somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সত্যাগ্রহ -(পর্ব-১)

২১ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“আলো আর অন্ধকার এক হতে পারে কি” ??
[কুরআন ১৩:৬]

সকালের শুরুতেই যখন উদ্ভাসিত আলোকরশ্মি চোখে পড়ে। ঠিক তখনই প্রতিভাত হয় এই জীবন্ত ধরণীর এক অপূর্ব লাবণ্যময়তা। অনুভূত হয় আলোকিত এই জাগতিকতার বাহ্যিক অস্তিত্বের সুশোভিত রূপ। বস্তুজগতের আলো আঁধারের এই অদ্ভুত খেলা বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী সবার দৃষ্টিতেই নয়নপ্রিতীকরই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু বস্তুজগতের এই আলো-আঁধারের নেপথ্যে সৃষ্টিজগতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত বুদ্ধিমান সত্ত্বাদের মনস্তাত্বিক জগতে যখন কালযুগ অনুপ্রবেশ করে; তখন আল-আধারের এই বুস্তুগত শোভাকে আর অর্থপূর্ণ মনে হয়না......বরং দন্দ সৃষ্টি হয়!!

এই সর্বনাশী কালযুগে যখন সত্য-মিথ্যার মিশ্রিত রূপরেখা প্রকৃত বাস্তবতার স্বরুপকেও দুঃখজনকভাবে আপেক্ষিক করে তোলে, ঠিক তখনই অনুসন্ধান করতে হয়, সত্যের অধিক নিকটতর পথ। ঠিক যেমনটি একটি জনপ্রিয় কিতাবে বলা হয়েছে-“তোমার প্রতিপালকই জানেন কে সত্যের অধিক নিকটতর পথে আছেন (আল-কুরআন)।”

অজ্ঞানতার এই শেষযুগে এটি মূলত-অন্ধকারের শক্তির এ এক বিরাট পরিকল্পনা।অস্বীকার করাবার উপায় নেই যে আলোর চেয়ে অন্ধকারই মানুষের নিকটে অতিশয় সহসায় অতিপ্রিয় হয়ে উঠে। অন্ধকারের মোহাচ্ছন্ন টানে একাত্মতা ঘোষণা করা অনেক বেশী সহজতর বলে। প্রত্যেক যুগেরই একটি নিদৃষ্ট স্তরে পৌঁছানোর পরই যখন এই অন্ধকারপ্রিয়তা সার্বজনীনভাবে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। ঠিক তখনই সত্য হাজারও মিথ্যার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়; কারারুদ্ধ হয়!! প্রতিবাদী সত্যাশ্রয়ীদের তখন হাসির খোরাকে পরিনত হতে হয়। মিথ্যের কারাগারে আবদ্ধ হয়ে সত্য নীরবে ক্রন্দন করতে থাকে যুগ যুগ ধরে আলোর নির্বাসনে!! মুক্তির আশায় ; স্বাধীনতার প্রত্যাশায়!!
আর এভাবেই জন্ম নেয় আরও একবার সেই মহান বিপ্লবের!! এক একটি সত্যাগ্রহের!!

ইতিহাসে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বহুবার ঘটেছে।যদিও উদ্দেশ্য মহৎ, তথাপিও সত্যাশ্রয়ীদের এই মহান বিপ্লব যদি অন্তসারশুন্য পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে সংগঠিত হয়, ঠিক তখনই এতসব মহৎ উদ্দেশ্যও আলোর বিহনে দিশেহারা হয়ে রয়।মতোবিরোধ ও বিচ্ছিন্নতার জন্মদাতা হল কুসংস্কার। আর এই কুসংস্কার এমন এক বিষ, যার একটি মাত্র বিন্দুই এক পেয়ালা বিশুদ্ধ জলকে বিষাক্ত করে তোলে। আর পাত্র থেকে সেটাই বের হয়-যা তাতে জমা থাকে। এই এক বিন্দু ভ্রান্তিময়তাই প্রকৃত সত্যকে মাথা তুলে দাঁড়াবার অনুমতি প্রদান করেনা। কারন, বিশুদ্ধতা কখনও কুসংস্কারকে সমর্থন করেনা।“সত্য ও মিথ্যা কখনই এক হতে পারেনা ’’-[কুরআন]। আর এই কাল যুগের সবচেয়ে বড় নিদর্শন হল শতভাগে বিভক্ত নিজ নিজ মূল্যবোধ ও ধ্যান ধারনাকে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করা। এক কথায়-’আমি যা জানি সেটাই ঠিক-আর বাদ বাকি সবাই ভ্রান্তিময়তায় নিমজ্জিত।’ আর এই কারনেই আমাদের উচিৎ নিজেদের কুসংস্কার সম্বন্ধে আরও বিশুদ্ধ ধারণা লাভ করা । আরও উদার ও মুক্তভাবে চিন্তা করা।পূর্বপুরুষদের চাপানো ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন করে ভাবা। নতুন সময়ের দাবীকে পুরনো মতাদর্শের আলোয় কি ভাবে ক্ষান্ত করা যায় সেই বিজ্ঞতা ও যোগ্যতা লাভ করা।
"যারা বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করে কাজ করে না তিনি তাদের উপর অকল্যান চাপিয়ে দেন। (সূরা ইউনূসঃ ১০০) । নিশ্চই আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জন্তু হচ্ছে সে সকল বধির বোবা লোক যারা বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগায় না। (সূরা আনফালঃ ২২)

