রাদারফোর্ড যখন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন তখন ম্যাকগিলের পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগার সম্ভবত তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সেরা গবেষণাগার ছিলো, ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে প্রচুর শিক্ষার্থী পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা করলেও তাদের অধিকাংশই গবেষণায় আগ্রহী ছিলো না। সুতরাং ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার সুযোগ পেয়ে রাদারফোর্ড সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেন নি আর। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে তিনি সহকর্মী এবং গবেষক হিসেবে যাদের সাথে কাজ করেছেন ভবিষ্যতে তাদের অনেকেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।
রাদারফোর্ড ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থাকাকালীন সময়েই অটো হান এবং ফ্রেডরিক সডির সহযোগিতায় অনুমাণ করতে পেরেছিলেন তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে পরমাণুই পরিবর্তিত হয়ে যায়, যদিও এর কার্যকারণ তাদের জানা ছিলো না কিন্তু তারা নিশ্চিত অনুমাণ করতে পেরেছিলেন প্রতিটি তেজস্ক্রিয় বিকিরণই পরমাণুকে পরিবর্তিত করে নতুন একটি পরমাণুতে পরিণত করে। যখন রাদারফোর্ড ম্যানচেস্টারে ফেরত আসলেন তখন বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত ২৬ রকমের তেজস্ক্রিয় মৌলের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত কিন্তু পর্যায় সারণীতে তাদের অবস্থান বিষয়ে ভীষণ রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন।
১৯১১ সালে জে জে থম্পসনের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে গবেষণাসহকারী হিসেবে আসেন নীলস বোর, স্থানীয় ফুটবল দলের গোলরক্ষক নীলস বোর, তড়িৎ প্রবাহে ইলেক্ট্রন গ্যাসের ভুমিকা বিষয়ে তার গবেষণা তেমন আশানুরূপ হয় নি। ইলেক্ট্রন বিষয়ে আরও গভীর জ্ঞানের জন্যেই ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে থম্পসনের কাছে এসেছিলেন তিনি, মেজাজী নীলস বোর খুব অল্প দিনেই থম্পসনের কাজের বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন, এমন সময় তার সাথে পরিচয় হলো রাডারফোর্ডের, ১৯১২ সালে তিনি ম্যানচেস্টারে রাদারফোর্ডের সাথে গবেষণা শুরু করলেন।
রাদারফোর্ড ম্যানচেস্টারে এসে পরমাণুর গঠনের উপরে গবেষণা শুরু করেন। তেজস্ক্রিয় বিকিরণে প্রাপ্ত আলফা কণিকারগতিপথে পাতলা সোনার পাত রেখে সোনার পাত দিয়ে আলফা কণিকার গটিপথ অনুমাণের চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন প্রায় সব সময়ই আলফা কণিকা সোনার পাত ভেদ করে চলে গেলেও কিছু কিছু আলফা কণিকা একেবারে উল্টো দিকে ফিরে আসে- ভীষণ রকম উত্তেজিত রাদারফোর্ড অনুমাণ করলেন আলফা কণিকার চেয়ে অনেকগুণ ভারী কোনো কিছু পরমাণুর কেন্দ্রে উপস্থিত, আলফা কণিকা সেখান থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে। তার ভাষায়
ঘটনাটা একেবারে অদ্ভুত, এমন যে তুমি পাতলা একটা টিস্যু পেপারে কামানের গোলা ছুড়লে আর গোলাটা ফিরেএসে তোমাকে আঘাত করলো।
চার্লস ডারউইনের নাতিও একই সময়ে রাদারফোর্ডের এই পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করছিলো, চার্লস গ্যালটন ডারউইন সোনার পাতের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় কেনো আলফা কণিকার গতিশক্তি হ্রাস পায় সে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনুমাণ করলেন যখন আলফা কণিকা সোনার পাতের ভেতর দিয়ে যায় তখন ইলেক্ট্রনের সাথে ধাক্কা লেগে এর গতি শক্তি হ্রাস পায়, কিন্তু তারপরও আলফা কণিকার গতিশক্তি হ্রাসের বিষয়ে তেমন সন্তোষজনক কোনো সমাধান দিতে পারছিলো না এই অনুমাণ।
নীলস বোর তার ডক্টরেট থিসিসেও অনুমাণ করেছিলেন ইলেক্ট্রন বিনা বাধায় পরিবাহীর ভেতরে ভ্রমণ করতে পারে- ডারউইনের তত্ত্বের ব্যর্থতায় একেবারে আকস্মিক অনুমাণে তিনি বললেন আসলে পরমাণুর কেন্দ্র ইলেক্ট্রনকে আটকে রাখে, এবং এই ইলেক্ট্রন শুধুমাত্র নির্ধারিত পরিমাণ শক্তি গ্রহন করতে পারে। তার এই অনুমাণ একটি গবেষণা নিবন্ধে লিখে তিনি কোপেনহেগেনে ফিরে গেলেন বিয়ে করতে।
বিয়ের পর কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হলেন তিনি, ডাক্তারী পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের পদার্থবিদ্যা পড়ানোর বাইরে অন্য কোনো কাজ ছিলো না তার। তার গবেষনা নিবন্ধে উপস্থাপিত এই অদ্ভুত ধারণা কি হাইড্রোজেনের বর্ণালীকে ব্যাখ্যা করতে পারবে?
