ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়েছিলাম ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে ৯ মাস যুদ্ধ করে এই ভূখন্ড স্বাধীন হয়েছিল। আরেকটু বড় হয়ে শুনেছিলাম কিভাবে কৃষক, শ্রমিক, পুলিশ(তৎকালীন ইপিআর), সেনাবাহিনী সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবন বাজি রেখে সেসময় যুদ্ধ করেছিল। যতই শুনতাম ততই অভিভূত হতাম। মনে হতো, ইশ!! কেন সেই সময়ে জন্ম নিলাম না!!
কিন্তু আজকে যখন ৪২ বছর পরের বাংলাদেশের দিকে তাকাই তখন তো হিসাব মিলাতে পারিনা। এরাই কি সেই জাতি যারা নারী-পুরুষ-যুবক-বৃদ্ধ সকলে মিলে নিজেদের শোষনের শিকল থেকে নিজেদের মুক্ত করেছে? এতো ছোট একটা ভূখন্ডে মানুষে মানুষে এতো বিভেদ!! হিন্দু-মুসলিম, আস্তিক-নাস্তিক, সরকারী দল-বিরোধী দল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী-চেতনাবিরোধী, বামপন্থি-ডানপন্থি, বিএনপি-আওয়ামীলীগ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এরাই নাকি ১৯৭১ সালে একসাথে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল!! চিন্তা করি, এইমুহুর্তে আরেকটা যুদ্ধ লাগলে কি হতো?! সবাই কি পারতো ৭১এর মতো একসাথে হতে? যুদ্ধটা যদি ভারতের সাথে লাগতো তাহলে কি হতো! আমার তো মনে হয় কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও বর্তমান সরকারের কিছু মানুষ সরাসরি ভারতের পক্ষে চলে যেত! আমার চেয়ে ছোট অথবা সমান অনেক মানুষের ধারনা ভারত না থাকলে নাকি বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এদের মাথায় খুব চাতুরতার সাথে এই তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরা ভারত বলতে এতটাই অজ্ঞান যে সেখানকার সকল সংস্কৃতি, কথাবার্তা, পোষাক সবকিছুর অনুকরণ এদের জীবনের প্রধান গুরুত্ত্বপূর্ণ লক্ষ্য। প্রকৃতপক্ষে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামিক সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হওয়ার সূচনা হয় এখান থেকেই। মসজিদে সময় দেওয়ার চেয়ে গানবাজনা, মডেলিং, নাটক ইত্যাদি জরুরী হয়ে ওঠে। মেয়েদের হিজাবের বদলে জামার গলার ডায়ামিটার বাড়তে থাকে। সেঞ্চুরিয়ান ধর্ষনকারীরা তখন তাদের শিকারও সহজে সনাক্ত করতে পারে। ইসলামিক কথাবার্তা শুনলে মনে হয় কিসব বলে সময় নষ্ট করা!! হারাম-হালালের কথা শুনলে মনে হয়, এইসব না জানাই ভাল। জানলেই মানতে হতে পারে। কেউ ইসলামিক কথা বললে মনে হয়, বেটা মৌলবাদি, জঙ্গি। ভারতীয় অনুকরণে শুরু হয় রিয়ালিটি টিভি শো অথবা বাংলা নাটক।
দোষটা কাদের? এইযে এতো এতো মানুষ খুন, ধর্ষন, গনহত্যা, নিপিড়ন, চুরি, গুম, দূর্নীতি! কাদের জন্য বাংলাদেশের আজকে এই অবস্থা? আমেরিকা তো বাংলাদেশ হামলা করেনি, অর্থনৈতিক অবরোধও দেয়নি। বাংলাদেশ যে আজকে লিবিয়া, মিশর, সুদান অথবা পাকিস্তানের পরিনতি বরণ করতে যাচ্ছে তার জন্য্য দায়ী কে? ১৯৭১ সালের পরে আবার বাংলাদেশের মাটিতে গনহত্যা শুরু হয়েছে আজ ২০১৩ তে এসে। আওয়ামীলীগ চাচ্ছে তারা ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশে বসবাস করার যোগ্যতা রাখেনা। কারণ তারা ব্যতিত অন্য সবাই রাজাকার। আওয়ামী মিডিয়া দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে সরকারের সকল অপকর্ম ঢাকা দেওয়ার জন্য।