মানুষের মৌলিক চাহিদা চিরন্তন। তবে পরিবৃত্তিও পরিবর্তনের এভুলেশনকে যদি আমরা বুঝতে সক্ষম না হই তবে-এই এভুলেশন কখনই রেভুলেশনের রুপ পরিগ্রাহ করবেনা। তা অসম্ভব। ইতিহাসে এমন একটি দৃষ্টান্তও নেই। এমনকি ইসলামি ইতিহাসেও নেই।আমরা ততক্ষননা একটি মূল্যবোধকে আক্রমণ করবার যোগ্যতা রাখিনা-যতক্ষননা আমরা নিজেদের মূল্যবোধের মহিমা অপরাপর মূল্যবোধ অপেক্ষা বেশি উন্নতশীল ধারায় উপস্থাপন করতে সক্ষম না হই।সময়ের দাবীতে এর রুপ পরিবর্তন হলেও সংজ্ঞা অপরিবর্তনীয়।আরবরা এটা বুঝতে পেরেছিল বলেই তারা এই বিপ্লব সৃষ্টি করতে সফল হয়েছিল। অন্ধকার সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম না হলে; সমাজ আলোকিত করবার স্বপ্ন দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে। সত্যের শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ তখনই মানুষকে উপভোগ করানো সম্ভব; যখন মিথ্যা সম্বন্ধে আমারা যথেষ্ট জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হই।"জাহেলিয়াতের প্রকৃতি অনুধাবন করতে না পারলে, ইসলামের বন্ধনী একে একে খুলে যেতে থাকবে"-উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)।

কুরআন এমন কোন জাদুকরী বানীর সমষ্টি ছিলনা যে আরবরা তার বানী শ্রবণ করা মাত্র যাদুগ্রস্থ বা সম্মোহিত হয়ে ইমান গ্রহন করেছিল। কুরআন নিজেই এই দাবী খারিজ করে দিয়েছে। প্রকৃত কথা এই যে তারা কুরআনের প্রস্তাবনা ও জাহেলিয়াতের পার্থক্য অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিল। দুর্বলচিত্তরা ভাবতে ভালোবাসেন যে একতা অর্জনের জন্য বিতর্কিত তথা মতোবিরোধপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়াই মঙ্গলজনক। অত্যন্ত দুঃখিত যে আমাদের অন্তর এমনতর ধারণার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে। মিথ্যাকে চাপা দিয়ে কখনই সত্য কায়েম সম্ভব নয়, মিথ্যাগুলো যতই ঠুনকো হোকনা কেন। সত্য কায়েম করবার এক চিরন্তন নীতি হল মিথ্যাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা। গড়তে হলে ভাঙতে হবে। এটাই প্রকৃতির ধর্ম।এটাই প্রকৃতির মানহাজ। এই কারনেই কুরআনে বলা হয়েছে-“আমি সত্য দ্বারা মিথ্যাকে আঘাত করি ফলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।”
অন্ধকারের পালা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেমন আলো দর্শন সম্ভব না। ঠিক তেমনি মিথ্যার দেয়াল বিচূর্ণ না করলে, সত্যের ভীত গড়া সম্ভব না।যেমনটি আমরা বলেছি এক গ্লাস বিশুদ্ধ জলকে বিষাক্ত করবার জন্য এক ফোঁটা বিষই যথেষ্ট। আমাদের বিশ্বাস-পৃথিবীতে মানবজাতির এমন কোন মতোবিরোধ বা সমস্যা নেই, যার তার সমাধান আল-কোরআনে বিদ্যমান নেই। “তারা তোমার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করেনা; যার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে প্রদান করেনি ( ২৫:৩৩)।”কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনই যখন সমস্যার সমাধান খুঁজতে পূর্বপুরুষের বন্ধ্যা ধ্যান-ধারণার কূটতর্কের জঞ্জালের নিচে আমরা চাপা পড়ে যাই।

"মানব সভ্যতার রাজনৈতিক ইতিহাস"

