আদমরে দেখায়া আল্লা বললেন: সেজদা কর।
শয়তানে কয়: আমি নুরের তৈরি। হে মাটির। আমি এত বচ্ছর আপনার বন্দেগী কর্লাম, হে জন্মাইল হেদিন। আমি তো হের সিনয়রও। আমি কেমনে হেরে সেজদা করি?
আল্লায় কন: নাফরমান! তুই বাইরা।
শয়তান: যাই। তয় এত বচ্ছর আপনার খেদমত কর্লাম, একটা ফেভার চাই। আমি যেন এরেও নাফরমানিতে নিতে পারি, তার ওয়ারিশরাও যেন আমার তাবে আসে, সেই শক্তি দ্যান।
মাবুদ তার ইরাদা মঞ্জুর কর্লেন। সাথে কন্ডিশন, ঈমানদারগো উপ্রে তার এই সব ওসওয়াসা কাম কর্বে না।
সেই থাইকা শুরু হৈল মানুষ আর শয়তানের খেলা। নানান ভার্সনে এই গপ্প শুইনাই সবতে বড় হৈছি আম্রা। শয়তানের গল্পটার ইউনিক দিক হৈল, সেমেটিক ধর্ম ছাড়া শয়তানের সাথে তুলনীয় চরিত্র পাওয়া দুষ্কর। গ্রিকদের ধর্মে আম্রা পাই জগতসংসার দেবতাদেরই খেলা, ট্রয়-গ্রিক যু্দ্ধ আসলে অলিম্পাস পাহাড়ে দেবতাদের আন্তসংঘর্ষেরই ফল। ব্যক্তিদেরও উস্কান দেবতা-দেবীরা, তাদের কামকাতর করেন, স্বার্থান্ধ করেন। ভয় দেখান, লোভও। ভারতীয় ধর্মেও দেবতাদের দুষ্টামি কম নাই। কিন্তু শয়তানের মত পূর্ণাঙ্গ চরিত্র, যার স্কন্ধে মানবকূলকে বিপথগামী করার গুরু দায়িত্ব, তেমন চরিত্র পাই কী?
শয়তানের শয়তানির এই গপ্পটার উৎসতে হজরত আদম পর্যন্ত পৌছায়। সঙ্গত কারণেই ধরে নেয়া যায়, বাবা আদম হতে আজ পর্যন্ত সেমেটিক জাতিকূল এই গল্পটার সাথে পরিচিত। তা কিন্তু না। এইটাই একটা আশ্চর্য বিষয়, যা তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিকদের কম ভাবায় নাই।
আসেন অনুসন্ধান শুরু করা যাক।
জেনেসিস এর বর্ণনাতে পাওয়া যাবে সাপ ছিল সৃষ্ট জীবজন্তুর মাঝে সবচে’ ধুরন্ধর। সাপ একদিন হাওয়াকে বলে, মাবুদ কি আসলেই ওই গাছটার ফল খাইতে মানা কর্ছে? হাওয়া বলে, আর সব গাছের ফল খাওয়া যাইবে, কিন্তু ওই নির্দিষ্ট বিরিক্ষের ফল নিষিদ্ধ। সাপটা তখন আশ্বস্ত করে বলে, না ওইটার ফল খাইলে তোমার চোখ খুলবে, তুমি মাবুদের মতই ভাল-মন্দ বুঝতে শিখবা। জ্ঞানী হৈতে হৈলে এইটা খাওন লাগবে, দেখতেও টসটসা। হাওযা জ্ঞানী হবার আশায় নিজেও খাইল, হাজব্যানডরেও খাইতে দিল। এই হৈল জেনেসিস পুস্তকের বর্ণনা। এইখানে কিন্তু কোথাও শয়তানের উল্লেখমাত্র নাই। এমনকি, আল্লা তিনজনরে অভিশাপও দিলেন। সাপরে অভিশাপ দিলেন, হাপের পোলা হাপ, তুই জীবনভর প্যাটের উপ্রে ভর দিয়া চলবি, ধূলা হৈব তোর খাদ্য। আর হাওয়ার গুষ্টির লগে তোর গুষ্টির দিলাম স্থায়ী কাইজ্জা, হ্যারা তোর মাথায় বাড়ি দিব, তুই দিবি হ্যার গোড়ালিতে কামড়।
