তখন হাই স্কুলের সবচাইতে উপরের ক্লাসটাতে পড়ি । আমার এক আংকেলের বিয়ে ঠিক হলো । বিয়ের তারিখ ঠিক হলো । যথারীতি সব আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করা হলো । সব আত্মীয় স্বজন আসল । আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ফুফুরা এবং আমার কাজিনরা সবাই একত্র হলাম । এক ফুপাত কাজিন এর সাথে ওর আর এক কাজিন আসল । তার সাথে পরিচয় হলো । তার নাম লারা । পরিচয়ের পর সবার সাথেই তার খুব ভাল বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে উঠল । প্রতিদিন আমরা কাজিনরা মিলে সবাই একসাথে বেড়াতে যেতাম । গল্প করতাম । দুষ্টুমি করতাম । ওরা বিয়ের সময় প্রায় ১০/১২ দিন ছিল । এই সময়ে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল ।
বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ওরা এবং আমার কাজিনরা সবাই চলে গেল । যাওয়ার সময় বলল এই যোগাযোগটা ওরা ধরে রাখতে চায় । তো কিভাবে এই যোগাযোগটা ধরে রাখা যায়? তখন আমাদের কাছে মোবাইল ছিল না । ওদের বাড়ী থেকে আমাদের বাড়ী দুরে হওয়াতে যাওয়া আসা সম্ভব না । তাছাড়া পারিবারিক শাসনের কারনে যে কোন সময় ইচ্ছা করলেই যে কোন জায়গায় যাওয়াও সম্ভব না । তারপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো আমরা চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখব । সেখনেও সমস্যা । ওদের এবং আমাদের কারও বাড়ীর ঠিকানায় চিঠি গেলে তো অভিভাবকদের হাতে কোরবানী হতে হবে । তো বুদ্ধি একটা বের করতে হবে । অনেক চিন্তার পর ওরাই ঠিক করল স্কুলের ঠিকানায় ক্লাস এবং রোল নম্বর লিখে পাঠাবে । তারপর ঠিকানা নিয়ে ওরা চলে গেল । ছোটবেলাতে কাজিনরা এবং আত্মীয় স্বজন আসলে ভাল লাগে আবার চলে গেলে খারাপ লাগে । এক্ষত্রেও ব্যতিক্রম হলো না । একমাস হয়ে গেল কোন যোগাযোগ নেই ।
আমাদের হেডস্যার ইংরেজী পড়াতেন । অনেক রাগী স্বভাবের লোক । প্রচন্ড ভয় পেতাম স্যারকে । উনার ক্লাসে টু শব্দটি কেউ করত না । একমাত্র টিফিন ছাড়া বাহিরে যাওয়া নিষেধ । উনি আমাদের সময়ে দুইবার আমাদের জেলাতে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন । বলে রাখি উনি আমার বাবার এবং আমার সব আমাদের পরিবারের সব আংকেল ও ফুপুদেরও স্যার । আমার আংকেল এবং ফুপুদের ভাল ছাত্র হিসেবে স্কুলে একটা সুনাম আছে । সেই হিসেবে আমাকে স্যার একটু ভাল করে চিনে এবং খোঁজ নেন ।
একদিন আমি স্কুলে যাইনি । হেডস্যার ক্লাসে এসে আমাকে খোঁজলেন নাম ধরে । আর দপ্তরীকে বললেন দুটো বেত নিয়ে আসতে । দপ্তরী স্যারের কথামত বেত নিয়ে হাজির । ক্লাসে আমাকে পাওয়া গেল না । আমি ওইদিন অনুপস্থিত । সবাই ভাবছিল আমার মতো একজন নিরীহ ছাত্রকে কেন এভাবে খোঁজা হলো ? তাও আবার বেত সহকারে । স্যার ক্লাসে কিছু বললেন না তাই বোঝা গেল না । স্যার ক্লাস শেষ করে চলে গেলেন । যাবার আগে দপ্তরীকে ডেকে স্যারের বেত ও সাথে আনা উপকরন অফিসরুমে রাখতে বললেন । আর সেই উপকরনের মাঝে ছিল একটা নীল খাম । আর ওটাই রহস্য । ক্লাসের শেষে আমার এক বন্ধু যাকে আমরা জং উপনামে ডাকতাম সেই জং দপ্তরীর পেছনে দৌড় । দপ্তরী অফিসে পৌছানোর আগেই তার কাছে গিয়ে জিগ্গেস করল ঘটনা কি? তখন দপ্তরী ঘটনা খুলে বলল । তখন জং দপ্তরীর কাছ থেকে নীল খামটা দেখতে চেয়ে নিয়েই ভোঁ দৌড় । উদ্দেশ্য আমাকে হেডস্যারের হাত থেকে বাচানো । তারপর জং বাড়ী এসে আমাকে পুর্বাপর সব ঘটনা খুলে বলল । ওকে বললাম এবারের মতো বাঁচিয়েছিস । স্যার আমাকে ক্লাসে পেলে কি যে কেয়ামত হতো সেটা কল্পনা করতে পারছিলাম না । আর আমি জানতাম না যে আমাদের স্কুলে কারও নামে চিঠি এল সেটা আগে খুলে দেখা হয় । সেই নীলখামের ভেতরে এই গানটা লেখা ছিল
" আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকব ।
ছায়ার মাতো তোমার পাশে তোমার হয়ে থাকব ।"
তারপর দ্বিতীয়বার এইরকম অভিশপ্ত ণীলখামের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঘটনা জানিয়ে তাড়াতাড়ি একটা চিঠি লিখে একটা হলুদ খামে পাঠিয়ে দিলাম । প্রাপক লারা ।
আজও ওই ঘটনাটা মনে করে আমার সেই কাজিনরা এবং আমার সেই ক্লাসের সেই বন্ধুরা হাসতে হাসতে পড়ে যাই । আর ভাবি ছোটবেলাটা কত আনন্দময় ছিল আমাদের । আর কতই না সহজ সরল দুষ্টো ছিলাম আমরা ।