লাবিবের কাণ্ডকীর্তি
ছেলেমেয়েদের নিয়ে লেখা হয় না অনেকদিন। প্রতিদিন ওরা কতো কিছু করে, ঘটায় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেগুলো খুব রসাত্মক ও উপভোগ্য; আমাদেরকে সারাক্ষণ আনন্দমুখর ও প্রাণবন্ত রাখার জন্য তার ভূমিকা অনন্য। কিন্তু সব সময় তা লিখে রাখা যায় না।
তবে আজকের ঘটনাটা না লিখে পারছি না।
লাবিবের মা আমসত্ত্ব বানিয়ে রোদে শুকোচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। আমাদের ডুপ্লেক্সের ছাদে প্রতিদিনই ওগুলোকে শুকোতে দেখি- দুটি চালুনির উপর থরে থরে খুব সুন্দর করে টুকরোগুলো সাজিয়ে রাখা হয়; ইষৎ বাদামি রঙের অতিশয় লোভনীয় টুকরোগুলো দেখলেই জিভের ডগায় পানি জমে, কিন্তু হাত বাড়িয়ে এক টুকরো মুখে নেব তা আর হয়ে ওঠে না, ব্যস্ততার জন্য। ও হ্যাঁ, একদিন একটা টুকরো তুলে মুখে নিয়ে গিলেছিলাম, তবে যতোখানি দর্শনধারী, গুণবিচারের পর ততোখানি উৎরে যেতে পারে নি, এটা ঠিক।
বিকেলের দিকে পাইলট, ঐশী আর ওর মা ঘুমোচ্ছিল; আমি আমার কাজে মহাব্যস্ত- ব্লগিংয়ে। আর লাবিব?
লাবিব! আমাদের লাবিব! লাবিব... কোথায় তুমি আব্বু?
আমি ডাকতে থাকি সোফায় বসেই। কিন্তু লাবিবের কোনো সাড়াশব্দ নেই।
ডুপ্লেক্সের দোতলায় তিনটি রুম। একটাতে পাইলট, আরেকটাতে ঐশী, অপরটায় আমরা তিনজন থাকি। নিচতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে সামনে ও ডানে ঐ রুম তিনটি, আর বাম দিকে দরজা পেরোলেই একট টুকরো মনোরম উঠোন- এ আমাদের ছাদ- বিকেলে চেয়ার টেনে বসি, রাতে পারিবারিক আড্ডা- কখনো বারবিকিউ। আর এই ছাদটুকু হলো লাবিবের খেলার মাঠ। তাকে পাওয়া যায় নিচতলার দোলনায়, ল্যাপটপে টম এন্ড জেরির সামনে, টিভির সামনে, পাইলট আর ঐশীর সাথে ঝগড়া-ঝাটিতে; আর অন্য কোথাও না পাওয়া গেলে নির্ঘাত লাবিবকে পাওয়া যাবে তার ফুটবল, গাড়ি, ক্রিকেট, যাবতীয় খেলনা-অখেলনা সহ এই ছাদে।
লাবিবকে ডাকতে ডাকতে ছাদের দিকে যেতেই দেখি সে এগিয়ে আসছে রুমের দিকে। আমাকে দেখে তার স্বভাবসুলভ মিষ্টি করে হেসে দিয়ে লাবিব আহ্লাদি স্বরে টেনে টেনে বলে- আমি এইখানে!
তুমি একা একা ছাদে কী করছিলে?
আচার খাচ্ছিলাম।
আচার! বুঝলাম সে আসলে আমসত্ত্ব খাচ্ছিল।
ওর সাথে টুকিটাকি কথা বলতে বলতে আমসত্ত্বের চালুনির কাছে এসে দেখি একটা চালুনিতে মাত্র তিন টুকরো আমসত্ত্ব পড়ে আছে, বাকিগুলো লাবিব সাবাড় করেছে।
লাবিব ওর প্রধান খাদ্য 'খিচুড়ি' খেতে খুব বাহানা করে, সেই লাবিব এতোগুলো আমসত্ত্ব খেয়েছে দেখে অবাক হলাম- ওর বোধ হয় টক জিনিস খুব পছন্দ। আমি আরেক টুকরো আমসত্ত্ব খেয়ে লাবিবকে কোলে নিয়ে রুমে এসে ব্লগিংয়ে বসে পড়ি।
সন্ধ্যার কিছু আগে। আমি টিভি দেখছি। লাবিবের মা খুব উত্তেজিত স্বরে আমাকে ডাকছে ছাদে যেতে।
এই, জলদি আসো, দেইখা যাও তোমার আল্লাদের পুত্র কী করছে।
আমি দেখছি, ও তোমার আমসত্ত্ব খেয়ে অর্ধেক করে ফেলছে।
আসছো না কেন? তোমাকে তো আমি এখানে আসতে বলছি।
আসতে পারবো না। ব্যস্ত আছি।
টেংরি ভাঙবো কিন্তু বাপবেটা দুজনের।
যাবো না যাবো না করেও উঠে গেলাম। ছাদে গিয়ে দেখি ঐশী মিটমিট করে হাসছে, ওদের মা খড়্গ হাতে লাবিবকে শাসাচ্ছে আর লাবিবের হাতের মুঠিতে কী যেন দলা পাকানো।
চাইয়া দেখো কী করছে। ওর মা বলে।
আমি চেয়ে দেখি, লাবিবের চারপাশে আমসত্ত্বের টুকরোগুলো ছড়িয়ে আছে, ওর হাতের মুঠিতে কিছু আমসত্ত্ব দলা পাকানো।
কী হয়েছে? জিজ্ঞাসা করি।
সে আমসত্ত্ব দিয়া খেলছে। আমার আসার আওয়াজ পাইয়া তাড়াতাড়ি কইরা টুকাইয়া জানালা দিয়া বাইরে ফেলতেছিল, যাতে ধরতে না পারি।
লাবিব কিটকিটিয়ে হেসে ঝাঁপ দিয়ে আমার কোলের উপর পড়ে। আমি লাবিবকে বুকের মধ্যে লেপ্টে ধরে বলি, খুব ভালো করেছো আব্বু, বাকিগুলোও এভাবে ফেলে দিও, কেমন?
হুম, তোমার লাই পাইয়াই পুলাডা এত্তো আল্লাদী হইয়া গেছে। আমার এতো সুন্দর আমসত্ত্ব!!!
আমি আর লাবিব টিভিরুমে চলে আসি।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার আছে। এসব কৃতকর্মের শাস্তি স্বরূপ ওর মা ওকে বেধরক পিটুনি দিয়ে থাকে। কিন্তু সেদিন সে এতোই অবাক হয়ে গিয়েছিল যে লাবিবকে পিটুনি দেয়ার কথা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল।
তারপরের দিনের কথা।
বাসার উত্তর দিকের চত্বরে একটা শুকনো চৌবাচ্চা আছে। আমি পা দুলিয়ে চৌবাচ্চার ওয়ালে বসে হাবিজাবি ভাবছিলাম। দেখি দোতলার দরজা ডিঙিয়ে লাবিব ছাদে ঢুকলো। আলগোছে আমসত্ত্বের চালুনির কাছে গেলো। খুব সতর্ক ভাবে নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে তুললো। এমন সময়ে নিচতলা থেকে আমি ডেকে উঠি- লাবিব!
লাবিব চমকে আমার দিকে তাকায় আর মিষ্টি করে হেসে দিয়ে বলে- কিছু করি না।
তোমার হাতে কী?
কিছু না।
আমসত্ত্ব?
কিছু না।