শুভ্র আমার মামাতো ভাই। বোকাসোকা, ভীতু এবং একটু ছাগু গোছের হয়ে গেছে। আমার মামা ও মামীর কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ওর জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে।
ও যখন ছোট ছিল মামী কি যেন স্বপ্নে দেখেছিলেন এবং পরের দিন সকালেই ডিসিশন নিয়ে ফেললেন যে ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াবেন। আমার মামা একটু স্ত্রৈণ প্রকৃতির এবং স্ত্রীর কোনও কথাই তিনি ফেলতে পারেন না। অগত্যা যা হবার তাই হল এবং ছেলেকে কউমি মাদ্রাসায় ভর্তি করালেন।
আমরা আসার পর শুভ্র আর আমাদের দেখতে আসতে পারে নি। তাই জনকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পর গত রবিবার দেখতে আসলো। জন আর আমি প্রতিবার আসলেই শুভ্রর অক্লান্ত চেষ্টা থাকে কি ভাবে জনকে "দ্বীনের পথে" মানে ধর্মান্তরিত করে মুসলিম বানানো যায়। এবারেও একই চেষ্টা, কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে। জনও খুব মজা পায়, কিন্তু ছোট শালা হিসেবে অনেক আদরও করে। খাবারের টেবিলে জন ও শুভ্রর আলাপঃ
শুভ্রঃ (ভাঙা ইংরেজিতে) দুলাভাই হ্যাভ ইউ হার্ড এবাউট টার্কিশ মিলিটারি ক্যু?
জনঃ শুভ্র বাংলায় বল। বিষয়টা অনেক কম্পলিকেটেড। আমি বুঝতে পারবো ও তোমাকে ভাঙা বাংলা ও ইংরেজিতে উত্তর দিবো।
শুভ্রঃ আপনি টার্কিশ ক্যু সম্বন্ধে নিশ্চয়ই শুনেছেন।
জনঃ হ্যাঁ অবশ্যই।
শুভ্রঃ দেখেছেন ভাইয়া! সকল ষড়যন্ত্র হবার পরও চক্রান্তকারীরা এই মুসলিম নেতাকে নামাতে পারলো না। তুর্কীরা দেখিয়ে দিলো তাঁরা বাঘের জাত, বাঙালিদের মতো ভেড়ার জাত না।
জনঃ তুমি কি ভেড়া?
শুভ্রঃ মানে বুঝলাম না ভাইয়া।
জনঃ এই যে তুমি বললে যে বাঙালিদের মতো ভেড়ার জাত না। তো তুমি যেহেতু বাঙালি সেহেতু নিশ্চয়ই ভেড়া!
শুভ্রঃ না মানে ... আমি বলতে চাইছি তুর্কীরা অনেক সাহসী।
জনঃ সেটা বলতেই পারো। কিন্তু পরের প্রশংসা করতে গিয়ে নিজের অপমান করো কেন?
শুভ্রঃ না মানে ...
জনঃ শোনো পৃথিবীর কোনও জনগোষ্ঠী জাতি ভিত্তিতে সাহসী বা কাপুরুষ হয় না। তোমরাই তো পাকিস্তান থেকে যুদ্ধ করে আলাদা হয়েছ। তারপরেও নিজেদের ভেড়া বল? দুঃখজনক।
শুভ্রঃ না ভাইয়া আমি তুর্কীদের নিয়ে কথা বলছিলাম। আমি বলতে চাইছিলাম যে কতো সাহস দেখেছেন যে ট্যাঙ্কের সামনে শুয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ? তাঁদের নেতাকে কতোটা ভালোবাসে সাধারণ মানুষ যে নিজেদের জীবন বাজী রাখতেও দ্বিধা বোধ করে না। এই এরদোগান দেখবেন সারা মুসলিম বিশ্বকে একদিন মুক্ত করবেন ইনশাল্লাহ।
জনঃ (ভ্রু কুঁচকে) এটা কি তুমি সত্যিই বিশ্বাস করো?
শুভ্রঃ জী ভাইয়া।
জনঃ আচ্ছা তাহলে শোনো। আমি কি জব করি নিশ্চয়ই জানো।
শুভ্রঃ জী ভাইয়া আপনি মার্কিন বিমান বাহিনীতে মেজর।
জনঃ হ্যাঁ। কিন্তু এটা জানো কি যে আমি আফগানিস্তান, ইরাক, ইয়েমেন, লিবিয়াতে মিশন করেছি এবং এবার ফেরত গেলে সিরিয়াতে মিশন করবো?
শুভ্রঃ না আমি সেটা জানতাম না।
জনঃ এখন জানলে। বল তো আমরা কোন দেশ থেকে মিশনের জন্য ফ্লাই করেছি?
শুভ্রঃ আমেরিকা থেকে নাহলে এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার থেকে?
জনঃ আমেরিকা থেকে শুধু লং রেঞ্জ ট্যাকটিকাল বম্বার এবং এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে শুধু নেভির পাইলটরা সীমিত মিশন করে। আমরা যারা বিমান বাহিনীতে আছি, আমরা যেই দেশে মিশন করি তার কাছাকাছি একটা বেস থেকে হামলা চালাই। আমরা ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে তুরস্কের ইন্সারলিক বেস থেকে হামলা চালাই?
শুভ্রঃ মানে? কি বলছেন? এই বেস নিশ্চয়ই এরদোগানের আসার আগে চালু হয়েছিলো?
