somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এনথ্রাক্স বা তড়কা রোগ

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভূমিকাঃ
এনথ্রাক্স একটি অতি প্রাচীন রোগ। গ্রীক, রোমান এবং হিন্দু পুরাণে এর উল্লেখ আছে। এর অন্য নাম তড়কা, ব্ল্যাক ব্লাড।

এনথ্রাক্স জীবাণুঃ
যে জীবাণু দ্বারা রোগটি হয় তার নাম ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস(Bacillus anthracis)। এটি একধরণের গ্রাম পজিটিভ ব্যাক্টেরিয়া। এই জীবাণুর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি প্রতিকুল পরিবেশে স্পোর তৈরি করে অনির্দিষ্টকাল বেঁচে থাকতে পারে। অনুকুল পরিবেশে এরা স্পোর ভেঙ্গে ফেলে এবং বংশবৃদ্ধি করে। জীবাণুটি বিভিন্ন রকমের টক্সিন তৈরি করতে পারে যাদের এক্সোটক্সিন বলা হয়। এই টক্সিনগুলোই বিভিন্ন রকমের রোগ এবং রোগজনিত জটিলতার জন্য দায়ী।

এনথ্রাক্স এর প্রকোপঃ
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় এনথ্রাক্স এর প্রকোপ খুবই কম। কিন্তু ভারত উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য-সহ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল,আফ্রিকা এবং ল্যাতিন আমেরিকায় এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ্যণীয়। জীবাণুযুদ্ধে এনথ্রাক্স জীবাণু ব্যবহৃত হয়; চিঠি বা প্যাকেটের মাধ্যমে এনথ্রাক্স স্পোর ছড়িয়ে দেয়া হয় অথবা বড় পরিসরে ছড়ানোর জন্য এনথ্রাক্স জীবাণু এরোসল আকারে স্প্রে করা হয়।

কারা আক্রান্ত হয়ঃ
এনথ্রাক্স মূলতঃ গবাদি পশুর (যেমনঃ গরু, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া) রোগ। পাখিদের এ রোগ হয় না। এনথ্রাক্স স্পোর, যা মাটিতে বছরের পর বছর টিকে থাকতে পারে তা গবাদি পশু ঘাস খাওয়ার সময় খেয়ে ফেলে এবং আক্রান্ত হয়। মানুষ বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হতে পারে। মানুষের ত্বকের মাধ্যমে সাধারণতঃ এনথ্রাক্স জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু ত্বকে যদি অতিক্ষুদ্র ক্ষতও থাকে তবে জীবাণু ত্বকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। যে কোন শ্রেণীর, লিঙ্গের এবং বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এনথ্রাক্স বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই গবাদিপশুর লালন-পালন, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং পশুজাত দ্রব্যাদির শিল্প সম্পর্কিত মানুষের বেশী হয়, এজন্য তরুণ এবং মধ্যবয়সী কর্মক্ষম মানুষের এ রোগ বেশী হয়। আবার এনথ্রাক্স আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে যে কারও এ রোগ হতে পারে, কারণ স্বাভাবিক রান্নার তাপে এর স্পোর নষ্ট হয় না। এনথ্রাক্স যখন জীবাণু অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন যে কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারে।

রোগের ধরনঃ
এনথ্রাক্স জীবাণু মানুষের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে এবং আক্রান্ত অঙ্গ অনুযায়ী রোগের ধরনও বিভিন্ন রকম হয়। যেমনঃ

১। ত্বকের(cuteneous)এনথ্রাক্সঃ এনথ্রাক্স আক্রান্ত পশু অথবা এনথ্রাক্স স্পোর দ্বারা দূষিত পশুর পশম, চুল বা চামড়ার সংস্পর্শে এলে এনথ্রাক্স স্পোর মানুষের ত্বকের অতিসূক্ষ্ণ ক্ষত দিয়েও প্রবেশ করতে পারে। এ অবস্থায় সাধারণতঃ ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ত্বকের ক্ষত তৈরি হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষত দুই হাতে মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ঘাড় এবং মাথাও আক্রান্ত হতে পারে। ত্বকে ধীরে ধীরে ঘা তৈরি হয় যা ২-৩ সেমি আয়তনের হয়ে থাকে এবং ঘা এর চারদিকের ত্বক একটু উঁচু হয়ে থাকে। ক্ষতে চুলকানি থাকে তবে ব্যথা থাকে না।

২। শ্বশনতন্ত্রীর(inhalational) এনথ্রাক্সঃ
এনথ্রাক্স জীবাণুর স্পোর যদি শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরুর দিকে হাল্কা জ্বর, খুশখুশে কাশি এবং বুকে অল্প ব্যথা হয়। পরবর্তীতে তীব্র জ্বর, শ্বাসকষ্ট, শরীর নীল হয়ে যাওয়া, শরীর বেশী ঘেমে যাওয়া, কাশির সাথে রক্ত বের হওয়া, বুকে ব্যাথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।

