somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিরাতাল মুস্তাকিম!

২৩ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৫:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
জুম্মাবারে নামাজ পড়তে যাইয়া খেয়াল করলাম পাড়ায় নতুন আসা বন্ধুটা একবার বেশি তাকবীর (এই তো শব্দটা?- দু কানের কানের লতি ছোঁয়া ) বাধছে। অস্বস্তিকর না ব্যাপারটা! নামাজ শেষে জিগাইলাম বিষয় কী।
কয় আমরা মুহাম্মদী। জানিস না শেষ জামানায় ইসলামের তিয়াত্তরটা (নাকি পচাত্তরটা?) জামাত বাইরাইবে, এদের মধ্যে একটা মোটে হেদায়াত পাইবো। এই একটা জামাত হইল মুহাম্মদী।
কেমুন লাগে কন! কইলাম: চান্দু, কইলা একখান কথা। তোর বাড়িতে প্রথম যেদিন গেলাম, সেইদিনই ফ্রিজ থাইকা বাপের বিয়ার চুরি কইরা আইনা আমাগো সাধলা, আমি একলা খাইলাম না। অহন তুমি যাবা বেহেস্ত, আর আমি যামু দুজখ!
পোলা আমার চায়া আধাহাত খাটো হইলে কি হইব, মাটিতে কথা পড়তে দেয় না। কয়: সব হিন্দু আর খৃষ্টানে কি মদ খায়? আমাগো শুভ্রাংশু স্যারে কি মদ খায়? জুয়া খেলে?
বুঝলাম, ফাঁন্দে পড়ছি। ঋষিতুল্য শুভ্রাশু স্যারকে নিয়ে ও কথা ভাবাই অসম্ভব। মাথাচুলকায়া কইলাম, না, তা খায় না।
শুভ্রাংশু স্যার কি বেহেস্তে যাইব মদ খায় জুয়া খেলে এমন মুসলমানের আগে?
চূড়ান্ত প্রশ্নটা শোনার আগেই যতদূর জ্ঞান ধর্মীয় জ্ঞান ছিল, তার টিমটিমে আলোতে আমি তখন হাচড়ে পাচড়ে শুভ্রাংশু স্যারের জন্য কোন একটা সুসমাচার খুঁজছি। না কিছুই তো পাওয়া গেল না!
শেয়ালপানা হাসি হাসি মুখ নিয়ে কয়েক সেকেন্ড আমার উত্তরের অপেক্ষা করে দোস্ত বলল, ওই রকমই, বাকিদের ঈমান যেহেতু ঠিক নাই, তাই অন্য মাজহাবের আগে মুহাম্মদীরা বেহেস্তে যাবে।

তর্কে হারলে অল্পবয়েসীরা যা করে, আমিও তাই করলাম, আরে যা যা, যাইস তো বেহেস্তে... আম্রা তো ভাইসা আসছি... বলে হাত নেড়ে বাড়ি ফিরলাম।
অস্বস্তি আর যায় না।

খাবার টেবিলে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম: মুহাম্মদীরা কারা?
ওনার সংক্ষিপ্ত উত্তর: এরা আব্দুল ওয়াহাবের অনুসারী। মাজহাব মানে না বইলা এগো লা মাজহাবীও বলে। একটু পিউরিটান।

পিউরিটান! তাই তো হইতে চাই বরাবর। কেউ যদি দেখায়া দেয় কেমনে খাটি শুদ্ধ কেমনে হইতে হয়, মনে তুচ্ছ সংশয় আর যখন থাকে না, চোখ বন্ধ করে যে রাস্তায় হাঁটা যায়...
"আব্বু, মুসলমানদের মাঝে কি খালি মুহাম্মদীরাই বেহেস্তে যাবে...?"

পিতৃদেব খাদ্য চিবানো বাদ দিয়ে কয়েক মুহুর্ত আমার দিকে স্থির তাকিয়ে বললেন, "অংকে কত পাইছিস লাস্ট সেমিস্টারে? কাল থেকে বিকালে বাইরে যাওয়া বন্ধ আমার কাছে অ্যালজেব্রা করবি।"

বিকেল বেলা মাঠে না যেতে পারা অনেক বড় নির্যাতন, আরও বড় নির্যাতন অ্যালজেব্রা কষা। তারচেয়েও বেশি কিন্তু গায়ে লাগল আমার হেনস্তায় হাসি চাপতে গিয়ে বড় বোনের বিষম খাওয়ায়। আমার ধর্মীয় অত্যুৎসাহ ভাইবোনদের চিরকালের মস্করার বিষয়।