প্রাচীন মানব সভ্যতার ইতিহাসে দৃকপাত করলে দেখা যায়, সামাজ জীবনের অনিয়ম ঠ্যাকাতে ধর্মীয় বিধি-নিষেধের অনুশাসনই মানব জাতির নিকট জনপ্রিয় ছিলো। নবোপলিও, পুরোপোলিও যুগ থেকে শুরু করে গ্রীক, হিব্রু, মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলন, মিশরীয়, পার্সিয়ান, মায়ান কিংবা প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতাই যুগে যগে সামাজিক ন্যায়নীতি সমুন্নত রাখতে ধর্মের প্রতিই বেশি আস্থাশীল ছিল। বহু প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলো ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেই এর অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ যা আজও বিদ্যমান। এমনকি অনেক আধুনিক নৃবিজ্ঞানীগণ(Anthropologist) আজ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে যে, আদিম নিয়ানর্ডারথাল মানুষের জীবন প্রণালিতেও ধর্মীয় অনুভূতি বিদ্যমান ছিল। তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায় ধর্ম একটি অতি প্রাচীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। ধর্ম কিছু অনস্বীকার্য নীতিমালা ও অবিচ্ছেদ্য আইন-কানুনের প্রাচীন নাম যা সৃষ্টিলগ্ন সূচনা থেকেই এই মহাবিশ্বকে শাসন করে চলেছে এক অতিশয় শাশ্বত ও নিয়মতান্ত্রিক চরিত্রে। শুধু বস্তুজগতই নয় বরং এর মধ্যে লালিত-পালিত প্রাণী জগত ও বুদ্ধিমান সত্ত্বাদের জৈবিক যান্ত্রিকতাও ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এমনকি আজকের চরম উৎকর্ষতার জেনেটিক বিজ্ঞানও ধর্মের আদিম চরিত্রের বুদ্ধিমত্তার সাক্ষরকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে অতিসয় অভিভূত ও আনন্দচিত্তে। সচেতনতায় কিছুটা অগ্রগামী হোক কিংবা অজ্ঞাতেই হোক, বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের অতিশয় ক্ষুদ্রতম কোয়ার্ক সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে নিউক্লীয় বল, সোলার সিস্টেম ও গ্যালাক্সিদের স্বতঃস্ফূর্ত নিয়মতান্ত্রিক চরিত্রে বস্তুজগতের প্রতিটি অভিনেতাকে আমরা নিষ্ঠার সাথে কিছু ধর্মীয় বিধিবিধানের আনুগত্য পালন করতে দেখি। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হল-প্রকর্ষতার এতো উচ্চতর স্তরে উন্নীত হবার পরই যেখানে কেবলমাত্র আমরা বুস্তুজগতের এই নিরবিছিন্ন ও স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মীয় আনুগত্যের আবেগ, যা আমরা সবেমাত্র উপলব্ধি করতে শুরু করেছি এমন ধারনাও আজকের বিজ্ঞান মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে শুরু করেছে।যদিও যে সকল উন্নত প্রযুক্তিগত ফলাফলের কল্যাণেই যা আজ জানা সম্ভবপর হয়েছে মানব সভ্যতার প্রাচীন কালে তো এমনতর প্রযুক্তিগত প্রকর্ষতা বিদ্যমান ছিল না। স্যাটেলাইট স্ক্যান কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক কোন নিদর্শনে এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়না। ঠিক এই জায়গাটিতেই অনেক বিস্ময়কর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়! তবে কি করে অতীতের মনোবিজ্ঞানীগণ কিংবা চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীরা প্রাকৃতির নেপথ্যের এই স্পন্ধন ও নিয়মের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল? আর কেনই বা তারা বারবার প্রকৃতিক নিয়মের এই সুফলকে তাদের স্বাধীন জীবন ব্যবস্থাতেও আরোপ করতে চেয়েছিল ?

