somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৩৬ বছর বয়স, অবিশ্বাস্য। মনে হলো এইতো সেদিন। বাবা মাতাল হয়ে ঘরে ফিরলেন। অকারণে মাকে পিঠালেন। মায়ের কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে। আমরা বোবা হয়ে চেয়ে আছি। কত রাত না খেয়ে ঘুমিয়েছি। সেই হিসাব নেই। শুধু হিসাব করেছি- ঘুরে দাঁড়ানোর। অনেক বলেন- মোটিভেশন না হলে কাজ শুরু করা যায়না। কথাটা মিথ্যা। সত্যি হলো- কাজ শুরু করে দিলে মোটিভেশন এমনিতেই চলে আসে।

সপ্তাহে দু দিন স্কুলে গেলে- পাঁচদিন বাবার সাথে বাগানে মালির কাজ করতে হয়। বাবা ছিলেন সিটি কর্পোরেশানের মালি। ড্রাগ ছাড়া তার চলেনা। শুধু বাবা যে মাতাল ছিলেন তা না। বাবার বন্ধুরাও ছিলো মাতাল। কেউ মুঠে গিরি করতো। কেউ দিন মজুরের কাজ করতো। কেউ ময়লা ড্রেন পরিষ্কার করতো। আর মা ছিলেন রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি। সব বড় বড় স্টাররাই কোনো সময় তার দরিদ্রতার কথা বলে। আমিও বলছি। তবে একটা বিশেষ কারণে। সেই বিশেষ কারণটা একেবারে শেষে বলছি।

বাবার সাথে কাজ শেষ করে স্কুলে পৌঁছাতে যথারীতি দেরি হয়। স্যার বকলেন। শুধু বকলেন না। অপমানও করলেন। মাতালের ছেলে বলে উপহাস করলেন। বাবা মাতাল হলেও - অন্য কারো বাবাকে মাতাল বলার অপমান সহ্য করতে পারলাম না। সবাই ভুল করে। আমিও করলাম। স্যারের দিকে চেয়ার ছুঁড়ে মারলাম। শাস্তি হলো। স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হলাম। প্রখর রোদে পথে পথে হাঁটছি। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। এতো ক্ষুধা নিয়ে যাবো কই। খাবো কি? শৈশব নাকি স্মৃতিমধুর। আমার শৈশবটা ছিলো পুরোটাই ক্ষুধাতুর।

পড়ালেখায় মন বসেনা। পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে যাই। স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার এক বছরের মাঝে ঘটে অঘটন। খেলার মাঠেই চোখে অন্ধকার দেখি। মনে হলো- এই বুঝি জীবন শেষ। চোখ খুলে দেখি হাসপাতালে। "রেসিং হার্ট" নামক এক অস্বাভাবিক রোগে আক্রান্ত। সার্জারির পর জীবন ফিরে পেলেও- ডাক্তাররা জানালেন- জীবন বাঁচাতে চাইলে মাঠে ছেড়ে দিতে হবে। আমি মাঠ ছাড়লেও মাঠ আর আমাকে ছাড়লোনা। বাবার নেশা ছিলো ড্রাগে। আমার নেশা হলো ফুটবলে। মা ফুটবলের ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন। মমতা দিলেন। সাহস দিলেন। আজকের এই আমি হওয়ার পিছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি আমার মা।

আমার প্রথম বল, প্রথম টিম, প্রথম গোল- প্রথম আয় সবটুকুতেই জড়িয়ে আছে আমার মা। মায়ের হাতে তোলে দেয়া ট্রফি। মায়ের চোখে জীবনের প্রথম আনন্দাশ্রু। সময় কত দ্রুত চলে যায়। ৩৬ বছরকে মনে হয় যেন মাত্র ৩৬ মিনিটের পথ। জীবন খুবই ছোট। মেডেরিয়ার এক দারিদ্রপীড়িত ছোট শহর থেকে লিসবন, লিসবন থেকে আলোকিত ম্যানচেস্টার, ম্যানচেস্টার থেকে মাদ্রিদ, মাদ্রিদ থেকে তুরিনের সর্বত্র আমি আমার সর্বোচ্চ উজাড় করে দিয়েছি। বিনিময়ে আমি পেয়েছি- কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা, পেয়েছি মানুষের শর্তহীন সমর্থন। যত ধন্যবাদই জ্ঞাপন করিনা কেন-মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসার কাছে তা অতি তুচ্ছ। পিতা-মাতা ছাড়া আমার জন্ম হতোনা, ফুটবল না থাকলে আমার খেলা হতোনা আর আপনাদের ভালোবাসা না পেলে আজকের এই আমি হতে পারতাম না।


