“ কি করেন আপনি ? ”
“ আমার কার্যক্রমের সাধারণ বৈশিষ্ট্যে সমাজ আমাকে একটা সৃষ্টিশীল দলের অন্তর্ভুক্ত করে। আমি নিজেকে কারিগর বলি। ”
“ এত পেচিয়ে কথা বলেন কেন? সোজা বাংলায় বলুন; আপনার পেশা কি? ”
“ বাংলাতেই বলেছি। হিন্দি মুভি- সিরিয়াল দেখার অভ্যাস নেই আমার। যাক গে, আমি কাগজের মুখ বানাই। তারপর সে কাগজ বেঁচে খাই। ”
এবার বেশ রেগে গেল রমণী। এটা বুঝেছি বলেই তার চেয়ারের কাঁপুনিতে ভুমিকম্পের আতঙ্কে মুখ শুকায় নি। এ ধরণের পরিস্থিতি আমার জন্য খুব ই বিরক্তিকর, সাথে চিন্তার ও। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীতে অনেক কাগজ এখন ও শুধু আমার দিকে চেয়ে আছে বলার শক্তি পাওয়ার আশায়।
পরমাত্মার সৃষ্ট কূল পরমাত্মার মুখাপেক্ষী হবে, মানুষের সৃষ্ট কূল মানুষের মুখাপেক্ষী হবে – এটাই স্বাভাবিক। যদি ও সৃষ্টির এ খেলার মুল নকশাকার ও পরমাত্মা নিজেই , কিন্তু তিনি কেন যেন মানুষের সৃষ্ট কূলের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। তবে অন্য কোন গোপন ফন্দি আঁটছেন কিনা তিনি ই জানেন।
সে যাই হোক, আমার অগণিত মুখাপেক্ষী কে মর্মাহত করে আমাকে এত আগে কাছে ডাকার মত অজ্ঞ তিনি নন- এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
“ ও আচ্ছা, তো আপনার মত মহান কারিগরের কাগজের মুখ কোন হিতৈষীরা কেনে; শুনি। ” রমণীর কণ্ঠ অধৈর্য হয়ে উঠছে।
দেশী ওল্ড রামের বোতলটা কাল। বোতলের সরু গলার ওপর বসান সোনালি মুখটা বরাবরই এক অনন্য আকর্ষণীয় ব্যাপার। সব ঝাঁঝাল আকর্ষণ ওই মুখের পেছনে।
কাল গাউনের ওপরে হালকা তামাটে চেহারার ঝাঁঝাল মুখটা আমার কাছে তেমনি লাগছে।
রবি বাবু বা হুমায়ন সাহেবের মত উঁচু দড়ের সাহিত্যিকরা মেয়েটার রুপ বর্ণনা কাগজে লিখলে, কাগজ খানা ও সব সময় বুকের কাছাকাছি রাখতে মন চাইত।
রসময় বাবুর রচনার জন্য ও প্রাচুর্যের অভাব নেই। ও রসময় বাবুকে তো আপনারা আবার বাস্তবালয়ে চেনেন না। সে কথা থাক।
আপনারা আবার অন্য কিছু মনে করবেন না। আমার পেশায় একটু আধটু রঙিন পানি পেটে না ঢাললে আমার কাগজের মুখ গুলো বল পায় না। পরিচিত কিছু জ্ঞানীর ফ্রি উপদেশে জেনেছি, রবি বাবু , হুমায়ন সাহেবরা প্রাকৃতিক......
