ঠিক কত দিন পরে রিভিউ লিখছি তা নিজেও জানি না। আগে লিখার অভ্যাস বশত কিছু লিখতে পারতাম। কিন্তু “অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস”। এখন সেটা শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাই আগেই বলে রাখি রিভিউ খারাপ হলে দোষ দিতে পারবেন না।
নাম- The Third Man
পরিচালক- Carol Reed
মূল গল্প এবং স্ক্রিনপ্লে- Graham Greene
অভিনয়ে- Orson Welles, Joseph Cotten, Alida Valli
মুক্তির সাল- ১৯৪৯
দৈর্ঘ্য- ১০৪ মিনিট
আইএমডিবি রেটিং- ৮.৪
রোটেন টম্যাটো রেটিং- ১০০%
জনরা- Film-Noir, Mystery, Thriller
◘◘◘ আগে কিছুক্ষণ বলি এই জনরা নিয়ে। কেননা জনরা না দেখে মুভিটি দেখলে এর ৭০% মজাই নষ্ট হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। বর্তমান সময়ে নির্মিত ভালো অনেক মুভিকেই আমরা একটি বিশেষ জনরাতে ফেলতে পারি, তা হল Neo-noir। Neo-noir নতুন জনরা হলেও এটি মুলত আগের Film-Noir এর আধুনিকায়নের ফলেই তৈরি। তাই আমরা এদেরকে প্রায় একই রকম বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করতে পারি। এবার একটু বলে নিই Film-noir সম্পর্কে। হালের অনেকে এই জনরার ভক্ত হলেও তারা নিজেরাই জানে না তারা কি ধরনের মুভি দেখছে।
◘◘◘ Film –Noir কথাটির অর্থ করলে দাঁড়ায় “কালো ছবি”। এটি এসেছে ফ্রেঞ্চ থেকে। নাম শুনেই বুঝা যাচ্ছে এখানে কালো রং এর উপরে বিশেষভাবে জোর দেয়া হবে। আসলে ঠিক কালো নয়, জোর দেয়া হয় আলো আর ছায়ার উপর, অন্ধকারের উপর। এক্ষেত্রে দৃশ্যগুলি হয় দেখার মত, তাক লাগানো। যেহেতু আলো-আধারের কথা আসলো তাই বুঝতেই পারছেন এই ধরনের মুভিতে মুল গুরুত্ব থাকে সিনেমাটোগ্রাফির উপরে। সিনেমাটোগ্রাফি ভাল হলে এই মুভি পৌঁছে যায় শিল্পের পর্যায়ে। একদম নতুন কিছু মনে হলেও আসলে এর চর্চা শুরু ১৯৩০ সালের দিকে। তবে এই ধরনের মুভি তার খ্যাতির চরম পর্যায়ে পৌছায় ১৯৪০ এর দশকে। ১৯৫৫ সালের দিকে এসে এর জনপ্রিয়তায় ভাটা পরে। এরপরে অনেকদিন এ ধরনের মুভি বানানোই হয়নি। কিন্তু পরে আবার একে একটু পরিবর্তন করে অনেক মুভি বানানো হয়/হচ্ছে। পরিবর্তন মানে এর জনরার সাথে ক্রাইমের মিশেল করে দেয়া হচ্ছে। শুধু ক্রাইম নয়, ৭০ এর দশকে উদ্ভব হওয়া এই নতুন জনরাতে আধুনিক টেকনোলজির ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ। একেই বলে Neo-noir। Neo-Noir মানে হল, “নতুন ধরনের কালো”, বুঝাই যাচ্ছে, Film-Noir কেই নতুন করে উপস্থাপন করার একটা চেষ্টা। যদিও Film-noir এর ধারনা অনেক পুরানো। আমাদের আলোচ্য মুভি যেহেতু Film-Noir জনরার তাই আপাতত এই জনরা নিয়েই বলা যাক। এই ধরনের ছবির একটা বিশেষ গুন রয়েছে, এতে মূল ভায়লেন্স না দেখিয়ে অনেকটা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এতে করে মুভি আরো উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আপনার স্নায়ুতে