কোন শয়তানের উল্লেখ নাই। এমনকি, অভিশাপের বাণী থেকে খুব পষ্ট, সাপই এইখানে বিবেচ্য। শয়তান না। বরং এটাকে আমাদের আরও বহু পরিচিত গল্পের মতই লাগে; হনুমানের মুখ কেন পোড়া (লঙ্কাপুরীতে আগুন দিতে গিয়ে!), গ্রহণ কেন হয় (প্রতারিত অসুরেরা চন্দ্রদেব আর সূর্যদেবরে গিলে ফেলে!), ভূমিকম্প কেন হয় (শিং নড়লে!)ইত্যাদি হাজারটা গল্প আর কাহিনীর মতোই কল্পিত আদি স্বর্গ থেকে মানুষের পতনের সাথে সর্পকূলের সাথে শত্রুতার সম্পর্ক সৃষ্টি করা এই কাহিনীটা তাই খুব অত্যাশ্চার্য কোন কাহিনীও না। এমনটা আরও হাজারটা পাওয়া যাবে।
বরং ওই সময়কার ধর্মীয় পুস্তকগুলোতে শয়তানের যে উল্লেখ পাওযা যায়, তা একজন স্বর্গীয় পারিষদের। যার কাজ মানুষকে নাফরমানির জন্য অভিযুক্ত করা। হিব্রু ভাষায় স্যাটান মানেও যিনি অভিযুক্ত করেন। বাইবেলের জাকারিয়া পুস্তকে তার এই কাজটার উল্লেখ আছে। এইটাকে বলা যায়, স্বর্গীয় সলিসিটরের দায়িত্ব। একটা কথা ঠিক, এই ফেরেসতার কাজ ছিল মানুষ যে পাপাচারে নিমজ্জিত, সারাক্ষণ সেই কথাটা আল্লার কানে দিতে থাকা। এই ভূমিকারও ব্যাখ্যা সহজ। সমাজ কখনো অনড় থাকে না। প্রতিনিয়ত ভাঙে, ফলে নিয়মও সদা পরিবর্তনশীল। এই সদা পরিবর্তনশীলতার সাথে তাল রেখে নিত্যনতুন আইন, নিয়মকানুনও তৈরি করা হয়। এইটা ইন্টারেস্টিং, নৃবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, আদিম গোত্রবদ্ধ অবস্থায় মানুষ নিয়মভাঙে খুব কম। এমনকি, কোন ট্যাবু কেউ সকলের অজান্তে ভেঙে ফেললেও সে তা গোপন করে না। কিন্তু এই গোত্রবদ্ধ সমাজ যখন ভেঙে অসাম্য তৈরি হয়, তখনই মানুষের পক্ষে পুরানো গোত্রীয সকল শুদ্ধাচার সকল ভ্রাতৃত্ব, সকল যৌনশুচিতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। সকল গবাদি পশু- উর্বরা ভূমি যখন অভিজাতদের দখলে চলে যায়, গোত্রের অধিকাংশ নারীদের ওপর (নারীরা যখন সম্পত্তি!) যখন সর্দার বা রাজাদের একচেটিয়া কায়েম হয়, তখন বঞ্চিত বাকিদের কাছ থেকে শুধু যে নিরাপত্তা আশা করা যায় না, তাই না। অভিজাত বা ক্ষমতাবানদের নিজেদের মাঝেও কামড়াকামড়ি শুরু হয়। মহাভারতেও আমরা দেখব, গ্রিক পুরাকাহিনীগুলোতেও আমরা দেখব মানুষ যে ক্রমশঃ অধপাতে যাচ্ছে, তারই বয়ান।
কাজেই অধঃপাতে যাওয়া মানুষকে ঠেকাতে নিত্য নতুন কাহিনী ফাঁদতে হয়। দুষ্ট লোকেরা বলে, এইটা ক্ষমতাবানদের ধান্ধা, পরনারীপরবস্তুতে লোভ করিও না; মিষ্টি করে বললেও ন্যূনতম মাত্রায় নৈতিকতার চর্চা না জারি রাখতে পারলে সম্পত্তিমালিকানার এই নতুন ব্যবস্থা চালু থাকতে পারত না।
অনেক দূরে চলে আসলাম কী! শয়তানের কীর্তিতে আসি। আমরা যেটা দেখলাম, জেনেসিসে শয়তান নাই। সখরিয়াতে আম্রা পাইলাম তিনি মহাইমাম যোশুয়ারে অভিযুক্ত করতেসেন। এইবার আসি পরের ধাপে। আইযুব নবীর কাহিনীতে দেখব তার চরিত্রের নতুন উত্থান।
“আরে আইয়ুব নবীর সোনার অঙ্গ কুষ্ঠ রোগে খায়
রহিমা বিবির চোখে বান ডাইকা যায়
নবীজি বলেন তারে, বৃথা কান্দো বিবি,
হৈবো তাহাই শেষে আল্লা যাহা চা য় আয রে....”