“ কথা কানে যাচ্ছে না আপনার। ” এবার মেয়েটা একেবারে চেঁচিয়ে উঠেছে।
“ ও হ্যাঁ, যা বলছিলেন। কাগজের মুখ শব্দ যুগল আক্ষরিক অর্থে ভুল। মুখওয়ালা কাগজ বলতে পারেন। ”
মেয়েটার হাতের কাছে পানির গ্লাস। তার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে , আমি বেশ অনিরাপদ।
তবু ও বলে গেলাম, “ আপনাদের মত জ্ঞানী-গুণীরাই কেনেন। কাগজের কথা শুনে জ্ঞানের ঝুলি ভরান। আমার বানান কাগজের কদর এখন ও কম হলেও, অনেক কারিগরের কাগজের কদর আকাশচুম্বী। ”
পেছনের দেয়ালে ঝোলান কাঠের বইয়ের তাকের দিকে ইঙ্গিত করলাম তর্জনী দিয়ে। মেয়েটার মুখ দেখে জ্বর মাপার মত রাগ মাপার একটা যন্ত্রের অভাব অনুভব করলাম মানব সভ্যতায়।
ঘরটাও লক্ষ্য করলাম এবার। দেয়াল গুলো হালকা টিয়া রঙের। আমার ডানে বামে বড় বড় দুইটা জানালায় ঝুলছে আকাশী রঙের পর্দা। উত্তর দক্ষিণ মুখি বাতাসে কিছুটা দুলছে। ঘরের পেছনের দিকে দুই কোনায় মেটে রঙের চিনামাটির টবে শ্বেতশুভ্র রজনীগন্ধা। তাজা আছে, এখন ও গন্ধ পাচ্ছি। বেশ মাপ মত একদম মাঝখানে বসান বেতের চেয়ার টেবিল।
ঘরের সাজ-সজ্জাতেই মেয়েটার উন্নত রুচিবোধের পরিচয় মেলে। যারা অনেক বেশি বাছাই করতে পারে, তাদের উন্নত রুচিবোধ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। তবে বাছাই তারাই করে, যাদের সামর্থ্য আছে।
যাদের খাওয়া জোটে না এক বেলা, তাদের “ কি দিয়ে খাব? ” প্রশ্নটাই বিলাসী কল্পনা। বেচারারা তাই উন্নত রুচিবোধ গড়ে তুলতে পারে না।
এ মেয়ে পেরেছে। কম বয়সেই আয়-রোজগার ভালই মনে হচ্ছে।
এই সংখ্যালঘু রুচিবান শ্রেণিদের একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। এরা কেন যেন ঐ বিরাট অরুচিবান গোষ্ঠীর প্রভু হতে চায়; প্রশংসা-স্তুতি, সমীহ-ভয় চায়। ছ্যা ছ্যা।
যার যত আছে, সে তত চায়- জানি। তাই বলে, এই নিচু রুচির মানুষের কাছে ও তাদের হাত পাততে হয়!!!!
“ আপনি নিজের মুখের চেয়ে কাগজের মুখে খই ফোটালেই ভাল করবেন। ” কিছুটা ব্যঙ্গ আর তাচ্ছিল্য মেশান কণ্ঠে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল মেয়েটা।
হঠাৎ মেয়েটার মোবাইল বেজে উঠল, “ মায়াবন বিহারিণী হরিণী। ”
আজিব। এ রিংটোন মেয়ে পটাতে ছেলেরা লাগাবে, মেয়েরা কেন? আসলেই অবাক ব্যাপার।
মেয়েটা কলটা ধরেই জি ম্যাডাম, জি ম্যাডাম করে মধু বর্ষণ করতে লাগল। আমার এক দুষ্ট বন্ধু আছে। সে মেয়েটার রিংটোন আর এখনকার কথার ধরন দেখলে এক চোখ ঠোঁটের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বলত, “ মামা, ডিফেক্টিভ ম্যাগনেট। ”
আমি জানি, এর মানে কি। সে ব্যাখ্যায় এখন যাওয়া ঠিক হবে না। শত হলে ও আমি একটা শিশুর লাশের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।
এই দেখুন, আসল কথাই বলা হয় নি।