চাপ মানে মানসিক চাপ তৈরি করতে এ ধরনের ছবির জুড়ি মেলা ভার। তবুও এ ধরনের মুভি অনেকেই বানাতে চান না। কেননা একটু সমস্যা করলেই পুরো ছবিই নষ্ট হবার আশংকা থাকে। মুভিতে মূল চরিত্রকে সাধারনত দেখানো হয় এন্টি-হিরো হিসেবে। তুলে ধরা হয় তার সমস্যার দিক। তার সমস্যার সাথে দর্শকের চিন্তা চেতনা মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেয়া হয়। দর্শক নিজেকে সারাক্ষণই আবিস্কার করে তার স্থানে, আর ভাবতে থাকে সম্ভাব্য পরিনতি সম্বন্ধে। আর একটা ব্যাপার হল এর ইন্ডিং। এই ধরনের মুভির ইন্ডিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে হয়ত আপনাকে পুরো জিনিসটা দেখানো হবে না কখনই। ছবির শেষে তাই আপনি এর পরের ঘটনা হাতড়ে বেড়াবেন। অনেকটা ছোট গল্পের সংজ্ঞার মত, “শেষ হইয়াও হইল না শেষ”।
অনেকেই অবশ্য এ ধরনের মুভি পছন্দ করে না। তবে একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই জানতে পারবেন এই ধরনের মুভিই কিন্তু যুগে যুগে সবচেয়ে বেশি রেটিং পেয়ে এসেছে এবং আসছে। আরও কিছু বৈশিষ্ট্য অবশ্য আছে, তবে আজ আর না।
অনেকেই হয়ত এই আলোচনা দেখে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন যে এই ধরনের মুভি তিনি দেখেছেন কিনা? তাদের জন্য কয়েকটা মুভির নাম দেয়া হল। দেখুনতো, দেখেছেন নাকি কোনটা- M (1931), Sunset Blvd. (1950), The Maltese Falcon (1941), Double Indemnity (1944), Strangers on a Train (1951), The Killing (1956), Notorious (1946)
যাদের এখনও সন্দেহ আছে তারা হালের কিছু মুভির নাম দেখুন- Memento (2000), Insomnia (2002), The Prestige (2007), Batman Begins (2005), The Dark Knight (2008), The Dark Knight Rises (2012) , Pulp Fiction, American Psycho , Road to Perdition, Donnie Darko, The Sixth Sense, Inglourious Basterds , Sin City , Taxi Driver, The Departed , Watchmen , Drive, Se7en , Fight Club, Shutter Island, Mulholland Dr., দেখেছেন নাকি? এদের সবগুলোকেই Film-Noir/Neo-Noir কাতারে ফেলা যায়।
◘◘◘ অনেক কথা বলে ফেললাম, এবার আসি মূল কাহিনীতে, The Third Man হল Film-noir মুভির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই এখানে বারবার ক্যামেরার কাজ আর শব্দ সম্পর্কিত কথা উঠে আসতে বাধ্য। আমি আজকের রিভিউতে গুরুগম্ভীর কোন কথা বলব না। শুধু কিছু দৃশ্য সম্পর্কে বলব আপনাদের। তার আগে মুভির গল্প খানিকটা বলে নিই। ভয় পাবেন না, কাহিনীতে স্পয়লার থাকবে না আশা করি।