২০০৪ সালে ইন্ডিয়ান ওশান আর্থক্যুইক আর সুনামিতে সব স্বজন হারানোর বেদনায় আট বছরের শিশু মারথুনিসের কান্না আমার হৃদয়ে হাহাকার তোলে। খেতে বসে টিভিতে শিশুটির ছবি দেখে আমার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়। ভাবলাম- শুধু খেলোয়াড় হিসাবে খ্যাতি লাভ করা আর বিলিয়ন ডলার আয় করাই কি আমার লক্ষ। আমি ইন্দোনেশিয়ায় ছুটে যাই। যত দান করতে থাকি- ততই নিজের মাঝে নতুন এক প্রশান্তি আসে। মেডারিয়া দ্বীপের যে হাসপাতালে মাকে চিকিৎসা দেয়- আমি সেখানে ছুটে যাই। এই দ্বীপে একটা ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করে দেয়ার সব দায়িত্ব গ্রহণ করি। নেপালের আর্থক্যুইক ৮০০০ মানুষ মারা যায়। বুভুক্ষু মানুষের মাঝে যেন নিজের শৈশব দেখি। চ্যাম্পিয়ন লীগের সমস্ত আয় বিলিয়ে দেই। রমজান মাসে ফিলিস্তিনের শিশুদের জন্য দান করি। ২০১২ সালে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বোটের অকশন থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ দান করি। ফুটবলের ইতিহাসে ১ বিলিয়ন ডলার আয়ের রেকর্ড যেমন আমার- আমি চেয়েছি- সর্বোচ্চ দানের রেকর্ডটিও যেন আমার হয়। তাই হয়েছে। ঈশ্বরের সামনে কেন শুধু আমি সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ড নিয়ে উপস্থিত হবো। এসব কথা না বললেও পারতাম। এজন্য বলছি। জীবনটা শুধু ভোগের নয়। এটা ত্যাগের। আমার খেলা যেমন অন্য খেলোয়াড়কে উৎসাহিত করবে। ঠিক তেমনি আমার দান ও যেন অন্য মানুষেরও অনুপ্রেরণা হয়। খেলোয়ার হিসাবে খেলা যেমন দায়িত্ব-মানুষ হিসাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোও আমাদের আরো বড় দায়িত্ব ।

যে কথা বলার জন্য শুরু করেছিলাম-এবার সেই কথাটি বলছি। আমার মায়ের কাছ থেকেই শুনা। অত্যন্ত দরিদ্র মায়ের পরিবার।সদস্য সংখ্যা অনেক। এর ওপর বাবা মাতাল। আমি যখন মাতৃগর্ভে- সিদ্ধান্ত নেয়া হলো-খাবারের ভাগে ভাগ বসাতে আমি যেন পৃথিবীর আলো না দেখি। সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। তারপর এক অলৌকিক দেবতা হাজির হলেন। ডাক্তার দেবতা। তিনি বললেন-এটা ভারি অন্যায়। ভ্রণ হত্যা পাপ। এতোবড় পৃথিবীতে কি আরেকটি শিশুর ঠাঁই হবেনা। আমি বেঁচে গেলাম। হয়তোবা না আসলেও পৃথিবীর এমন কোনো ক্ষতি হতোনা। আমার এ জায়গাটুকু অন্য কাউকে দিয়ে রিপ্লেস হতো। কিন্তু আমিতো এই ধরনী দেখা থেকে বন্চিত হতাম। তাই, কোনো ভ্রণ হত্যার আগে একটিবার ভাববেন- হয়তো এই ভ্রণের ভিতর অন্য কোনো এক ফুটবলার , অন্য কোনো ফিলানত্থ্রোপিস্ট, অন্য কোনো এক শিল্পী, অন্য কোনো এক সাধক লুকিয়ে আছে। অথবা বড় কেউ না থাকুক। অন্ততঃ একটা নিষ্পাপ শিশুতো এই ভ্রুনের ভিতর ঘুমিয়ে আছে।

সেই ভ্রণ শিশু হয়ে পৃথিবীতে এসে ৩৬ বছরে সুদীর্ঘ বিশটি বছরের প্রফেশনাল ফুটবল খেলোয়াড়ের পথ আজ আমি পাড়ি দিয়েছি। কিন্তু, দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে- আমি আজ এমন কোনো ওয়াদা করতে পারিনা- সামনের বিশটি বছরও আমার এমনি যাবে। আমার উচ্ছ্বল তারুণ্যের ক্ষয় হবে, যৌবনে বয়সের কালিমা পড়বে, সময়ের পথে বার্ধ্যকের দ্বার উণ্মোচিত হবে। তবে, এটুকু ওয়াদা করতে পারি- যতদিন বেঁচে থাকি- নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার শতভাগ থেকে এক তিল পরিমাণও কম হবেনা। সর্বোচ্চ দিয়ে যাবো। আর নিঃস্ব হয়েই পৃথিবীর মাঠে পা রেখেছি-একেবারে নিঃস্ব হয়েই- শুধু মানুষের ভালোবাসাটুকু বুকে নিয়ে দুনিয়া থেকে অনন্ত যাত্রা পথে ফিরে যাবো।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:৩৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×