আসলে মনোবিজ্ঞানের একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম একবার, “ আপনি জেনেশুনে বা অজ্ঞাতে যে কাজ বারবার করবেন- সেটাই অভ্যাসে দাঁড়াবে। ” পরীক্ষিত সত্য।
কত সুন্দর ব্যাপার। কেও প্রতিদিন অপ্রয়োজনে বৈদ্যুতিক সুইচ আর পানির ট্যাপ বন্ধ করলে – সুন্দর একটা দেশবান্ধব অভ্যাস দাঁড়াবে তার। কিন্তু মানবের আদিম প্রবৃত্তির কারনেই সম্ভবত পর্ণ দেখা, নেশার মত নিষিদ্ধ অভ্যাসগুলো বেশি গড়ে তোলে।
নেশার কথা বলছি বলে আমার দিকে বাঁকা চোখে দেখার কিছুই নেই। আগেই বলেছি, রঙিন পানি আমার পেশা গত প্রয়োজন, নেশা না। তাছাড়া অর্থেও কুলায় না।
নেশার কথায় মনে হল- শুনেছি, ফেসবুক নামে ভিটেমাটি ছাড়া এক আজব শহর বানিয়েছে কারা যেন ইন্টারনেটে। সেখানকার মানুষগুলো প্রায় সবাই ই নাকি অনেক দেশপ্রেমিক আর সাহসী। তারা সব কিছু নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারে। গতকাল ফুলকি কে নিয়েও নাকি তারা অনেক প্রতিবাদ করেছে। সরকার আর বিরোধী দলকে এক চোট গালি দিয়েছে। খুব ভাল। শহরটাতে থাকাও নাকি নেশার মত অভ্যাস।
ও বলছিলাম অভ্যাস নিয়ে। আমি ঐ আর্টিকেল টা পড়ার পর থেকে, অনবরত কঠিন কথা বলে আর চিন্তা করে – প্রখর মস্তিস্ক বজায় রাখার অভ্যাস করছি।
আচ্ছা ঠিক আছে ভাই, আসল কথায় আসছি। গত পরশু বিকালে টি.এস.সিতে একা একা বসে চা-বিড়ি খাচ্ছিলাম। নির্বাচন নিয়ে আলোচনা সবার মুখে মুখে। আমি আমার গল্পের উপকরণ খুঁজছিলাম, সবার গতিবিধি দেখছিলাম।
জানেন তো, এবার সম্পূর্ণ সুষ্ঠ ও সাংবিধানিক একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল দল নির্বাচনে যায় নি। ভাল হয়েছে, এক পক্ষীয় দল থাকায় ভোটে কোন মারপিট হয় নি। এমন কি আরও ভাল খবর হচ্ছে, অনেক জায়গায় ভোটেরই দরকার হয় নি। দেশের অনেক টাকা বেঁচে গেছে।
তো বিরোধী দল কি না কি সংবিধান পরিবর্তনের দাবি করছে। জামায়াত নাকি এই গণতান্ত্রিক দাবিতে সমর্থন দিয়েছে। বি এন পি ও কম কি। জামায়াতের বড় বড় নেতাদের গ্রেফতার করে কিসের নাকি মিথ্যা বিচার করছে সরকার। বিএনপি সব সময় সত্যের পক্ষে। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা জামায়াতের সাথে থাকবে জানিয়েছে। বিনিময়ের এই আদিম প্রথা বড় দল গুলো এখন ও লালন করছে। সত্যি ই আনন্দের ব্যাপার, তারা শেকড়কে ভোলে নি।
তো এ নিয়ে নাম না বলি, জামায়াতের এক নেতা সেদিন বিএনপির জনসভায় এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন। উনাকে দেখে আমার খুব ভাল লেগেছে। উনি আমার দেশের মানুষ। বাবার কাছে শুনেছি, খুবই পরহেজগার লোক উনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব মালাউন-নাস্তিক পাকিস্তানের বিরোধীটা করেছিল, উনি যত টা সম্ভব তাদের ধরে পাকিস্তানী মিলিটারিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিছু মেয়েছেলে নিয়ে ও কি যেন করেছিলেন। ছোট ছিলাম বলে বাবা আর কিছু বলেন নি। যুদ্ধে তারপক্ষ হারলেও তিনি এখন ভাল অবস্থানে আছেন, ভাল নেতা। গত বারের আগের বারের সরকারে মন্ত্রী ও হয়েছিলেন। আসলে ভাল মানুষের সাথে কখন ও খারাপ হয় না।