জনঃ না। এটা এরদোগান সাহেব ক্ষমতায় এসে চালু করে আমাদের দিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু তাঁদের আমরা ন্যাটোর সদস্য বানিয়েছি, চুক্তি অনুযায়ী তাঁদের রাষ্ট্রে আমাদের ব্যাপক সামরিক সদস্য এবং অস্ত্রাগার থাকতে হবে। তুরস্কে আমরা আমাদের পারমাণবিক বোমার স্টকপাইলের একাংশও রাখি। আরব বসন্ত যখন শুরু হয়েছিলো, তুরস্ক থেকেই আমাদের সিআইএ অপারেট করেছিলো। আইএস যখন সিরিয়ার অর্ধেক দখল করলো, তখন ঐ আইএসকে অস্ত্র, জঙ্গি ও অর্থায়ন দিয়ে সমর্থন করছে তুর্কীরাই। কারন সিরিয়া থেকে ব্যাপক পরিমানে চোরাই তেলের মজুদ দেয় আইএস, যেটা আমরা তুরস্ক থেকে নিয়ে যাই।
শুভ্রঃ (একদম চুপ হয়ে রইলো)
জনঃ এরদোগানকে আমরাই বসিয়েছি। ঠিক যেমন মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের মুরসিকে বসিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের তাৎক্ষনিক স্বার্থ নিহিত হবার পর তাঁকে সরিয়ে জেনারেল সিসিকে বসিয়েছি। সময় হলে তাঁকেও সরিয়ে দিবো আমরা। ঠিক যেমন আমাদের স্বার্থ শেষ হয়ে গেলে এরদোগানকেও সরিয়ে দিবো, যেভাবে গাদ্দাফি, আলী আবদুল্লাহ সালেহ, হসনি মুবারক ও সাদ্দামকে সরিয়েছি। ওর পরিনতি একই হবে।
শুভ্রঃ তাহলে এই সেনা বিদ্রোহ?
জনঃ ভুয়া বিদ্রোহ। বানোয়াট নাটক তৈরি করা হয়েছে যাতে এরদোগান আরও লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকে। এই ভুয়া বিদ্রোহ দিয়ে এরদোগান তাঁর সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিলো। আমরা তুরস্কে নতুন সংবিধানও আনছি, যার ফলে তুরস্ককে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে ইসলামিক রিপাবলিকে পরিনত করা হবে?
শুভ্রঃ কিন্তু ইসলামিক রাষ্ট্র হলে আমেরিকার কি লাভ?
জনঃ অনেক লাভ। মার্কিন পলিসি মেকাররা মানব জাতির গত ১০ হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস পড়ে এটা বুঝেছে যে একটা রাষ্ট্র যতটা ধর্ম ভিত্তিক হবে, ততোটাই অনুন্নত হবে। এটা একাবিংশ শতক, মধ্যযুগ না। আর অনুন্নত সমাজকে শাসন ও শোষণ করা সহজ। ঠিক যেমন তোমরা এরদোগান কে নিয়ে মাতামাতি করছ, আমাদের নেতারা ঠিক সেটাই চায়। কারন যেকোনো ধরনের চেতনাকে একটি গোষ্ঠীকে সহজে খাওয়ানো যায়। মুসলিমরা যেহেতু এখনো অনেক প্রিমিটিভ, সুতরাং আন্তর্জাতিক রাজনীতির সূক্ষ্ম চাল বোঝার ক্ষমতা তোমাদের অধিকাংশেরই নেই।
শুভ্রঃ (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) তাহলে ভাইয়া আমরা কি করবো?
জনঃ ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রেখে বাস্তববাদী হও। পড়াশোনা করো। বিশ্বকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোনের বদলে যুক্তিবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখো। হয়তো কয়েকশ বছর পর উন্নতি করতে পারবে। আমাদের দেখো, আমরা মার্কিনীরা কিই না আবিস্কার করেছি। লাইট বাল্ব, ইলেকট্রিক ওয়েল্ডিং, টারবাইন জেনারেটর, বিমান, টেলিভিশন, টেলিফোন থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন, স্মার্ট ফোন, পার্সোনাল কম্পিউটার, সুপার কম্পিউটার, রোবট এমন কি ইন্টারনেটও আমাদের আবিস্কার। পড়াশোনা ছাড়া কি কিছু সম্ভব ছিল?
শুভ্রঃ ভাইয়া কোরআনেই সকল বিজ্ঞান আছে। ওখান থেকেই অমুসলিমরা সব শিখে আবিস্কার করেছে।
জনঃ আর কতো একই ঢাক বাজাবে? বাজাতে বাজাতে ফাটিয়ে ফেলেছ। আচ্ছা ধরলাম কোরআনে সকল বিজ্ঞান আছে। সেই কোরআন থেকে আমরা সবই শিখেছি, আর তোমরা কি (আমার দিকে তাকিয়ে) বর্ষা কিছু না করাকে বাংলায় যেন কি বলে?
আমিঃ বাল ফালানো
জনঃ (শুভ্রর দিকে তাকিয়ে) আমরা অমুসলিমরা কোরআন থেকে সব শিখেছি আর তোমরা কি বাল ফেলেছ?
শুভ্রঃ (লজ্জা পেয়ে) ইয়ে ভাইয়া আপনার তো দেখি আপুনির মতো মুখ হয়ে গেছে।
জনঃ হবেই তো। সাড়ে ৬ বছরের সংসারে অনেক কিছুই একে অন্যের মতো হয়ে যায়। তবে আমি কি বলেছি বুঝতে পেরেছ?
শুভ্রঃ জী ভাইয়া।
জনঃ কি বুঝলে?
শুভ্রঃ বুঝলাম যে মুসলিমদের উন্নত হতে হলে কঠোর অধ্যাবসায় করতে হবে। পড়াশোনায় ঝুঁকতে হবে। তাহলে হয়তো ৪০০ বা ৫০০ বছরে আমরা উন্নত হয়তো বা হতে পারি।
জনঃ কারেক্ট। স্মার্ট বয়!
লিখেছেন - Nazia Yusuf Levinson
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪১