ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া একটা ফেরকার নামে কেন নিজের নাম নিলাম, এই জানায়া একজন মেইল করছিলেন বহু আগে। হঠাত মনে হৈল ব্লগে একটা উত্তর দেই, তারে ব্যক্তিগতভাবে এই ফিরতি মেইলটাই পাঠাইছিলাম।
খারেজি একটা ফিরকা, সন্দেহ নাই। মুসলমানদের মাঝে প্রথম স্থায়ী ফিরকা খারেজিরা, এই অপবাদও সত্য। ফিরকা আসমান থেকে আসে না। দ্বন্দ্ব যখন আসে, তখনই ফিরকার জন্ম হয়। দেখবেন সুন্নী মুসলমানরা ইসলামের প্রথম দ্বন্দ্ব বিষয়ে (উটের যুদ্ধ যাতে প্রথম রক্তপাত ঘটালো মুসলমান মুসলমানের, আয়েশা এক পক্ষের নেতৃত্ব দিয়েছেন উটের পিঠে চড়ে, আরেক পক্ষে হযরত আলী) কাউরে দোষারোপ করে না। কিন্তু স্পর্শকাতর মন এইটা না মাইনা পারে না, মুসলমানের রক্ত ঝরলো (অবুঝের মন প্রথমে মুসলমানের রক্তরেই মনে হয় দামি ভাবে, পরে ক্রমে স্পর্শকাতরতার গুনেই মানুষের রক্তরেই মূল্য দিতে শেখে), মানুষ খুন হৈলো, কিন্তু কেউ দোষী সাব্যস্ত হৈল না কেন?
একটাই ব্যাখ্যা, যারা জিতলেন, তারা যারা পরাজিত, তাদের যোগ্য সন্মান দিলেন। মা আয়েশা সন্মানের সাথে, প্রাচুর্যের মাঝেই বাকি জীবন কাটাতে পারলেন। এইখানে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া উভয়পক্ষই আসলে পরস্পরকে আক্রমণ করে মুসলমানদের মাঝে অজনপ্রিয় হবার ঝুঁকি খুব বেশি নিতে চান নাই, তাই যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র পরাজিত পক্ষও তাজিমের সাথেই গৃহীত হলেন। মা আয়েশা অসংখ্য হাদিস আর ইসলামি ধারণার প্রবর্তনের সাথে যুক্ত, বিশেষত তিনি নারীর অধিকারের পক্ষে যথাসম্ভব লড়াই করছেন।
কিন্তু, মর্যাদার ভারসাম্য যদি এতটা নিকটবর্তী না হয়? যদি যারা পরাজিত, তারা শত্রু হিসেবেও হীনতর হিসেবে চিত্রিত থাকে? দ্বন্দ্বটা যদি স্রেফ খলিফা কে হবেন তা না নিয়ে আরও গভীরতর প্রশ্ন নিয়ে হয়? এত সহজে মিমাংসা তখন আর সম্ভব হয় না। যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা পরাজিত, পয়লা চোটের ধাক্কা যারা সামলাতে পেরেছিল, তাদের বেশিরভাগটাই কিন্তু খুব দ্রুত ক্ষমতাসীনের নৈকট্যই লাভ করেছিলো। কারণ, যারা যুদ্ধটাতে জিতেছিল, তারা এক ছিল না, তাদের মাঝেও খারেজি ছিল-- জাসদ। জাসদ হলো মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা, যাদেরকে হত্যা করা হবে।
তো, প্রসঙ্গান্তরে না যাই। ইসলামের দুইটা বিষয় সব সময়েই ভিন্ন ভিন্ন তরিকার এবং চিন্তার জন্ম দিয়েছে। সেটা হলো একদিকে তত্ত্বগতভাবে নারীপুরুষ, আরবঅনারব, সাদাকালো, গরিবধনী নির্বিশেষে সকলে আল্লাহর চোখে সমান। অন্যদিকে অনুশীলনে একটা বেজায় পার্থক্য, কোন কোন ক্ষেত্রে তত্ত্বেও এই পার্থক্যকে অনুমোদন।
আরবে যে জাতিগুলা ইসলাম গ্রহণ করেছিল নানান চাপে, লোভে, আকর্ষণে কিংবা উদ্ধুদ্ধ হয়ে, খুব দ্রুত তাদের একটা বড় অংশ উপলদ্ধি করল যে মদিনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রটাতে যে শুধু মদিনাবাসীরই অংশগ্রহণ সামান্য নয়, বাকি আরবদের জন্যও সেটা ভয়াবহ বৈষম্যমূলক। বিশেষ করে নবীর মৃত্যুর পর এই উপলদ্ধিটা প্রকাশেরও সুযোগ পায়। তার মৃত্যুর পরপরই অসংখ্য বিদ্রোহ, মিথ্যা নবী, নারী নবীর আবির্ভাব ঘটে একেকটা আরব গোত্রে, তারা আসলে তাদের গোত্রের স্বাধীনাতর ওপর মদীনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের জোয়াল থেকে মুক্ত হবারই আওয়াজ তুলছিলেন। কিন্তু ইসলাম ততদিনে অনেকটাই সংহত, প্রথম খলিফা আবু বকর খুব সহজেই তা দমন করে ফেলেন। সম্পূর্ণ আরব ইসলামের তরবারির শান্তির নিচেই অবস্থান করলো।
কিন্তু বাস্তব বিভাজন আর বৈষম্যটা তো থাকল। এখন একটা সঙ্কট তৈরি হলো যার চেহারাটা এমন: যে গোত্রগুলো কিছুদিন আগেও ছিল স্বাধীনচেতা বেদুইন, তারা এখন একটা কেন্দ্রীভূত ধর্মের অধীন। ফলে স্বাধীন জীবনের বহু সংস্কৃতি তারা ত্যাগ করলেও স্বাধীন স্পৃহাটা ত্যাগ তারা সহজে করে নাই। ফলে ইসলামের ধারণার সেইটাই তারা গ্রহণ করলো, যেটা তার অনুশীলন না, যেটাকে তারা তার মূল্যবোধের সারবস্তু হিসেবে চিনতে সক্ষম হলো।