ধর্ম অর্থ কি ?–রীতিনীতি, আইন বা বিধান, নীতি-মালা।এই ধর্ম শব্দটি আমরা পদার্থবিজ্ঞানের low বা আইনসমূহকে বোঝাতেও ব্যবহার করে থাকি। যে ব্যক্তি স্রষ্টাপ্রদত্ত ধর্মগ্রন্থের আইন-বিধান, নীতিমালা মেনে চলে সেই ধার্মিক। রাষ্ট্রের সংবিধান অস্বীকার করলে যেমন একজন নাগরিক রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়।ঠিক তেমনি ঐশী বিধান অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করলেও একজন স্রষ্টাদ্রোহী হিসেবে পরিগনিত হয়। হোক সে ব্যক্তি বা সমাজ বা রাষ্ট্রযন্ত্রে। স্রষ্টার প্রদত্ত ধর্মীয় বিধান প্রত্যাখ্যান করলে বা লঙ্ঘন করলে যেমন একজন ব্যক্তিকে ধার্মিক বলা যায় না ঠিক অনুরুপভাবে কোন রাষ্ট্রযন্ত্র যদি স্রষ্টা প্রদত্ত বিধি-বিধান অনুসারে পরিচালিত না হয় তবে সেই রাষ্ট্রকেও রাষ্ট্রধর্মের সাথে যোগ করা যায়না। কোন শাসক যদি আল্লাহ্‌ প্রদত্ত ধর্মগ্রন্থের দিকনির্দেশনা ও বিধি-বিধান অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে অস্বীকার করে তবে সেই শাসকগোষ্ঠীও আল্লাহ্‌দ্রোহী হিসেবে পরিগনিত হয়, ঠিক যেমনি একজন নাগরিক রাষ্ট্রের সংবিধান অস্বীকার করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী পরিগনিত করা হয়।এবং প্রতিটি ঐশীগ্রন্থেই এইসব আল্লাহ্‌দ্রোহী (তাগুত) ব্যক্তিবর্গ বা শাসকের আনুগত্য পালনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশকে তখনই ইসলামী রাস্ত্রে বলা যেত, যদি এদেশের আইন-বিচার-শাসন আল্লাহ্‌ প্রদত্ত ধর্মীয় আইন-বিধান অনুসারে পরিচালিত হত।তাহলে আমরা বুঝলাম ধর্ম অর্থ আইন-বিধান বা নীতিমালা। এই কারণে বিজ্ঞানমহলও ধর্ম শব্দটি ব্যাবহার করে থাকে বস্তুজগতের আইন বা Low বোঝাতে।বস্তুজগতের পরতে পরতে কিছু প্রাকৃতিক আইন প্রোথিত রয়েছে যা তারা মেনে চলে। যদি বস্তুজগত সেইসব প্রাকৃতিক আইন লঙ্ঘন করে তবে তার ধ্বংস অনিবার্য। প্রকৃতিজগতের এইসব প্রাকৃতিক আইনসমূহ যেমন-নিউক্লিয় বল, মধ্যাকর্ষণ শক্তি, আন্তঃআণবিক বল, তড়িৎ চম্বুকিয় বল, এন্টিমিউট্রাজেনেটিক আমব্রেলা, বায়ুমণ্ডলের স্তরসমুহে প্রভৃতিতে যেসব প্রাকৃতিক আইন প্রোথিত রয়েছে সেইসব আইনের আনুগত্য পালনে তারা বাধ্য।এক্ষেত্রে বস্তুজগত তথা পদার্থ জগতকের সবাইকে খুব ধার্মিক বলেই মনে হয়। যেমন পৃথিবী র ঘুর্নণ ও তার স্বীয় কক্ষপথে পরিভ্রমণ করবার আরোপিত যে আহ্নিক গতি ও বার্ষিকগতির যে ধর্মের তথা আইনের আনুগত্যে তাদের প্রতিনিয়ত আমরা প্রতিশ্রুতিশীল দেখতে পাই সেই কারণেই আজ আমারা এক সুশৃঙ্খল জীবন পরিবেশে বেঁচে আছি।এক্ষেত্রে পৃথিবী নিরলস ভাবে তার প্রতি আরোপিত নিয়মের আনুগত্য পালন করছে, যার সামান্যতম সীমালঙ্ঘনেই পৃথিবী আমাদের জন্যে বয়ে আনতে পারে চিরধ্বংস। বস্তুজগতের মাঝে প্রথিত এমন হাজারও নিয়মের আনুগত্যে মহাবিশ্ব অবিচল। ঠিক এই কথাটিই পবিত্র কুরানে প্রভু বলেছেন- “তোমরা কি চাও আল্লাহ্‌র বিধান ছাড়া অন্য কারও বিধান, অথচ মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর সব কিছুই ইচ্ছা কিনবা অনিচ্ছায় একমাত্র তারই প্রতি অনুগত হয়ে তারই বিধানে আনুগত্যশীল (৩:৮৩)।” এই বিষয়টির যৌক্তিকতা কুরআনে ধ্বনিত হয়েছে-“ তোমরা সেই প্রকৃতির অনুসরণ করো, যেভাবে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। এটাই যৌক্তিক আনুগত্যের বিধান।(সূরা রোম:৩০)”

ভাবতেই বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয় যে-ধর্মীয় অনুশাসনে লালিত-পালিত হয়ে সৃষ্ট প্রকৃতিজগত যেভাবে সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন উপভোগ করে ঠিক তেমনিভাবে সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রকৃতি তত্ত্বের এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বজ্ঞান প্রাচীন মানব সভ্যতা কিভাবে অর্জন করেছিলো?

অনিয়ম এড়ানোর এই তত্ত্বজ্ঞান কি তাদের প্রাত্যাহিক জীবনের অতীত অভিজ্ঞতার ফসল নাকি কোন অতিপ্রাকিতিক প্রেরণা ?

আধুনিক এন্সিয়েন্ট আসট্রোনোটদের মতে- প্রাচীন মানব সভ্যতার সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি ঐশীপ্রেরণার বার্তাসমুহই অবতীর্ণ হয়েছিলো কোন বহির্জাগতিক উৎস হতে।যদি তাই হয় তবে সেই মহাজাগতিক স্বত্বাকে হতে হবে এক ও অদ্বিতীয়। কারন চলতি মহাবিশ্বকে আমরা যে একক বিধান ও নিয়মের শৃঙ্খলায় পরিচালিত হতে দেখি তাতে একটি একক সুপরিকল্পনাকারী সত্ত্বার সাক্ষরই পরিস্ফুটিত হয়।কারণ বহু স্রষ্টার ধারণা সত্য হলে বস্তুজগতের অতি ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে এই বিশাল বিশ্বজগতে এমন একক সিস্টেম প্রতীয়মান হবার কথা নয়। এখানে বিশৃঙ্খলায় কাম্য। বহু স্রষ্টার আইন-কানুন এক রকম হবার কথা হয়। তাছাড়া একাধিক ঈশ্বরকে তাদের নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তারে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেও দেখা যায়না।