বাবার সাথে কখনোই বেশি কথা বলার সাহস করতাম না, ওনার হিসাবে এক আর দুইয়ের পর আর কোন ক্রমিক নাম্বার নেই। আমি যেহেতু লাড্ডাগোড্ডা, কাজেই পাঠ্যবইয়ের বাইরের যে কোন প্রশ্নেই উনি ভ্রুঁ কুচকে পাস্টপার্টিসিপল এর পরীক্ষা নেয়া শুরু করতেন। বাকি তিন ভাইবোন প্রশ্নটা এগিয়ে নিলে হয়তো আরও কিছু জানা যেত, কিন্তু ওদেরও তেমন মাথা ব্যাথা হলো না আব্দুল ওয়াহাবের পিউরিটান অনুসারীদের নিয়ে।

২.
দিনগুলো পার হতো যথারীতি, রাতগুলো ছিল ভয়ংকর। আমি তো ছিলাম ধূলিকনা, কেন মাবুদ প্রাণ দিলা! যদি দিলাই প্রাণ তো পরীক্ষায় কেন ফেল? কত আছে তোমার নির্বাচিত বান্দা, মায়ের গর্ভ থেকেই কোরআনে হাফেজ হয়ে আসে, শৈশব থেকেই চেনা যায় তাদে সুলক্ষণচিহ্ন। আমারে তো মাবুদ বানাইলা অতিসাধারণ, কেমনে এই ঘোর পরীক্ষায় পাড়ি দেই! পা ফস্কালে অনন্ত দোজখ, আর সাবধানে পা টিপে টিপে চলতে গিয়ে পাই সার্বক্ষণিক উপহাস। অনন্ত আজাবের হাত থেকে মুক্তির একটা উপায় দেখায়া দাও, আমি জীবনভর যা অনুসরণ কর্তে রাজি আছি। কিন্তু এই অন্ধের মত পরীক্ষা যে আর সহ্য হয় না, মাবুদ। কেঁদে কেঁদে দিলটা সাফ হয়। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরি। চোখের জল বোধ হয় মগজের টনিকও, ক'দিন বালিশ ভিজিয়েই ধা করে মাথায় আসে... তাইতো তাইতো। তারপর শান্তির ঘুম।

পরের জুম্মায় আমার ব্রক্ষাস্ত্র ছাড়ি: তুই কি এই সব হানাফী-শাফায়ে-মালেকী-হাম্বলী, সব কিতাব পইড়া জানছিস যে মুহাম্মদীরাই সঠিক, তারাই বেহেস্ত যাবে?
পেট চেপে গা জ্বালানো শব্দে খ্যাক খ্যাক করে হাসে হারামজাদাটা, তারপর বলে: তুই কি বেদ-জবুর-তাওরাত কোরআন সব ধর্ম গ্রন্থ পইড়া দেখছিস ইসলাম ধর্মই খাঁটি?
আমতা আমতা করি, ও কিন্তু জবাবের অপেক্ষা করে না মেটেই। বলে: আম্রাও সেই রকম জানি যে বাকি সব মাজহাব হইল দোজখী, খালি এক মুহাম্মদী মাজহাবই শাফায়াত পাবে।
তর্কে হেরে গেলেও প্রথমে একটা স্বস্তির অনুভূতি পেলাম, অন্তত কোন মাজহাব শাফায়াতের রাস্তায় আছে, তা একেবারে নির্ধারিত হয়ে যায়নি। তারপরও হতভাগার আত্মবিশ্বাস দেখেবুকের ভেতর সেই খচ্ খচ্ টা রয়েই গেল।

তারপরতো আবার সেই দিন ফুরোলে রাত! আরও কত কি নতুন চিন্তা মাথায় আসে! বেহেস্তে কত বছর থাকবো? হাজার... কোটি বছর? তারপর ধরো এই যে "আদম ও বানাইয়া খেলছো তারে লইয়া"... আল্লা যদি এই খেলা বারবার খেলতে চায়? এই আমি যে বেহেস্তগামি, তাতে না হয় আপাতত কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও আল্লার আবার যদি একই খেলা খেলতে ইচ্ছা করে?
তবে আবার এই জীবন? আবার এই পরীক্ষা? আবার এই উপহাস, তাচ্ছিল্য? ডুকরে কেঁদে উঠতে চায় মন।


৩.
আমাকে উদ্ধার করতেই পাণ্ডুব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ক'দিন বাসায় এলেন ঢা.বি পড়ুয়া চাচাত ভাই। রসায়নের ছাত্র। বিরাট পণ্ডিত। সারাদিন বকবক কর্তে কোন ক্লান্তি নাই তার। আমি সর্বদাই তার গুনমুদ্ধ, যদিও আজ বহু বছর উনি আমাকে এড়িয়ে চলেন। আমার সমস্যা শুনে বললেন, কি যে বলিস! সুরা ফাতেহা পড়িস নাই? ইহ্ দিনাস সিরাতল মোস্তাকিস...