ওল্ড টেস্টামেন্টের আয়ুব নবীর কাহিনী আসলে প্রতিশ্রুত ভূমিতে সেই ইহুদীদের অনেকটা থিতু হবার অনেক পরের কাহিনী। তারা তখন চাষবাস করে ফসল ফলিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে যুদ্ধটুদ্ধ করে হেস্তনেস্তই শুধু করে নাই। নিজেদের মাঝেও তাদের অনেক বদল এসেছে। আদিতে ইহুদীদের ভুমি বন্টন এমন ছিল যে, এমনকি ঋণের দায়েও কারো জমি বাজেয়াপ্ত হলে তা সাত বছর পর মালিকের কাছে ফেরত যেত, কেননা মালিকানা ছিল অচ্ছেদ্য। সেই নিয়ম ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছে। আদিতে ইহুদের নিজেদের মাঝো দাস হতে পারত না। পরের ধাপে কেউ দেনার দায়ে কৃতদাস হয়ে গেলে সেও মুক্তি পেত সাত বছর পর কোন মুক্তিপন ছাড়াই। কিন্তু ক্রমে ইত্যাদি ইত্যাদি আদি সকল আইনের অবসান ঘটেছে।
খেয়াল করেন, এই আইনগুলার জন্ম গোত্রভাতৃত্ব অটুট রাখা। কিন্তু অন্যদিকে এই আইনের কারণেই কিন্তু আবার সমাজের স্থিরতা বজায় থাকলেও বিকাশ রূদ্ধ হয়ে পড়ছে। এইখানে, পাঠকদের কারো স্মরণ থাকলে খেয়াল করিয়ে দেই, আরবে কেন পয়গম্বর আর গ্রিসে কেন দার্শনিক নামে একটা পোস্ট দিসিলাম বহু আগে, কিন্তু সেইটার পরের পর্ব জানা-অজানা নানান কারণে আর দেয়া হয়া উঠে নাই। যারে বলে ছন্দ পতন। সেই প্রশ্নটার একটা উত্তর কিন্তু এই পয়েন্টটার মাঝে আছে।
তো, আমাদের আয়ুব নবীর বর্ণানায় যে গপ্পটা আম্রা জানি, সেইটা আদতে ইহুদী নারীরা যবের তুষ ঝাড়তে ঝাড়তে যে গানগুলা গাইত, তারই একটা। এই গল্পটার কয়েকটা মাজেজা আছে, একদিক দিয়া এইটা এখন বোঝা যায়, জীবনে ঝড় তুফান আছে, যেইটা তোমারে একলাই সহ্য করতে হবে। মানে আয়ুব নবীর কাহিনীর মৌলিক দিক ছিল সমাজরে সহিষ্ণুতা শেখান, নিস্ব সম্বলহীন হযা গেলেও ঈমান হারানো যে যাবে না, সেই শিক্ষাটা দেয়া। নতুন সমাজে এই শিক্ষাটার গুরুত্ব ম্যালা। আরেক দিক দিয়ে, এইখানে শয়তানের পদোন্নতি ঘটলো। ঐশী পরিষদকূলে তিনি এখন আর কেবল অভিযোগ উত্থাপনকারী নন, তিনি মাবুদের কাছে প্রমাণ করতে চান, বিপদে পর্লেই মানুষ নাফরমান হবে। আল্লা বলেন, লাগবা বাজি!
বাজি লাগা হৈল। আয়ুব নবীর উট গেল, জমি গেল, স্বাস্থ্য গেল, সন্তানাদি গেল। কিন্তু ঈমান অটুট রৈল। এই গল্পেও কিন্তু কোথাও শয়তান আযুব নবীকে উস্কায় নাই, বিন্দুমাত্র এসে কয় নাই, ব্যাডা, ঈমান ছাড়। সব পাবি। বরং সে কাউকে উস্কে থাকলে তা স্বয়ং মাবুদকেই।
তাইলে এই পর্যন্ত রচিত পুস্তক গুলাতে শয়তানের শয়তানি কৈ? নাই। শয়তান তার স্বমহিমায় আসলো আরও বহু পরেকার পুস্তক আর ব্যাখ্যাগুলাতে। সেই কাহিনী মনে হয় ততটা ইন্টরেস্টিং না। :-"
[ ভালো কথা, এই লেখার শয়তান সম্পর্কিত সকল ওল্ডটেস্টামেন্টীয় আইডিয়া আর তথ্যের উৎস বন্ধু কাজী। বাহুল্য অংশগুলো আর শযতানের গপ্পটা ইলাস্টিক করার দায় আমার। তারে জানায়া ধন্যবাদ দিবার উপায় নাই। আমি যে কৃতজ্ঞ, আপনারা পঞ্চজনে সাক্ষী থাকলেন মাবুদের দরবারে। :> ]
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১০ সকাল ৭:৩৯