শাহবাগী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের খুব সাধারণ মানুষজনরাও এখন দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এই বিভক্তি এমনকি এখন আত্মীয়স্বজন, খুব কাছের বন্ধু, এমনকি পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে যেয়ে পৌচেছে। আমার খুব কাছের দুজন মানুষ আমাকে তাদের ফ্রেন্ডলিষ্ট থেকে কেটে দিয়েছে কারণ নাকি আমার চিন্তা-ভাবনা তাদের সাথে মিলে না। কি অদ্ভুত কথা! আমি তো একটা আলাদা মানুষ, আলাদা স্বত্তা। আমার চিন্তা-ভাবনা অন্যের সাথে মিলতেই হবে এমন তো কোন কথা হতে পারেনা। মাত্র এক লক্ষ ছাপান্ন হাজার বর্গকিলোমিটারের এই ভূখন্ড বিভিন্ন সমস্যায় ইতিমদ্ধ্যেই জর্জরিত। সম্পদ বলতেও তেমন কিছু নেই। সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে বাংলাদেশের জনশক্তি। অর্থাৎ মানুষ। জন্মের ৪২ বছর পরে যখন সব বিভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে আমাদের দিনরাত পরিশ্রম করার কথা, তখন আমরা মেতে আছি নিজেরা নিজেদের ধ্বংশ করার খেলায়। আমারই পাশের বাড়ির কোন মানুষকে যখন পুলিশ রাস্তায় গুলি করে মেরে ফেলছে তখন আমি মনে মনে অট্টহাসি হাসছি , কারণ সে আমার চেতনায় বিশ্বাসী ছিলনা। ভুলে গেছি যে দীর্ঘসময় সে আমার পাশেই বেড়ে উঠেছে। কলেজ-ভার্সিটিতে আমারই সহপাঠিকে ৩ তলার বারান্দা থেকে ছুড়ে নিচে ফেলে দিচ্ছি কারণ আমার হাতে ক্ষমতা। চোখের সামনে ঘটতে থাকা চুরি, গণহত্যা, গুমের মত অন্যায়ের সমর্থন করে যাচ্ছি শুধুমাত্র আমি যাদের পছন্দ করি তাদের সমর্থন করার জন্য। বিবেকের এরচেয়ে বড় অধঃপতন আর কি হতে পারে?
কোন দেশ এমনি এমনি তো উন্নত হতে পারে না। কোন জাতির ভাগ্য তো অন্য কোন জাতি এসে করে দিয়ে যায়না। বস্তুতঃ পৃথিবীর কোন অর্জনই বিনা পরিশ্রমে লাভ হয় না। প্রানপণ চেষ্টা, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, অসীম ধৈর্য আর অনড় অধ্যবসায়ের মাধ্যমে একটি দেশের উন্নতি সম্ভব হয়। আর এইসব কিছু করতে হয় সবাই একসাথে। সেইসাথে দরকার একজন ভাল নেতার। একটা ভাল সরকারের। যে সরকার নিজের দেশের প্রতিটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য পরিশ্রম করাটাকে নিজের চাকরী বলে মনে করবে। হোক সে তার আদর্শে বিশ্বাসী অথবা অন্য কোন মতের।
বাংলাদেশের এইমুহুর্তে এইগুলোর কোনটা বিদ্যমান?
দেশের জন্মের সাথে প্রতারনা করা কিছু হায়নার বিচার হোক সেটা কে না চায়? কিন্তু শাহবাগের আন্দোলনের সাথে আমি নিজেকে একত্র করতে পারিনি, কারণ আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিলাম যে এতো বছর পরে বিচারের নামে কিছু সাজানো নাটক মানুষে মানুষে বিভক্তি চড়মে নিয়ে যাবে। রক্তপাত ঘটাবে। অনেক মা তার সন্তান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে। অনেক পরিবার তার একমাত্র উপার্যনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে পথে বসবে। ৪২ বছর আগের প্রতিশোধ নেওয়ার চেয়ে ঠিক এই মুহুর্তে নিজেদের ভিতরের এই বিভক্তি অথবা অসংখ্য জীবনের দাম আমার কাছে অনেক অনেক বেশি ছিল। সরকার নিজে যদি নিজের দলের ভিতরে থাকা বিশ্বাসঘাতকদেরকেও বিচারের মুখে দাঁড় করিয়ে দিত তাহলে কারো কোন কথা বলার সুযোগই থাকতো না। আর তার সাথে সাথে অবশ্যই জাতিসংঘকে এই বিচারকার্যকে প্রত্যক্ষ করার অংশীদার করা উচিত ছিল। এসবের কিছুই হয়নি।
