পর্ব-২
রুপমের কাছে জীবনের তাৎপর্যটা একটু অন্যরকম। ওর ধারনা, দুঃখই হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে আদিম ও মৌলিক অনুভুতি। পৃথিবীতে বসবাসের সূচনালগ্ন থেকেই এর সাথে মানুষের পরিচয়। সুখ ক্ষনস্থায়ী, দুঃখ সুদূরপ্রসারী। তাইতো সুখের স্মৃতি কখনও মলিন হয়ে গেলেও দুঃখের দিনগুলো মনের মনিকোঠায় ধ্রুবতারার মতো ভাস্বর হয়ে রয়। আর মানুষের এ দুঃখ প্রকাশের অন্যতম অভিব্যক্তি হল কান্না। পৃথিবীতে আবির্ভাবের প্রথম মুহুর্তেই যেন সে চিৎকার করে কান্নার মাধ্যমে জানিয়ে দেয়, “আমি এসে গেছি এবং সব সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত”। আমৃত্যু মানুষের এ সংগ্রাম চলতেই থাকে।
কান্নার কথা আসতেই অবধারিতভাবেই অশ্রুর প্রসঙ্গ চলে আসে। অশ্রু হল কান্নার দৃশ্যমান জলীয় অংশ। অশ্রুহীন কান্না কে অনেকে কুমিরের কান্নার সাথে তুলনা করে। রুপমের বিশ্বাস, অশ্রু হল মানুষের আবেগ প্রশমনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও কার্যকর উপায়। এটা কখনও নকল হয় না, এমনকি অভিনয়ের সময়েও না। গ্লিসারিন দিয়ে হলেও অশ্রুই বিসর্জন দিতে হয়, পানি দিয়ে অশ্রুকে রিপ্লেস করা যায় না। মানুষের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার অভিব্যক্তিতে ওতপ্রোতভাবে অশ্রু জড়িত। নিঃসঙ্গ একাকী জীবনেও অশ্রু সঙ্গী হয়ে ক্রমাগত বাঁচার প্রনোদনা দিয়ে যায়। রুপম অশ্রু খুব ভালবাসে, কারন এর সাথে ওর ছোটবেলা থেকেই সখ্যতা। আর তাইতো মেয়ের নামে অশ্রুকে ধরে রাখার তার এ প্রচেষ্টা।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রুপমের অবস্থান চতুর্থ। অভাব অনটনের সংসারে ওর বেড়ে ওঠা অনেকটা অনাদরেই। দারিদ্র্যের সংগে সংগ্রাম করতেই ওদের পরিবারের অধিকাংশ সময় পেরিয়ে গেছে, তাই আলাদা করে আদর, স্নেহ কিংবা ভালবাসা বলতে যা বুঝায় তার সংগে রুপমের শৈশব এবং বাল্যকাল পরিচিত হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলা একটু খেদ থাকলেও এখন সে বুঝতে পারে তার বাবা-মা’র আচরন কতটা যৌক্তিক ছিল। আসলে ভালবাসার প্রকাশ অবস্থান ও পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতেই পারে। দরিদ্র পিতা-মাতা যাদের সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অন্ন সংস্থানের চিন্তাই ব্যস্ত রাখতো, তাদের ভালবাসার প্রকাশ শাসন, বকুনি, অনাদরের মাধ্যমে উৎসরিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। শত অভাবের মধ্যেও রুপমের পড়াশোনা টা ঠিকই চালিয়ে নিয়ে গেছে তার পিতা-মাতা, এটা যে কত বড় ভালবাসার প্রস্ফুটন ছিল এখন বোঝে সে। ছোট্ট রুপম সে সময় বুঝত না, এখন বোঝে কিন্তু বর্তমানে তার বোধদয়ের অনেক উর্ধ্বে চলে গেছে তার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা।
সকালে রুপমের ঘুম ভাংলো অশ্রুর কান্নার শব্দে। ইদানীং অশ্রু খুব ভোরে জেগে উঠছে। বিছানায় শুয়ে থাকতে চায় না। কোলে নিয়ে হাটতে হয়।
“ফ্রেশ হয়ে এসে বাবুকে নিয়ে ব্যালকনিতে একটু হাটাহাটি করতো, আমি নাস্তা রেডি করি”- মেহজাবিনের ঘুমজড়ানো কন্ঠ শুনতে পেল রুপম।
“আমার সকাল বেলার পাখি উঠে গেছে তাহলে”- অশ্রুকে আদর করতে করতে বলল রুপম।
অশ্রুকে নিয়ে ব্যালকনিতে হাটছে রুপম। সকালের মিষ্টি রোদ আলতো ছোয়ায় বাবা-মেয়েকে স্নিগ্ধতার জানান দিচ্ছে। রান্নায় মগ্ন মেহজাবিন। এমন সময় ব্যলকনি থেকে রুপমের কন্ঠস্বার শোনা গেল।
“মেহজাবিন এদিকে এসো, দেখে যাও.. তাড়াতাড়ি”।
“কি হয়েছে? দাড়াও আসছি”-মেহজাবিন জবাব দিল।
“দেখ, দেখ আমার মেয়ে আমাকে বাবা বলে ডাকছে। এই প্রথম বাবা ডাক শুনলাম। আজ নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ মনে হচ্ছে”।- আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলল রুপম।
“কেন, এতদিন নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবতে না”।- মেহজাবিন হাসতে হাসতে বলে।
সত্যিই অশ্রু ওষ্ঠদ্বয় এক করে অস্ফুট আওয়াজে ‘বাঃ’ উচ্চারন করছে। যা ক্রমাগত উচ্চারনের ফলে ‘বাবা...বাবা’ শোনাচ্ছে। আসলে মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো সেই সব আওয়াজ, স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ, অনুভব পেতে চায় যার জন্য সে অন্তর থেকে আকাঙ্ক্ষা পোষন করে।
অন্যরকম অনুভুতিতে শিহরিত রুপম আবেগ ধরে রাখতে পারে না। অশ্রুকে আদর করতে করতে খুশিতে কপোল বেয়ে দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে যায়।
--- (চলবে)