আমি মুদ্ধ। সরল মনের সহজ পথের পথিকদের জন্যই তো ইসলাম। উনি আরও শোনালেন গরু কোরবানি না দিতে চাওয়া ইহুদীদের গল্পটা, ওরা মুসা নবীকে নানান ছুতায় আসলে ধর্মের সহজ নির্দেশটাই ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল।

কথা সহজ: সরল মনে তুমি যখন উপাসনা করবা, আল্লা তুমার সকল ইবাদত কবুল কইরা নিবে।

আহ্! কি শান্তি!! সব সংশয় আর দ্বিধা নিমিষেই দূর। আমার চিন্তা আর ক্ষমতা দিয়ে যেমন ভাবে পারি, তেমনভাবেই ইবাদত করতে হবে। ধর্মের সরল পথ!

ততদিনে স্কুলে জড়িয়ে গেছি একটা ধর্মীয় ছাত্র সংগঠনের সাথে। জেনে নিয়েছি নাস্তিকদের নাম-ধাম। আহমদ শরীফ আর বদরুদ্দীন উমর তো দুই শয়তানের প্রতিভূ। সালমান রুশদীর ফ্যাচাংটা কি সেই বছরই লাগল, না আরো পরে?
ক'দিন পর উনি মোটামুটি সুস্থ্য হলে দু'জনে বেড়াতে বেরুলাম। ফার্মগেট পর্যন্ত রিকসায় গিয়ে মিরপুরের বাসে উঠেছি, খালার বাসায় যাব। বাসে উঠেছে এক পাগলা বুড়ি। তার হাতে বিশাল এক ফুলের তোড়া। একা একাই বকবক করছে সে। আড়ি পেতে তার কথা শুনে বুঝলাম,তোড়াটা মিরপুর মাজারে দিতে যাচ্ছে সে।
"ভাইজান!" ভয়ে জমে গেলাম আমি।
"কি হইছে?" ভাইজান অবাক।
"ওই বুড়ি মাজারে ফূল দিতে যাইতেছে, বুড়ির পাপ হইবো না, বুড়ি তো দোজখী!"
"হ্যাঁ, তা তো হবেই। কবরপুজা তো পাপই।" অবাক হলাম, উনি বেশ হৃষ্টচিত্তেই কথাটা বললেন।
"কিন্তু বুড়ি তো না জাইনা সরল মনে করতেছে।"
"কিন্তু আল্লা তো সকল মুমিনের জন্য জ্ঞানার্জন ফরজ করছে। তুমি জানি না বইলা মাফ পাইবা না। জাইনা সরল মনে ভুল করো, কোন ক্ষতি নাই।"
"কিন্তু ভাইজান, আল্লা তো আহমদ শরীফ আর বদরুদ্দীন উমররে অনেক জ্ঞান বুদ্ধি দিছে। তারা যদি সরল মনে নাস্তিক হইয়া যায়, তাদের জ্ঞান বু্দ্ধির জন্য কি তারা দায়ী..."
"কি যে করি তোরে নিয়া..." ভাইজান বাসের জানলা দিয়া বাইরে তাকালেন।
.....



আগের দুই কিস্তি
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৫:৪৮
৫৯টি মন্তব্য ৫৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমাধ্যম আক্রমণ: হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন নূরুল কবীর ও নাহিদ ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৫


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সাম্প্রতিক মব ভায়োলেন্স এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ সেই স্বপ্নকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিউ এজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৪৯

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

সবাই যখন ওসমান হাদিকে নিয়ে রিকশাওয়ালাদের মহাকাব্য শেয়ার করছে, তখন ভাবলাম—আমার অভিজ্ঞতাটাও দলিল হিসেবে রেখে যাই। ভবিষ্যতে কেউ যদি জানতে চায়, এই দেশটা কীভাবে চলে—তখন কাজে লাগবে।

রিকশায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



শরিফ ওসমান হাদি। তার হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×