অনেকে আমার এই ভাবে চিন্তা করা কে ভাল চোখে নাও দেখতে পারেন। কিন্তু যারা আজকে শাহবাগে ২/৩ দিন কাটিয়ে “অ-তে অমুক, তুই রাজাকার-তুই রাজাকার” স্লোগান দিয়ে নিজেকে খুব দেশপ্রেমিক আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত মনে করছেন তাদের কে তো আমি গত চার বছরের অব্যাহত অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখিনি। যখন প্রাইমারী স্কুলের গরীব শিক্ষকরা অভাবে জর্জরিত জীবনের কথা বলতে সরকারের কাছে এসেছিল আর সরকার তার পুলিশবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে তাদের হত্যা করেছিল তখন তো শাহবাগীদের আমি সেই শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াতে দেখিনি?! যখন শেয়ারবাজার নামের জুয়ার আসর থেকে মাননীয় সরকারের মন্ত্রী-এমপিগণ মানুষের টাকা লুট করে নিজের নামে ব্যাংক আর টিভি চ্যানেল কিনতে ব্যস্ত ছিল তখন শাহবাগীরা তো এর প্রতিবাদে মঞ্চ বানায়নি। যখন নিজের দেশের সম্ভ্রম ধর্ষিতা হয়ে কাঁটাতারে ঝুলছিল তখন কোথায় ছিল এই দেশপ্রেম? করছে। তারা কোথায় ছিল যখন পুলিশ ১৫ বছরের কিশোর মিলনকে ছিনতাইকারী সাজিয়ে গণপিটুনির শিকার বানাতে বাজারের মাঝখানে নামিয়ে দিয়েছিল আর আমার দেশপ্রেমিক জনতা সত্য মিথ্যা যাচাই না করে একটা ছোট ছেলের জীবন নেওয়ার জন্য হামলে পড়েছিল। কতদিন লেগেছে এইসব কথা ভুলে যেতে? একটা কলেজে পড়া ছেলের পায়ে গুলি করে তার ভবিষ্যতকে পংগু বানাতে দেখে কাউকে তো একবারো কোন প্রতিবাদ জানাতে দেখি নাই। সবাই এইসব ভুলে গেছে, কারণ এরা কোন মন্ত্রীর আত্মীয় না, কোন দলের নেতাও না, কোন বুদ্ধিজীবীও না অথবা ব্লগারও না। এরা হচ্ছে সেই খেটে খাওয়া মানুষ যাদের কষ্টার্জিত টাকায় দেশ খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে চলে।
যারা শাহবাগে যেয়ে নিজের দেশপ্রেম প্রদর্শন করে তারা আসলে ভন্ড ছাড়া আর কিছুই না।
আজকে যারা বাংলাদেশকে নিয়ে এখনো আশা করেন, আমাকে প্লীজ জানাবেন কি তারা কি নিয়ে আশা করেন? এইমুহুর্তে দাঁড়িয়ে এই জাতিকে কি একত্র করা সম্ভব? এমন কোন নেতা কি পাওয়া সম্ভব যে মাহমুদ আহমেদিনেজাদের মত নিজের দেশকে ভালবাসবে? এমন কোন সরকার কি পাওয়া সম্ভব যারা শুধু মানুষের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করবে?
যদি সম্ভব না হয় তাহলে আমাদের পরিনতি কি? যে শিশুগুলো আজকে স্কুলের বেঞ্চে বসে স্বপ্ন দেখছে কোন একদিন সে প্লেন চালাবে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে? যে এতীম শিশুটি মাদ্রাসায় থাকছে কারণ তার মাথা গোঁজার কোন ঠাই নাই তার ভবিষ্যত কি?
আমরা যতই ১৯৭১ এ নিয়ে থাকি না কেন, জীবন সামনে এগুবে। আর ভবিষ্যতে যারা আসবে তারা বসবাসের অযোগ্য এক বিকলাংগ দেশ তৈরি করার জন্য আমাদের অভিশাপ দেবে।
সবাইকে বুঝতে হবে আমরা রাজনীতিবিদদের পাপেট না। আমাদের যখন যা বুঝানো হবে আমরা তাই বুঝবোনা। সরকারের বাহিনী আমাদের টাকায় খেয়ে পরে আমাদের টাকায় কেনা বুলেট আমাদের গায়ে ছুড়তে পারেনা। আমাদের জীবনের যদি নিরাপত্তা সরকার দিতে না পারে, তাহলে আমাদের টাকায় সরকারী লোকজনের জন্য নিরাপত্তারক্ষী রাখার কোন অধিকার নেই। সরকারকে বুঝাতে হবে আমাদের জীবনের দাম তাদের জীবনের চেয়ে কম গুরুত্বপুর্ণ হতে পারেনা। নিজে সমর্থন করি বলে সবাইকে একই আদর্শের সমর্থক হতে হবে এমন কোন কথা নেই। মনে রাখতে হবে, অন্যায় যার সাথে হচ্ছে সে আমার দেশেরই মানুষ, কারো ভাই, কারো বোন, কারো সন্তান।