প্লট►► বন্ধু চাকরী দেবে, তাই দেখা করতে আসা। কিন্তু এসে যোগ দিতে হয় তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে। দুর্ভাগা আমাদের গল্পের নায়ক, মদে আসক্ত এক পাল্প লেখক, হলি মারটিন্স। সময়টি হল যুদ্ধপরবর্তী সময় আর স্থান হল ভিয়েনা। নিতান্তই কৌতূহল বশত তিনি খোঁজ নিতে যান কিভাবে তার বন্ধুটি মারা গেল। জানতে পারা গেল সড়ক দুর্ঘটনা হল ঘাতক। কিন্তু ঘটনার বর্ণনা একেকজন একেক রকম ভাবে দিচ্ছে। কেউ বলছে দুর্ঘটনার পরে ২ জন তাকে ধরে রাস্তার ধারে নিয়ে আসে। আবার কিছু প্রত্যক্ষদর্শী বলছেন লোক ছিল ৩ জন। এই রকম ভাবেই একপ্রকারের ইনভেস্টিগেশনে জড়িয়ে পরেন তিনি। কাহিনী আরও বড় আকার ধারণ করে যখন মৃত বন্ধুর প্রেমিকার সাথে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন তিনি। এরই মধ্যে খুন হয়ে যায় তৃতীয় ব্যক্তিকে দেখা প্রত্যক্ষদর্শী। এই খুনের দায় চাপানো হল তার ঘাড়ে। তাহলে কি তার বন্ধুর মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়? তাহলে তাকে কে বা কারা খুন করল? খুনের পিছনে কারন কি? সেই তৃতীয় ব্যক্তিটিই বা কে? কি করে সে নিজে ছাড়া পাবে পুলিশের কাছ থেকে? বন্ধুর প্রেমিকার সাথে তার সম্পর্কেরই বা কি হবে? এসকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আপনাকে দেখতে হবে মুভিটা। মনে হতে পারে আমি অনেক কিছু বলে দিচ্ছি, কিন্তু ছবিটা দেখলে বুঝবেন আমি আসলে কিছুই বলিনি।
◘◘◘ মুভির ভালো লাগা আর খারাপ লাগা দিক নিয়ে কিছু বলতে চাই। শুরুতে ভালো লাগা দিক,
☺ প্রথমটি হল এর মিউজিক। আজ পর্যন্ত মুভিতে অন্যতম সেরা স্কোরের কথা বলতে গেলে অনেক মুভি বোদ্ধাই এই মুভির নাম উল্লেখ করেন। এর যথার্থ কারন আপনি অবশ্য মুভিটি দেখার সময়ই অনুভব করবেন। মুভির পরিচালক একবার ভিয়েনা সফরকালে এই মিউজিক শুনে পরে মুভিতে ব্যবহার করেছেন।
☺ ছবির সেট সম্পর্কে বলতে গেলে পরিচালক প্রায় নিখুঁতভাবেই সেট কে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, যা noir ফিল্মের জন্য প্রয়োজনীয়। আসলে Full Metal Jacket এর পরে যে সব ছবির সেট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা পেয়েছি মুভি দেখার সময়ই তাদের মধ্যে এই মুভিটা অন্যতম।
☺ এবার আসি ক্যামেরার কাজে। আমার মত নবিশ এখানে তেমন কিছুই বুঝি নাই। তবে যা দেখলাম তা হল, এখানে স্ট্রেট ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে কম। এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল (তুলনামূলক) কাত করা ক্যামেরার ব্যবহার। অনেক ক্ষেত্রেই শটের শুরুতে টিল্ট ক্যামেরা ব্যবহার করে পরে তাকে স্ট্রেইট করা হয়েছে। এতে করে শটের ব্যপ্তি বেড়েছে। লোকেশন ফোকাস করার জন্য বেশ কিছু oblique-angle, wide-angle লেন্সের কাজ দেখলাম আর মুগ্ধ হলাম। মুভিটা সাদাকালো বলে লাইটিং সম্পর্কে অতটা ধারনা করতে পারি নাই। তবে এর মধ্যেই যা দেখিয়েছে তাতে আমি অভিভূত। এখানে বেলুন বিক্রেতার একটি দৃশ্য আছে। লাইটিং দিয়ে তাকে একটা দানবের রুপ দেয়া হয়েছিল। সিমপ্লি অসাধারণ।