যাই হোক, আমার দেশ বিষয়ে আগ্রহ কম। কাগজের কারিগর মানুষ। আমি জন্মেছি দেশ ও সময়ের উরধে সাহিত্যে বিরাট অবদান রাখার জন্য। পেপার-পত্রিকা, বই-পুস্তক পড়ার সময় ও পাই না চিন্তা করতে করতে, ইচ্ছা ও হয় না। পাছে না আমার মৌলিকত্ব নষ্ট হয়। তবে টুকটাক সামনে পড়লে বিজ্ঞানের প্রবন্ধ পড়ি। পরীক্ষিত ব্যাপার বলে কথা।
এই দেখুন, আবার কোথাকার জল; কোথায় নিয়ে এলাম। সেদিন বিকালে টি.এস.সির দিকে শাহাবাগ থেকে নির্বাচনের সফলতায় একটা আনন্দ মিছিল এগিয়ে আসছিল। একই সময়ে দোয়েল চত্বরের দিক থেকে নির্বাচন বিরোধী একটি মিছিল এগিয়ে আসছিল। মোড়ের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম, অনেকগুলো টিভি ক্যামেরা আনন্দ মিছিলটাকে কাভার করছে। হঠাৎ করে দুই মিছিলের মাঝে ইটপাটকেল ছোঁড়াছুড়ি শুরু হল। কান ফাটান শব্দে বুঝলাম ককটেল ও ফাটছিল। যে যেদিকে পারে দৌড়াচ্ছিল। আমি দোয়েল চত্তর রোডে ডাচ বাংলা ব্যাংকের বুথের ভিতরে ঢুকে পড়লাম দৌড়ে। একাই ছিলাম। দরজা কিছুটা ফাক করে দেখছিলাম ভয়ে ভয়ে। মনে আছে তো আপনাদের, ভয় পেলেই আমার সেই মুখাপেক্ষীর ব্যাপার টা মনে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে আমাকে ফেলার জন্য তার প্রতি কিছু টা বিরক্ত ও হই অবশ্য।
বেশির ভাগ ক্যামেরা শুধু নির্বাচন বিরোধী মিছিল থেকে ইট পাটকেল ছোঁড়া দেখাচ্ছিল। আনন্দ মিছিলের দলের দিকে তেমন কোন ক্যামেরাই নেই।
আমি বুদ্ধিমান, বিধায় বুঝে ফেললাম। সরকারি সমর্থক রা দেশ প্রেমিক, জনগণের হিতৈষী। তাদের প্রতি ছোট্ট আঘাত ও বড় করে দেখান দরকার। আঘাতকারিরা স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি, ঐ সব তরুণরা বাংলাদেশের বিপক্ষে। এদের প্রকৃত রূপ জাতিকে অবশ্যই জানতে হবে। তবে সরকারি সমর্থকরা কাওকে আঘাত করলে তা দেখানোর কিছু নেই। নিশ্চয়ই এতে কল্যাণ আছে।
হঠাৎ রাস্তার ঐ পাড়ে সোহরাওয়ারদির গেট থেকে দশ-বার বছরের একটা মেয়ে এদিকে দৌড়ে আসার সময় মাথায় একটা ভাঙা ইটের টুকরো গেঁথে গেল। সে প্রায় বুথের সামনে এসে পড়ে গেল। রাস্তার ঐপাশ থেকে অনেক গুলো সাংবাদিক ক্যামেরা মেয়েটাকে কাভার করতে শুরু করল। ব্যাটাদের সাহস আছে বলতে হয়।
কবি বলেছেন, “ চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ সেথা শির।। ”
মেয়েটা কাতরাচ্ছিল। কাতরানি দেখে দুই হাত দূরে ডিভাইডারের সামনে দাঁড়ান পাঞ্জাবি পড়া ছেলেটা যেন গর্জে উঠল। ফুলের মত নিস্পাপ মেয়েটির কাতরান ছেলেটির রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল। মানবতার প্রতি এ নিষ্ঠুর আঘাত যে সরকারী সমর্থকদের ছোঁড়া ঢিলের আঘাতে হয়েছে, তা যেন সে এক দৈব বানীতে নিশ্চিত হল। আরবি জাতীয় কিছু একটা বলে বাঁশ হাতে সে তেড়ে গেল বিপক্ষ দলের দিকে। একটা ককটেল ফাটার শব্দে আমি বুঝতে পারলাম না তার কথা।