প্রক্ষান্তরে প্রকৃতিক দুর্যোগ রোধ করতে সূর্য-চন্দ্র কিংবা অগ্নি উপাসনার ধারনাও বিজ্ঞানের এই যুগে হাস্যকর হিসেবে পরিগনিত হয়। প্রকৃতির ভয়ানক দানবিকতাকে প্রসন্ন করতে প্রকৃতিকেই স্রষ্টার আসনে আসীন করে প্রকৃতি-পূজার প্রয়াস নিরেট অজ্ঞানতারই নামাত্তর । মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদী মননশীলতার অধিকারী চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীদের নিকটে প্রকৃতিকে শান্ত করবার এমন অদ্ভুত ধারণা ও নীতিমালা কখনই যুক্তিপূর্ণ কিংবা অর্থপূর্ণ মনে হবার কথা নয়।কারন প্রকৃতি নিজেই একটি সৃষ্টি। সৃষ্টি হয়ে সৃষ্টির আরাধনা বিজ্ঞানসম্মত নয়। বিজ্ঞান বহু স্রষ্টার ধারনা যেমন সমর্থন করেনা, ঠিক তেমনি পৃথিবী সমতল, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র, বাইবেলের ঈশ্বরের এমন অদ্ভুত দাবীকেও বিজ্ঞান সমর্থন করেনা। যেই ঈশ্বর এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন সেই ঈশ্বরই যদি বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে অজ্ঞাত হন, এমন ঈশ্বরকে বিজ্ঞান অনুমোদন দেবার কথা নয়। তাই বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এই কালে আমাদের এমন কোন ঐশ্বরিক গ্রন্থ খুঁজে বের করা আবশ্যক যেই গ্রন্থ বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ । যেই গ্রন্থের প্রভু মহাবিশ্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। এ মনটা খুবই স্বাভাবিক যে পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থ গুলো তাদের শতশত বছরের যাত্রায় ক্রমশ কিছু স্বার্থবাদী সম্প্রদায়ের দ্বারা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিকৃত হয়েছে।ধর্ম গ্রন্থগুলোর অনুসারীদের তাদের নিজ নিজ ঈশ্বর সম্বন্দে পরস্পর বিরোধী ধারণা ও আচরণেই তা স্পষ্টরুপে প্রতিভাত হয়।ধর্মগুরুদের যেসব স্বৈরাচারী আচরণের ইতিহাসই এর সাক্ষ্য দেয়। বেদের ব্রাহ্মণগণ কিংবা ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মযাজক বা পাদ্রীগণ তাদের অনুসারীদের যুগ যুগ ধরে যেভাবে অজ্ঞানতার মধ্যে রেখেছে ও তাদের স্বীয় স্বার্থকে সফল করতে ধর্মের লাইসেন্স ব্যবহার সমাজের উপর যে শোষণনীতি প্রয়োগ করেছে ইতিহাসে এর অধ্যায় খুবই হৃদয়বিদারক ও বিশ্বাসীদের নিকট কলঙ্কজনক। সর্বশেষ ঐশী কিতাব কুরানের ক্ষেত্রে এমনটা না হবার কারণ একটাই যে, কুরআনে বানী সংরক্ষিত করা হয়েছিল খুবই ন্যায় পরায়ণ শাসকদের যুগে। ১৫০০ বছর ধরে এর প্রতিটি শব্দ খুবিই সংরক্ষিত করা হয়েছে অতিশয় সুনিপুণ যোগ্যতায়। তাছাড়া প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বের আরবি ব্যাকরণ ও ভাষাজ্ঞান আজও আমরা বিস্মৃত হইনি। আর এ কারনেই কুরআনে কোন অসঙ্গতি কিংবা বৈজ্ঞানিক ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়না বরং কুরআনকে আমরা বরাবরই বিজ্ঞানে ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগামী হিসেবে আবিস্কার করি। স্রষ্টা প্রেরিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কিংবা তথ্য সৃষ্টিজগতের অর্জিত জ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী হবে, আমাদের সমাজ বিজ্ঞানকে সঠিক পথনির্দেশ দান করবে, এটাইতো স্বাভাবিক। প্রকর্ষতার এই স্তরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে আজ যে আমরা সবচেয়ে উচ্চতর পর্যায়ে প্রবেশ করেছি, এতে কোন সন্দেহ নেই। আজ আমরা মিনিটের মধ্যেই পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আকাশে উড়ে পৃথিবীর এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমন করতে পারি, আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়ে ঘোড়াগাড়ির বাহনে যেখানে সময় লাগত মাসের পর মাস। সুদূর ভবিষ্যতে হয়তোবা আমরা আমাদের সোলার সিস্টেমের সীমানা জয় করতে সক্ষম হলেও হতে পারি। হয়তবা একদিন আমাদের আজকের স্বাপ্নিক ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে অন্য জগতে প্রবেশ করতে পারি। ডিজিটাল ফিজিক্স, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ান্ট্রাম মাকানিক্স সহ বিজ্ঞানের প্রতিটি বিভাগেই আমরা যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছি মাত্র ১০০বছরের বাবধানে যা ভাবতেই বিস্ময়ে অভিভুত হতে হয়।কিন্তু এতো সাফল্যের মাঝেও।বিজ্ঞানের দুটি বিভাগে আমরা চরম সেকেলেই রয়ে গেছি । আর তা হোল মনবিজ্ঞান ও সমাজ তথা রাষ্ট্র বিজ্ঞান।বিজ্ঞান আমাদের অন্ধকার ঘরকে আলোকিত করবার জন্য বৈদ্যুতিক বাল্প উপহার দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু আজকের বিজ্ঞান কি আমাদের মানুষিক অসুস্ততা দূর করতে পেরেছে? দুর্নীতি, চুরি, হত্যা, রাহাজাহি, ধর্ষণের মত মানুষিক বিকৃতি ও সামাজিক নৈরাজ্যতা কি আমাদের বিজ্ঞান প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্মূল করতে পেরেছে ?

