বাদামের খোসা ছাড়তে ছাড়তে চোখ আটকে গেল বাদামগুলোকে আগলে রাখা কাগজটির দিকে। রুলটানা রঙ্গিন কাগজটি নীড় হারা কোন ডায়রীর দলছাড়া পালক। হাতের লেখাগুলো বড্ড নজর কাড়া, বড় বড় আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিন্তু সুন্দর।
রঞ্জু বাদামগুলোকে শার্টের বুক পকেটে রেখে আগ্রহ ভরে কাগজটি পড়া শুরু করল,
“তাং-১৯/০৪/২০০৩
এক দেশে ছিল রাজা আর রানী..... রাজার ছিল প্রচুর ধন সম্পত্তি, গোলা ভরা ধান ঘোরাশাল ভর্তি ঘোড়া, টাকশাল ভর্তি টাকা , সোনা মণি মুক্তা...... রাজা মশাইয়ের ছিল তিন কন্যা.......... মিষ্টি কন্যা, টক কন্যা আর লবণ কন্যা। তো একদিন রাজা মশাইয়ের ইচ্ছে হল তার প্রতি কন্যাদের ভালোবাসার পরিক্ষা নেবেন...... যেই কথা সেই কাজ............
রূপকথার সেই রাজা, রানী আর তাদের কন্যাদের গল্পের বাকি অংশটুকু আর কোন দিন শোনা হয় নি। রাতে ভয় পেতাম বলে মা’র গলা ধরে শুয়ে পড়তাম। প্রতিদিন গল্প না শুনলে আমার ঘুম ধরত না। মা একই গল্প প্রতিদিন বলতেন, হয়ত অন্য গল্প জানতেন না বলে। মা চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প শুরু করে দিতেন। গল্পে গল্পে চলে যেতাম সেই রাজার রাজপ্রসাদে,তার রাজ্যে। চিন্তিত রাজার মুখখানী ভেসে উঠত কল্পনার মানসপটে। কল্পনার রাজ্যে পায়চারী করতে করতে কখন যে স্বপ্নের দেশে চলে যেতাম। গল্পের একই জায়গায় এসে ঘুমিয়ে পড়তাম। আর শোনা হয় নি বাকিটুকু।
আজ বড্ড শুনতে ইচ্ছে করছে গল্পটি। কি হল রাজার, কি হল তার তিন কন্যার, পিতার প্রতি ভালোবাসার পরিক্ষায় কে পাশ করল শেষে? বড্ড শুনতে ইচ্ছে করছে। রাত বাড়ছে , ভয়ও বাড়ছে। মা’র গলা ধরে থাকতে ইচ্ছে করছে। মা আজ আমাকে ছাড়াই শুয়ে পড়েছে। সে স্বার্থপরের মত আমাকে একা রেখেই ঘুমোচ্ছে। আমার যে ভয় করছে, প্রচন্ড ভয় করছে। হাসপাতালের এই ৩০২ নাম্বার রুমের জানালাটা দিয়ে লাশকাটা ঘর দেখা যাচ্ছে। মা, আমার খুব ভয় করছে। শেষ বারের মত একবার গল্পটি শুনতে চাই মা। আর মাত্র একবার তোমার গলা ধরে শুতে চাই। রাতের সাথে ভয়ও বাড়ছে,মা চোখ বুজে ঘুমোচ্ছেন। ভয় কাটানোর আমি ডাইরী লিখছি আর মাঝে মাঝে মা’র মায়াভরা মুখখানীর দিকে তাকাচ্ছি। ভয় কমছে না, এ ভয় অন্য কিছুর।
মা ঠিক আমার সামনে শুয়ে আছেন ,রুম নাম্বার ৩০২, সদর হাসপাতাল। মা ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন। তিন দিন যাবত লেফট সাইড প্যারালাইসড। খুব ইচ্ছে করছে মা’কে ডেকে তুলতে, সেই গল্পটি শুনতে মা’র গলা ধরে শুয়ে থাকতে। পারছি না, মা প্যারালাইসড.........
তাং-২৫/০৪/২০০৩
হ্যা, মা’র সেদিন ঘুম ভেংগেছিল। পুত্রকে জেগে রেখে মা ঘুমোবে এ কেমন কথা। মা জানতেন আমি ভয় পাচ্ছি, মায়ের মন বলে কথা। ঘুম ভেঙ্গে মা আমার দিকে করুন দৃস্টিতে তাকিয়ে পানি ইশারা করেছিলেন। মা’র চোখ জোড়া কেমন জানি অচেনা লাগছিল। বেদনাশ্রুত চোখ জোড়া এই বুঝি কেদে দেবে। গ্লাস ভরে পানি আনতে আনতেই মা ছটফট শুরু করলেন। আমি ইমার্জেন্সির ডাক্তারকে ডাকতে গেলাম। ডাক্তার এলেন কিন্তু মা চলে গেলেন।
রুপকথার গল্পটি আর শোনা হল না, মা’র গলা ধরে আর শোয়া হল না”।
রঞ্জুর চোখের পানিতে কাগজটি ভিজে গেছে। অক্ষরগুলো রঙহারা হয়ে যাচ্ছে, কিছুটা স্যাঁতস্যাঁতে। বাদামগুলো হাতে রেখে রঞ্জু কাগজটি বুক পকেটে রেখে দিল। ঘরে ফেরার সময় হয়ে গেছে।
নাহ, আজ আর ঘরে যাবে না সে, বৃদ্ধাশ্রমে যাবে। অনেক দিন যাবত মা’র খবর নেয়া হয় না। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মা’কে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:২১