দশ-পনের মিনিট থেকে মেয়েটা কাতরাচ্ছিল। ক্যামেরা কাভারেজ আর ইট পাটকেল নিক্ষেপ চলছিল সমান তালে। তখন ও সাধারণ মানুষ অনেকে মেয়েটার সামনে দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। সম্ভবত তারা মেয়েটাকে মনে মনে ডেকেছে। কারন তারা নিষ্ঠুর নয়। আমি নিশ্চিত তারা একটু দূরে গিয়ে অনেক আফসোস করবে মেয়েটার জন্য। কিন্তু যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে, তবে একলা পালাও রে। মানে চলোরে আর কি।
গোলযোগ টা শাহাবাগের দিকে কিছুটা সড়ে যেতেই মেয়েটার জন্য আমার মায়া, আমার ভয় কে ছাড়িয়ে গেল কেন যেন। আমি মেয়েটাকে তুলে নিয়ে বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়ে মেডিক্যালের দিকে দৌড় দিলাম। দুই একটা টিভি ক্যামেরা ও আমার পিছু ছুটল। দোয়েল চত্বরের কাছে আসতেই মাইক্রোফোন হাতে এক নারী সাংবাদিক এগিয়ে এসে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করল, “ তোমার অনুভুতি কি? ” আমি দাঁড়িয়ে গেলাম একটু।
ফুলকি চোখ বড় বড় করে সম্ভবত ঘৃণা চোখে তাকিয়ে হালকা কিছু একটা শব্দ করে অজ্ঞান হয়ে গেল। আমার ভারী রাগ হল। সাহসী নারী আমার বরাবরই পছন্দ।
ফুলকি মেয়েটা নারী হয়ে নারীকে সম্মান দিল না। হঠাৎ মনে হল শব্দ এদিকে আসছে। আমি ফুলকিকে নিয়ে দিলাম আবার দৌড়।
ও মেয়েটার হাতে ফুল ছিল, সম্ভবত ফুল বিক্রি করত। আমি মনে মনে নাম দিয়েছি ফুলকি।
ঢাকা মেডিক্যালে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিডিয়ার কল্যাণে হিরো হয়ে গেছি। এটাই কাল হয়ে গেল আমার। দুই দলের নেতারাই ফুলকি মেয়েটাকে দেখে গেল।
সরকারী দলের মন্ত্রী এলেন রাত আট টায়। বিরোধী দলের এক বড় নেতা এলেন রাত দশটায়। সাংবাদিক ক্যামেরা এসব তো ছিলই। দুই দলের নেতাই ক্যামেরার সামনে আমাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে বাহবা ও ধন্যবাদ দিলেন। এহেন নিন্দনীয় কাজের জন্য বিপক্ষ দলকে দায়ী করে তাদের বিচার দাবি করলেন।
দুজনই আড়ালে অবশ্য আমাকে তাদের পক্ষে বলার জন্য লোভ আর ভয় দুটোই দেখালেন। সেটা অবশ্য কেও জানতে পারে নি।
ঘটনার একদিন পেড়িয়ে গেছে। ফুলকি মারা গেছে। একদিন মেডিক্যালেই ছিলাম। ব্যাচেলর মানুষ, একা থাকি। তাই কোন সমস্যা নেই। আমাকে আজ বড় গাড়িতে করে এই উকিল সাহেবার চেম্বারে আনা হয়েছে।
শুনেছিলাম, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রিসিপসনিষ্ঠ রাখা হয় সুন্দরী রমণীদের। নেতারাও ভাল ব্যবসা বোঝেন, উকিল সাহেবাকে দেখে বোঝা গেল। নিজের প্রশংসা আর কি করব, আমার আবার তুলনায় মস্তিস্ক অত্যন্ত প্রখর।
ফোনে কথা বলা শেষ করে, মেয়েটা আমাকে একটা প্যাকেট দিল।