উত্তর হল–না।বরং সমাজের অনিয়মকে আমরা দিন দিন বর্ধিত হতে দেখছি আরও নতুন নতুন রূপরেখায়। এই একটি বিষয়েই আমাদের পূর্বপুরুষগণের সেকেলে দর্শনই যেন আজ আধুনা বলেই মনে হয়। আর এই কারনেই সমাজের অনিয়ম ঠ্যাকাতে আমারা আবারও সেই সেকেলে ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি।যেহেতু কুরআনই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও অগ্রগামী। তাই অনিয়ম প্রতিরোধের বিচারে আমরা কুরআনের দর্শনকেই মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করব। যেহেতু পবিত্র কুরানে বলা হয়েছে–“এই কুরান বিজ্ঞানময়।”তাই বিজ্ঞানময় এই যুগে বিজ্ঞান্ময় ধর্মগ্রন্থই গ্রহন করাই অধিক যুক্তিপূর্ণ হবে।
আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি প্রাচিন মানব সভ্যতার ইতিহাসে রাজনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি ও চেতনার মানদণ্ডই ছিল ঐশীবিধান তথা ধর্ম। হোক সেই ধর্ম বিশ্বাস একত্ববাদ কিংবা বহুত্ববাদ।তবে ওইসব রাজতন্ত্র পরিচালিত হতো প্রধানত তিনভাবে। ১) থিওক্রেসি ২) দেবত্ববাদ ৩) স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র।

থিওক্রেসি

থিওক্রেসি অর্থ হল- স্রষ্টার শাসন।অক্সপোর্ড ডিকশনারির সংজ্ঞা অনুসারে-“থিওক্রেসি এমন এক সরকার কে বোঝায় যেখানে আল্লাহকেই শাসনকর্তা হিসেবে গণ্য করা হয়”

রাইডার স্মিথ থিওক্রেসির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন-“একটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে তখনই থিওক্রেসি বলা যাবে যখন সেই রাষ্ট্র গড বা ঈশ্বরের দ্বারা শাসিত হবে।”

আর ফ্লেভিয়াস জোসেফাস মধ্যযুগীয় থিওক্রেসি সম্বন্ধে বলেন-“আচার-ব্যবহার ও আইন-কানুন সম্বন্ধে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে বিস্তর প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। এগুলো বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা যেতে পারে- কোন কোন আইনবেত্তা (কর্তৃক) রাজতান্ত্রিক শাসন, কোনটা সঙ্কীর্ণ দলগত/জাতিগত কর্তৃত্ব-কেউ কেউ এটাকে গনতান্ত্রিক সরকার বলেও অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু মাসেঞ্জার মোজেস (মুসা-আঃ)-আমাদের সরকারকে ঈশ্বরের সরকার বা থিওক্রেসি বলে সাব্যস্ত করেছেন। মুসা (আঃ)সমগ্র ইহুদী জাতিকে এমনভাবে উদ্ভুদ্ধ করেছিলেন-যাতে তারা আল্লাহ্‌কেই সার্বভৌম মালিক মনে করে।এই কারণে ফ্লেভিয়াস আরবের (ইসলামের) শাসনতন্ত্রেকেও থিওক্রেসি তথা আল্লাহ্‌র শাসনতন্ত্র হিসেবে গণ্য করেছেন।

তবে আমার মতে-ইসলামের দৃষ্টি ভঙ্গিতে থিওক্রেসির সবচেয়ে সরল ও যথার্থ সংজ্ঞা পবিত্র কুরআনের ৭:৫৪ আয়াতে দেয়া আছে-“সৃষ্টি যার আইন-শাসনও তার।”এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইসলামের শেষ ম্যাসেঞ্জার মুসা (আঃ) এর মতোই থিওক্রেসির এক বলিষ্ঠ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় নবিজি(সঃ)বলেনঃ-"যে ব্যক্তি মনে করবে যে-আল্লাহ্‌ তার বান্দাদের জন্যও বিন্দুমাত্র হলেও শাসন-ক্ষমতা বিধানের অধিকার প্রদান করেছেন- তাহলে নিঃসন্দেহে সে নবীদের অবতীর্ণ বানীর সাথে কুফুরী করল।সাবধান!! সৃষ্টি তারই এবং এর উপর প্রভুত্ব ও শাসন-কর্তৃত্ব চালানোর অধিকার কেবল তারই!"