৩। মুখবিবরীয়(oropharyngeal) এনথ্রাক্সঃ
এনথ্রাক্স স্পোর খেলে এ অবস্থা দেখা দেয়। গলাব্যথা, খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া এর লক্ষণ। এক্ষেত্রে মুখের তালু বা মুখবিবরে(pharynx) ক্ষত দেখা দেয়।

৪। পরিপাকতন্ত্রের(intestinal) এনথ্রাক্সঃ
এটাও এনথ্রাক্স স্পোর খেলে দেখা দেয়। বমি অথবা বমিবমি ভাব, অস্বস্তি, পেটব্যথা, রক্তবমি, বারবার রক্তযুক্ত পায়খানা হওয়ার সাথে জ্বর হয়।

৫। সেপটিসেমিক(septicaemic) এনথ্রাক্সঃ
এটি এনথ্রাক্স জীবাণুর দুর্দম ইনফেকশনের জন্য হয়। শ্বসনতন্ত্রীর(inhalational) এনথ্রাক্স এর জটিলতা থেকেও এটি হতে পারে। রক্তের মাধ্যমে জীবাণু সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, বংশবৃদ্ধি করে এবং টক্সিন তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে রক্তক্ষরণ ঘটায়। এই রক্ত গাঢ় কালো রঙের। আক্রান্ত গবাদিপশুর ক্ষেত্রে পশুর মৃত্যুর ঠিক আগে অথবা মৃত্যুর পরপরই শরীরের বিভিন্ন ছিদ্র থেকে কালো রক্ত বের হয়ে আসে। এ ধরণের রোগ খুবই ভয়ংকর।

৬। এনথ্রাক্স মেনিনজাইটিস(anthrax meningitis)ঃ
উপরের যে কোন ধরণের রোগ থেকে এটা হতে পারে।এক্ষেত্রে জীবাণু প্রথমে রক্ত এবং তারপর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে(CNS) প্রবেশ করে।

রোগের পরিণতিঃ
বেশীর ভাগ এনথ্রাক্স ত্বকের এনথ্রাক্স, যা চিকিৎসা করলে, এমনকি চিকিৎসা না করলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভাল হয়ে যায়। অন্যান্য ধরণের এনথ্রাক্স এর পরিণতি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই খারাপ। এর মধ্যে সেপটিসেমিক এনথ্রাক্স এবং এনথ্রাক্স মেনিনজাইটিস এ মৃত্যহার খুবই বেশী। শ্বসনতন্ত্রের এনথ্রাক্স চিকিৎসা করলেও মৃত্যুহার প্রায় ৪৫%। পরিপাকতন্রের এনথ্রাক্স নির্ণয় করা খুব কঠিন এবং এতে মৃত্যহার ২০-৬০%।

রোগ নির্ণয়ঃ
ত্বকের এনথ্রাক্স রোগীর গবাদি পশুর সংস্পর্ষে আসার ইতিহাস এবং ক্ষতের ধরন দেখেই বুঝা যায়। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্ষত থেকে রস নিয়ে নির্দিষ্ট উপায়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করলে জীবাণু দেখা যায়। শ্বাসতন্ত্রের রোগ সন্দেহ করলে বুকের এক্সরে, সিটি স্ক্যান করা হয়। সেপটিসেমিক এনথ্রাক্স নির্ণয় করার জন্য ব্লাড কালচার করা হয়। মেইনজাইটিস সন্দেহ হলে লাম্বার পাংকচার করে সেরিব্রোস্পাইনাল রস পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া ELISA নামক পরীক্ষাও এ রগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।

চিকিৎসাঃ
ত্বকের সংক্রমণের ক্ষেত্রে রোগীকে বহিঃবিভাগেই চিকিৎসা দেয়া যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্বাবধানে হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে। বিভিন্ন রকমের এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এনথ্রাক্স রোগের চিকিৎসায় পেনিসিলিন কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এছাড়া কুইনোলন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক (যেমনঃ সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লেভোফ্লক্সাসিন, গ্যাটিফ্লক্সাসিন), ডক্সিসাইক্লিন, এমক্সিসিলিন, এম্পিসিলিন, ক্লোরামফেনিকল ইত্যাদি এরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

প্রতিরোধঃ
মানুষের জন্য এনথ্রাক্স এর প্রতিষেধক(vaccine) আবিষ্কৃত হলেও তা দুষ্প্রাপ্য। তাই গবাদিপশুকে টীকা দেয়ার মাধ্যমে এনথ্রাক্স প্রতিরোধ করা যেতে পারে। আক্রান্ত পশু মারা গেলে মাটিতে পুঁতে না ফেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এনথ্রাক্স আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কুইনোলন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক অথবা ডক্সিসাইক্লিন ৬০ দিন সেবন করতে হবে।
…………………………………………………………………………………………..

ডা. এ.বি.এম. কামরুল হাসান (রাঙা)
সহকারী সার্জন,
পাইস্কা ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র,
ধনবাড়ী, টাংগাইল।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৫২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×