“ এটাতে দুই লাখ টাকা আছে। অন্তত ছয় মাস যেন আপনাকে ঢাকাতে না দেখা যায়। সোজা কল্যাণপুর যাবেন। বাসে উঠে দূরে কোথাও চলে যান। ”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। সরাসরি প্যাকেট টা পকেটে ঢুকিয়ে সালাম- টালাম না দিয়েই বের হয়ে এলাম।
বনানী সৈনিক ক্লাবের কাছে দেখছি, চার পাঁচশ কম বয়সী ছেলে মেয়ে, সম্ভবত ছাত্রছাত্রী- একটা ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
“ আলেয়া হত্যার বিচার চাই। সরকারী ভার্সিটির অনিয়ন্ত্রিত ছাত্র-রাজনীতির প্রতি তীব্র নিন্দা।”
এবার বুঝলাম, ফুলকির আসল নাম আলেয়া।
মাইক হাতে একজন বলছে, “ এখন আপনাদের মাঝে বক্তব্য রাখবেন, ফেসবুকের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, ৫০ হাজার ফলোয়ারের অধিকারী, আমাদের সবার প্রিয়, বি এল এল, জি ঠিক চিনেছেন, BANGLA LANGUAGE LOVER ”। তুমুল করতালি শোনা যাচ্ছে। সরকারী দল- আর বিরোধী দলের নেত্রীকে সালাম জানিয়ে চারপাশের বি এল এল ভাই উদ্দীপ্ত কণ্ঠে ভাষণ শুরু করলেন। হুম বুদ্ধিমান বলতে হয়। অন্য কে রাগিয়ে কোন কাজ করা কঠিন।
ছেলেমেয়েগুলোর দিকে একটু নজর ফেরালাম। পেপারের বিনোদন পাতায়, আর টিভি তে টুকটাক হলিউড, বলিউডের নায়ক নায়িকাদের দেখেছি। প্রায় অর্ধেক ছেলেমেয়দেরই তাদের মত বেশভুষা, চুলের কাটিং। কি সুন্দর পরিপাটি চেহারা। দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়।
কারো কারো হাতে আবার রঙিন প্ল্যাকার্ড।
“ শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নয়, খাঁটি বাংলা সংস্কৃতির চর্চা চাই। ”
বেশ খরচা করে বানান প্ল্যাকার্ড গুলো যেন জ্বলজ্বল করছে।
আমার ভারী রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। ভুল তথ্য জানতাম। ফেসবুক শহরের মানুষেরা বাস্তবে ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। তবু ও মন আনন্দে ভরে গেল কেন যেন।
এবার আমি অন্যদিকে সি এন জি খোঁজায় মন দিচ্ছি। এত টাকা নিয়ে বাসে ওঠা যায় না। তাছাড়া অনেক দিন সিএনজি তে উঠি না। তাড়াতাড়ি করছি যেন কেও চিনে না ফেলে। মিডিয়ার কল্যাণে বেশ পরিচিত হয়ে গেছি এক দিনেই।
একে তো এত টাকা নিয়ে কারো প্রশংসা শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তাছাড়া অন্য ঝামেলা আছে।
সিএনজিতে উঠে বসেছি। ফুলকিকে মনে পড়ছে। ওর জন্যই তো এবার আমার প্রথম বই বের হবে। নাম দেব “ ফুলকি আমার কাগজের মুখ ”। পেশা নিয়ে আর কাওকে মিথ্যা বলতে হবে না।
বেঁচে থাকলে ওর সব ফুল কিনে নিয়ে ওকেই উপহার দিতাম।
টাকা তো আছেই। তবে বই এর টাকা কে দিল? তা তোকে ও বলতে পারব না। নিষেধ আছে।
ফুলকি তোকে অনেক ধন্যবাদ।
উপরোক্ত গল্পে প্রকাশিত স্থান ব্যতিত কাল ও সকল চরিত্র লেখকের কল্পনা প্রবণ ইতিবাচক মনের বহিঃপ্রকাশ। গল্পের পুরো বা আংশিক অংশ অতীত বর্তমানের জীবিত বা মৃত কারো সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়।