☺ একটি দৃশ্য দেখে আমার মনে হয়েছিল কোন সুপারহিরো মুভিতেও সম্ভবত এমন কারো এন্ট্রি দেখানো হয় না। নিঃসন্দেহে আমার দেখা অন্যতম সেরা এন্ট্রি এটা। একটি বিড়ালের ডাক, জোরে পায়ের আওয়াজ, উপরের জানালা থেকে বেড়িয়ে আসা এক চিলতে আলো, তার মধ্যে দেখা আধো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির ঠাট্টা আর বিস্ময়ে ভরা মুখ। যেকোনো সুপারহিরোর এন্ট্রিকে হার মানাবে অনায়াসে।
☺ প্রেমের কথাটা এখানে না উল্লেখ করলেই নয়। কোন ব্যাখ্যাতেই ফেলতে পারবেন না হলির সাথে তার বন্ধুর প্রেমিকার (অ্যানা) প্রেমকে। আর তাদের পরিণতি? এ নিয়ে কিছু বলব না। আকর্ষণ হয়ে থাকুক। এটুকু বলে রাখি, চমকাতেও পারেন।
☺ মুভিতে একটা চেজের দৃশ্য রয়েছে। চেজের দৃশ্যতে হয়ত টান টান উত্তেজনা খুঁজে পাবেন না। তবে এখানে আলো-ছায়ার আর ক্যামেরার কাজ দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলাম আমি।
☺ শেষ দৃশ্য। এটিও মনে থাকবে অনেকদিন। পরিচালকের কথা না শুনে সিনেমাটোগ্রাফার (Robert kresker) নাকি ক্যামেরা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। ধন্যবাদ আপনাকে। না হলে এমন একটা দৃশ্য কিভাবে পেতাম? এর আগে পরিচালক নিজে গল্প কিছু চেঞ্জ করেছিলেন শেষ দৃশ্যতে। কি চেঞ্জ তা বললে স্পয়লার হতে পারে। তবে এটা বলতে পারি পরিচালক আর সিনেমাটোগ্রাফার মিলে অন্যতম সেরা একটি ইন্ডিং সিকুয়েন্স তৈরি করেছেন।
☻ ছবির খারাপ লাগা দিক নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় প্রথম অর্ধেকের পরে ইচ্ছাকৃতভাবে ছবিকে টেনে বড় করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। একবার থলের বিড়াল বের হবার পর, শুধু সিনেমাটোগ্রাফি দিয়ে মুভি টেনে নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। এছাড়াও কিছু জিনিসের ব্যাখ্যাও ঠিক মত বুঝতে পারা যায়নি। আসলে দেখানোই হয়নি। প্রধানত নায়ককে ডেকে নিয়ে আসার কারন আমার বোধগম্য হয়নি। চেজের সিকুয়েন্সে আমরা সাধারণত যে টানটান উত্তেজনা দেখতে অভ্যস্ত তাও অনুপস্থিত ছিল। তবে এতে করে ছবিটি নিয়ে ভালো লাগা খুব একটা কমেনি।
◘◘◘ ছবি সম্পর্কে অনেক কথা হল। আমার অভিমত জানিয়ে দিলাম এর মধ্যেই। অনেকের হয়ত ছবিটি সেরা মুভি বলে মনে হবে না। যারা বিশেষ করে Noir পছন্দ করেন না, তাদের একটু স্লো মনে হতে পারে। তবে কাহিনীতে যথেষ্ট উত্তেজনা আর গতি আছে বলে আমার ব্যক্তিগত মতামত। আমার লেখা শেষ করব একটা ডায়লগ দিয়ে। মুভিতে এই ডায়লগটা আমার মারাত্মক রকমের ভাল লেগেছে- “In Italy for 30 years under the Borgias they had warfare, terror, murder and bloodshed, but they produced Michelangelo, Leonardo da Vinci and the Renaissance. In Switzerland they had brotherly love--they had 500 years of democracy and peace, and what did that produce? The cuckoo clock."
◘◘◘ ডাউনলোড লিঙ্কঃ
টরেন্ট ► http://goo.gl/0neRK
অথবা, ডিরেক্ট ► http://uptobox.com/x7nx14aiblxs
►►দেখার আমন্ত্রণ রইল◄◄