খারেজিরা যেমন নবীর বহু অনুশীলনকেও, আরবের বহু চর্চা হিসেবে যা বহু কাল ধর ছিল, যেমন বাল্য বিবাহ, অনুমোদন করতো না। কেননা বিবাহ দুইজন মানুষের মাঝে চুক্তি, ইসলামী শরিয়ামতে। কিন্তু বালিকার বাবালেকের তো স্বাধীন মত নাই! তারা আরব অনারবে বিভেদ কিছুতেই মানত না। কুরাইশ-অকুরাইশ বিভেদের তারা শিকার ছিল, কিন্তু সেই বোধটারে তারা আরও যারা লাঞ্ছিত, তাদের পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন করা আমরা সেইটা কতদূর পারছি? সাদাকালো বিভেদের উর্ধে উঠতে পারছিল এই রকম আর একটা মত সেই যুগে আপনি পাবেন না। অসম্ভব। নারী-পুরুষ বৈষম্য তারা মানতোই না শুধু, তাদের কোন কোন উপদল মনে করতো নারীরাও খলিফা হবার যোগ্য। হাসিনা-খালেদারে ভোট দিয়া আপনারা খারেজিগো অনুসরণ করা ছাড়া আর কি কর্লেন? সম্পদের বন্টন, ভোটাধিকার তখন ছিল না বটে, কিন্তু সকলের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এই সব বিষয়েও তারা ছিল সমতাবাদী। গণতান্ত্রিক।
আর কিছু লাগে খারেজি হবার জন্য?
লাগে, তাদের দলে কেমন ছিল, দোদুল্যমান মধ্যচিত্ত এই প্রশ্নটা না কৈরা পারে? বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, সংখ্যায গুনলে আরবের বেশিরভাগ মুসলমান গোত্রগুলা খারেজিদের পক্ষে অবস্থান নিছিলেন। সততা, সাহস, ঈমান আর ধৈয্যের পরীক্ষায় তারা যে সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেটা শত্রুদেরও পিলে চমকায়া দিত। খারেজিরা জীনে-ভূতে বিশ্বাস করতো না, জাদুটোনায় আস্থা রাখতো না। আমাদের স্টান্ডার্ডে তাদের খুবই কর্কশ আর রূঢ় মনে হবে, কিন্তু মহাশয় খেয়াল রাখবেন, নিষ্ঠূর একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়া তাদের শত শত বছর টিকে থাকতে হৈছে। অন্যাযভাবে শত্রুকে খুন করছে, এই রকম নজির তাদের শত্রুরা তেমন একটা দেখান না, রক্তপাতের কথা আছে অবশষ্য প্রচুর। কিন্তু তাদের একটা বাহিনী পরাজিত বা বন্দি হলে কোনদিন মাফ পায় নাই।
খারেজিরা তাইলে কেন হারল? কারণটা খুব সোজা। এইটা এমন একটা আদর্শের ভ্রুন, যেটার জন্য দুনিয়া তখনও পোক্ত হয় নাই। প্রাচীন সাম্যবাদ তাই কখনো টেকে নাই, কারণ মানুষের অবসর আর প্রাচুর্য একই সাথে এই দুই চাহিদা মেটাবার মত প্রযুক্তির বিকাশ তখন হয় নাই। তাই বলে যে আদর্শ এই মাত্র মনে জন্ম নিল, সে কি শুধু ভাবের খেলা হিসেবেই থাকবে? খারেজি নামের ভাব তাই মাঠেও খেলা করতে নামল। আসলে এইটা ছিল একটা স্বাধীনতার যুদ্ধ, ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে ইসলামের আদর্শের বহুস্তরের লড়াইয়ের একটা ফর্ম।
রাজনৈতিক দর্শনের দিক দিয়া তাই খারেজি নৈরাষ্ট্রিক। খারেজিদের লেখালেখি এমনিতেই ছিল খুব কম, তাও আবার অধিকাংশই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। খারেজিরা রক্ষা পেয়েছে তাই শুধু শত্রুর বর্ণনাতেই।
খারেজিদের নিয়া আরও জানতে চান? ড. আহমেদ আমীন এর লেখা দুহহাল ইসলাম নামের কয়েক খন্ডের একটা বই আছে, মিশরী্ রূদ্ধশ্বাস একটা বর্ণনা পাইবেন। ভালকথা, আমীন সাহেবের মত হৈল মুতাজিলি নামের সম্প্রদায়টি আসলে খারেজিদের কিছুটা নাগরিক জ্ঞান-জগতীয় সংস্করণ, কিছু পার্থক্য সমেত। আর পড়তে পারেন লায়লা আহমেদের একটা বই, ওমেন অ্যান্ড জেন্ডার ইন ইসলাম।
আরও বলি, খারেজিদের আর একটা আরও উত্তরসূরি ছিল, তাদের নাম কারামাতিয়া। ধর্মতত্ত্বের হাতিয়ার দিয়া রাষ্ট্রকে লড়াই করার দিক দিয়া তারা ছিল অনন্য।
খারেজিকে নিয়া একটা কবিতা লেখছিলাম, কিন্তু এইটা একট বৈষ্ণবমার্কা হয়া গেছে। কি করা, বঙ্গীয় জলহাওয়ার দোষে দুষ্ট।
এপিটাফ
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১২ রাত ১২:৪৫