আসল কথা এই যে থিওক্রেসি এমন এক সরকার বা শাসনতন্ত্র যেখানে আল্লাহ্‌কেই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হিসেবে মানা হয় এবং সরকার প্রতিনিধিগণ এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে–“শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার কেবল আল্লাহ্‌র”-[১২ঃ৪০]।এইসব থিওক্রেসি শাসন ব্যবস্থাকে বাইবেলে ‘ঈশ্বরের সাম্রাজ্য’ বা ‘কিংডম অফ গড’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।ফারাও দ্বিতীয় রেমেসিসের দাস্য জীবন থেকে ইহুদিদের মুক্ত করবার পর ম্যাসেঞ্জার মোজেস (মুসা আঃ)ওল্ড টেস্টামেন্টের এই বানী তার অনুসারীদের(সাহাবীদের) নিকট পাঠ করেন-“তোমরা আমার(ঈশ্বরের) সকল বিধিবিধান ও শাসনতন্ত্র মান্য করিবে।যে কেউ এই সকল(আইন-বিধান)পালন করবে, সে এর মাধ্যমে জীবন খুঁজে পাবে; আমিই সদাপ্রভু(লেবিয় ১৭:১-৫)।”
কারণ সেইসব শাসনব্যাবস্থায় বিশ্বাস করা হত আল্লাহ্‌র আইন মেনে চললেই একমাত্র মানব-জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা কায়েম হবে।এবং আল্লাহ্‌র সাম্রাজ্য সমুন্নত করতে পারলেই একমাত্র পৃথিবীতে জান্নাতের ন্যায় শান্তি ফিরে আসবে। এই কারণেই অনেক জায়গায় ঈশ্বরের সাম্রাজ্যকে ‘স্বর্গরাজ্য”ও বলা হয়েছে। কিং-ডেভিট, সম্রাট সাইরাস ও মসেজের তথা ইহুদীদের ইতিহাসে এমন শাসনব্যবস্থার নিদর্শন পাওয়া যায়।


'দেবত্ববাদ'

দেবত্ববাদ হল সেই মতবাদ যেখানে শাসক বা রাজা-মহারাজাগণ ঈশ্বরের প্রভুত্ব-কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নিজেই নিজেদের প্রভু বা লর্ড হিসেবে ঘোষণা করে। তারা ঈশ্বর প্রদত্ত রাষ্ট্রবাবস্থা প্রত্যাখ্যান করে থিওক্রেসির পরিবির্তে নিজেদেরই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হিসেবে দাবী করে। এবং মন্ত্রণাপরিষদের ধর্মযাজক ও জজগণ কর্তৃক নিজেদের খেয়াল-খুশি ও স্বার্থ হাসিলের জন্য ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করে।কখনবা তারা এইসব মনগড়া আইন বিধানকে ধর্মযাজক কর্তৃক লর্ড তথা ঈশ্বরের নামে চালিয়ে দেয়। আমার কখনোবা নিজেদেরই প্রভু বা লর্ড হিসেবে অবতীর্ণ হয়। আর এইসব প্রভুদের শাসন ক্ষমতাকে দৈবিক বা আল্লাহ্‌ প্রদত্ত হিসেবে ঘোষণা করে। আর রাজাদের মুখেই বানীকেই ঈশ্বর প্রদত্ত বানী বা ঈশ্বরের বাণী মনে করে বিশ্বাসী জনসাধারণ এই সব রক্তমাংসের ‘লর্ডদের’ দাসত্ব তথা ইবাদত করে।

