ড। এটা এখানে এক প্লেট বিরানীর দাম। আর ওদের ব্যাংক নোট গুলার এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত খালি শূন্যই দেখা যায়। দশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ, পাঁচ লাখ, পঞ্চাশ লাখ, এক কোটি রিয়েলের নোট। দেখার মত।


বাংলাদেশে কল করতে মিনিটে প্রায় চার হাজার রিয়েল লাগে। এই হইলো অবস্থা। তবে এই দেশে এসে বুকটা ভরে গেছে আনন্দে। এখানকার বাজারে অধিকাংশ পোশাকের দোকানে made in bangladesh লেখা টিশার্ট, প্যান্ট আর শার্ট দেখে।

এবার একটা মজার ঘটনা শেয়ার করি। ইরান থেকে আমাদের নেক্সট পোর্ট ছিল সিঙ্গাপুর। আসার সময় ভারতের কোস্ট দিয়ে আসতে হয়। জাহাজের প্রায় সবার কাছেই ইন্ডিয়ান সিম আছে। তাই সবাই নিশ্চিত যে ইন্ডিয়ার কোস্ট পার হওয়ার সময় নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে। দেশের প্রিয় মানুষদের সাথে কথা বলা যাবে। কিন্তু সমস্যা হল কখন ওই কোস্ট টাচ করে যাবে তা কেউ জানে না। ইঞ্জিন রুমে আমার এক বন্ধু ছিল। নামটা উল্লেখ করলাম না। দেশে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলার জন্য তার মন গুটুরগাটুর করতেছিল খালি। যেহেতু ব্রিজে আমার ন্যাভিগেশন ওয়াচ আছে তাই আমাকে একটু পর পর কল করে জিজ্ঞাসা করত, দোস্ত চার্টে (ম্যাপ)হিসাব করে একটু দেখিস কখন নাগাদ নেট পাওয়া যাইতে পারে। অনুরোধে ঢেঁকি গিলার মত অবস্থা। জাহাজের স্পীড ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ে কমে। কাঙ্ক্ষিত নেটওয়ার্কবহুল জায়গায় (কোস্টের কাছাকাছি তাই ধারনা করা যায় নেটওয়ার্কবহুল। এটাও নিশ্চিত না ওখানে আদৌ নেটওয়ার্ক আছে নাকি।) কখন যাবে তা শুধু ১৫/ ২০ ঘণ্টা আগেই চার্টে মাপামাপি করেই এত নিশ্চিত করে বলে দেয়া যায় না। তবু এভারেজ গতি (১২ নট) ধরে হিসাব করে বললাম রাত প্রায় ১ টা বাজতে পারে। সাথে সাথে প্রিয় বন্ধুরে এটাও বলে দিলাম যে, এটা কনফার্ম না। স্পিডের উপর ভেরি করবে। কিন্তু ওই শালা পরোপকার করতে গিয়া ইঞ্জিন রুমের বোর্ডে গোটা গোটা হরফে লিখে দিল আজ রাত ১২ ঘটিকায় ইন্ডিয়ার নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে। আর কি!! এম্নিতেই সবাই নেটওয়ার্কের জন্য পাগল। জাহাজের চীফ, সেকেণ্ড সহ সব ইঞ্জিনিয়ার আর ক্রু সবাই তাই রাত ১২ টায় রেস্ট আওয়ারে নেটওয়ার্কের জন্য ডেকে ঘুরঘুর করতে লাগলো। যাদের ডিউটি তারাও ইঞ্জিন রুম ছেড়ে নেট খুঁজছে। কিসের নেট কিসের কি। সকাল ৪ টা, ৫ টা, ৬ টা নেটের কোন খবর ই নাই। নেট খুঁজতে খুঁজতে কেউ নিজেরাই হারাইয়া গেছে। মানে ডেকেই ঘুম। পরের দিন সকালে আমি মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় চলে আসলাম। সবাই আমাকে চেরাগ জ্বালাইয়া খুজতাছে। আমি ভুল ইনফরমেশন দিছি তাই। কেবিনের দরজায় ধুমধাম।
-কি হইল দোস্ত। নেট পাইছস?
-শালা আমারে এক্সট্রা ডিউটি লাগাইছে। তোর লাইগা।
-আমি কি তোরে কইছি যে কনফার্ম? আবার পাকনামি কইরা নোটিস টাঙ্গাইছ। ঠিক ই আছে।
নাস্তা খাইতে গেলাম। সবাই আমাকে ধরল। অই মিয়া তুমি উড়াধুড়া হিসাব দিছ ইঞ্জিন রুমে। সবাই না ঘুমায়া ছিলাম সারা রাত। তোমারে ক্রেনের হুকের লগে ঝুলায়া সমুদ্রে চুবামু। বাস্তবে যা ১ বাই ০ এর মতই অবাস্তব। আমার সিনিয়র অফিসার রা অনেক ভালো ছিল। সেই নেট ঠিক ই পাওয়া গিয়েছিল। সকাল ৮ টায়।
প্রিয়জন থেকে দূরে থাকি বলে কতটা মিস যে করি তা বলে বুঝাতে পারবোনা। একটু কণ্ঠস্বর শুনতে পারলেই যেন সব কষ্ট ভুলে যাই। জাহাজ যখন বাংলাদেশে এপ্রোচ করে তখন সেন্টমার্টিন থেকেই শুরু হয়ে যায় আমাদের নেটওয়ার্ক মিশন। যার যত সিম যত সেট আছে সব নিয়ে ঝাপিয়ে পড়া। জাহাজের উঁচু ক্রেন, ব্রিজ উইংস, ডেক সব খানে সবাই নেটওয়ার্ক পাওয়ার জন্য ঘুরঘুর করতে থাকে। কেউ কল করতে পারলেই যেন মোটামুটি বিশ্ব জয় করে ফেলেছে এমন অবস্থা।
এটা আমাদের সমুদ্র জীবনের একটা অধ্যায়। মোবাইল অধ্যায়। খুব কি খারাপ লাগলো? ভালো থাকবেন সবাই আর দোয়া করবেন।

আগের পর্ব:
সমুদ্র জীবনের গল্প
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:১৬
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×