উদাহরণরণসরূপ- "গ্রীক ও রোমানদের প্যাগান ধর্মে রাজাদের দৈবক্ষমতায় বিশ্বাস এবং তারই ধারাবাহিকতায় গ্রীক ও রোমানদের শাসনামলেও শাসকপূজা ধর্ম বিশ্বাসের অংশে পরিনত হয়েছিল।শাসকদের একছত্র আনুগত্য ও দাসত্ব গ্রহণ প্রতিটি ইচ্ছুক কিংবা অনিচ্ছুক বিশ্বাসীদের নিকট একান্ত ধর্মীয় কর্তব্যে হিসেবে পরিগনিত করা হতো। মিসরীয় ফারাও ও সেমেটিক রাজাদের প্রভু কিংবা দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর আলেকজান্দ্রিয়ায় তাঁকে সমাহিত করে লর্ড বা ঈশ্বরের মর্যাদা দেওয়া হয়। ফারাওদের মতই টলেমিদের আমলেও মিসরে শাসক পূজা খুবই ব্যাপকতা লাভ করেছিল। প্রথম টলেমি ও তাঁর রাণী প্রথম বেরেনিসকে ত্রাণকারি দেবতা ও দেবী হিসেবে পূজা করা হতো। তাদের মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় টলেমি আরও একধাপ এগিয়ে তাদের জীবিতাবস্থাতেই রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজা-রাণীকে পূজা করার প্রথা প্রচলন করেন।অর্থাৎ দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাস ও তাঁর রাণী দ্বিতীয় আরসিনো তাদের জীবিত কালেই দেবতার আসনে আসীন হয়েছিল। পরবর্তী রাজা-রাণীরাও এই স্রষ্টাদ্রোহী প্রথা চালু রেখেছিল, এবং নিজেদের প্রভু হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছিল । ক্লিওপেট্রার সময় পর্যন্ত এই স্রষ্টাদ্রোহী বিধি চালু ছিল। সেই যুগের বিভিন্ন সরকারি দলিল ও আবেদনপত্রে দেখা যায় ক্লিওপেট্রার পিতা দ্বাদশ টলেমি আউলেটসকে “আমাদের খোদা ও ত্রাণকর্তা রাজা” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৫২খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার নাগরিকরা আউলেটস ও তাঁর সন্তানদের নামে একটি মন্দির উৎসর্গ করেন। এতে রাণী হওয়ার আগেই ক্লিওপেট্রা দেবীর মর্যাদা লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৪২ সালের ১লা জানুয়ারি রোমান সিনেট জুলিয়াস সিজারকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেবতা বা প্রভু হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর অক্টেভিয়ানও নিজেকে ‘দেবতা জুলিয়াসের পুত্র’ বলে ঘোষণা করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪২-৪১ সালের শীতকালে ইফেসাসে (বর্তমান তুরষ্কের পশ্চিমাঞ্চলের সমুদ্র বন্দর) মার্ক এন্টনিকে প্রভুর মর্যাদা দেওয়া হয়। ইফেসাসে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে তাঁকে যুদ্ধের দেবতা মারস ও প্রেমের দেবী ভেনাসের পুত্র এবং মানবজাতির ত্রাণকর্তা বলে উল্লেখ করা হয়। ক্লিওপেট্রা ও এন্টনির বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককেও দৈব ব্যাপার হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল।মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল ক্লিওপেট্রা ছিলেন আসলে দেবী আইসিসের প্রতিরূপ।দেবী আইসিস ক্লিওপেট্রার রূপ ধরে নাকি পৃথিবীতে এসেছিলেন। মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল রাজারা দেবতা অসিরিসের অবতার। প্রভু অসিরিসের সাথে দেবী আইসিসের বিয়ের পার্থিব প্রতিফলন ছিল নাকি এন্টনি ও ক্লিওপেট্রার সম্পর্ক। খ্রীষ্টপূর্ব ২৭ সালে রোমান সিনেট অগাস্টাস সিজারকে ‘অগাস্টাস’ অর্থাৎ‘পবিত্রব্যক্তি’ উপাধী প্রদান করে। ইতিহাসে তিনি এই নামেই পরিচিত।প্যাগান ধর্মে শেখানো হতো শাসকগণই দেবতা বা ঈশ্বরের প্রতিরুপ।আবার এই লর্ডগণ আবার একজনও নয়।কয়জন তারও কোন হিসাব নেই।এসব খোদার কাছে দরিদ্রের কোন আশ্রয় নেই।শাসক প্রভুরা ক্ষমতার দন্দে যেভাবে গৃহযুদ্ধ বাধিয়েছিল তাতে এক খোদা আরেক খোদার হাতে নির্বিচারে মারা পড়েছিল।"(১)

এইসব প্রভুত্বের দাবীদারদের অন্যায় শোষণের ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ ও হৃদয়বিদারক। একজন ন্যায়বান শাসক কখনই নিজেকে প্রভু হিসেবে দাবী করবার কথা নয়। যখন তারা নিজেরাও জানত যে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা কখনই তারা নয়।

একজন মানব তখনই নিজেকে প্রভু হিসেবে দাবি করতে পারে যখন সে পৃথিবীর সকল মানব জাতিকে নিজের দাস হিসেবে ভাবতে থাকে। যখন সে ভাবে পৃথিবীর সকল মানুষের উপর তার যেকোনো খেয়ালখুশি ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করবার একছত্র অধিকার কেবল মাত্র তার। হোক সেটা ন্যায় কিংবা অন্যায়।এইসব রক্ত মাংসের প্রভুর আদেশ লঙ্ঘন করবার অধিকার কোন দাসের ছিলনা।হোক সেটা তার পছন্দনীয় কিংবা অপছন্দের। আর এইসব রক্ত মাংসের প্রভুদের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়েছিলেনএক এক জন সাইরাস, এক এক জন মুসা।



[তথ্যপঞ্জীঃ -(১)ঐতিহাসিক তথ্যগুলোর কিছু অংশ ব্লগার আঝহার মাহামুদের ব্লগ থেকে নেয়া।ধন্যবাদ মাহামুদ ভাই কে-- ঐতিহাসিক তথ্যগুলো উপহার দেয়ার জন্য। পোষ্টটি শুধুমাত্র ইসলামী মতাদর্শে বিশ্বাসীদের জন্য। এটি শুধুমাত্র একটি ইসলামিক পোষ্ট। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার কোন লক্ষ্য আমাদের নেই। তাই অন্য মতাদর্শে বিশ্বাসীরা অনুগ্রহ পূর্বক পোষ্টটি এড়িয়ে যাবেন।]।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:৪৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন পারাবার: শঠতা ও প্রতারণার উর্বর ভূমি

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪০


অনার্সের শেষ আর মাস্টার্সের শুরু। ভালুকা ডিগ্রি কলেজের উত্তর পার্শ্বে বাচ্চাদের যে স্কুলটা আছে (রোজ বাড কিন্ডারগার্টেন), সেখানে মাত্র যোগদান করেছি। ইংরেজি-ধর্ম ক্লাশ করাই। কয়েকদিনে বেশ পরিচিতি এসে গেল আমার।

স্কুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×