হাইড্রোজেনের বর্ণালীতে বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোগুলোর ভেতরে একটি সাধারণ ঐক্য আছে, একটি নির্দিষ্ট গাণিতিক বিধি মেনে চলে ওটা। সহকর্মীর প্রশ্নের উত্তরে নীলস বোর জানালেন তার ব্লামার সিরিজ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
তার অনুমাণ ইলেক্ট্রনগুলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি গ্রহন করতে পারে ব্লামার সিরিজে প্রয়োগ করে তিনি হাইড্রোজেনের বর্ণালীর ব্যাখ্যা সমেত একটি গবেষণাপত্র পাঠিয়ে দিলেন প্রকাশের জন্য।
সে গবেষণাপত্র জার্মানীতে সমারফিল্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, এবং তিনি তার গাণিতিক দক্ষতায় বোরের পরমাণুর ধারণাকে প্রতিষঠিত করলেন। তিনি প্রমাণ করলেন পরমাণুর কেন্দ্রে উপস্থিত ধণাত্মক আধানবাহী নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ইলেক্ট্রনগুলো গ্রহদের মতো ঘুরতে থাকে কিন্তু শুধুমাত্র সেসব কক্ষপথেই ইলেক্ট্রনগুলো থাকতে পারে যেগুলোর পরিধি সেই পরমাণুর বর্ণালীর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের গুণিতক।
বোরের পরমাণু কল্পনায় বৈপ্লবিক কিছু প্রথম দেখায় খুঁজে পাওয়া কঠিন কিন্তু পজিটিভিস্ট দার্শণিক তত্ত্বে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের কাছে এই পরমাণুর ধারণাটি তেমন গ্রহনযোগ্য মনে হয় নি বিভিন্ন কারণেই।
গ্যাসের গতিতত্ত্বে যখন পরমাণুর অস্তিত্ব কল্পনা করা হয়েছিলো তখন প্রতিটি পরমাণুর গতিপথ বিষয়ে নিশ্চিত ভবিষ্যতবানী করবার দুর্বলতা সত্ত্বেও সেটাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা কারণ সেটা বিদ্যমান পর্যবেক্ষণকে সূচারু ভাবে ব্যাখ্য করতে পারছিলো, তাছাড়াও এখানে প্রতিমুহূর্তে বিপুল সংখ্যক সংঘাতের কথা বলা হলেও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিলো প্রতিটি সংঘাতের মধ্যবর্তী সময়ে পরমাণুগুলো নিউটনের সূত্র মেনে চলে এবং সে সময় তাদের সরল রৈখিক গতিপথের কোনো পরিবর্তন হয় না।
ম্যাক্সপ্ল্যাংকের উত্তপ্ত বস্তুর বর্ণালীর ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত কোয়ান্টা কিংবা কণিকার ধারণাটা তখনও ততটা জনপ্রিয় না হলেও পরীক্ষালব্ধ পর্যবেক্ষণ এবং পূর্ববর্তী কয়েক যুগের অমীমাংসীত প্রশ্নের মীমাংসা করতে পেরেছিলো সে ধারণা।
বোরের প্রস্তাব ছিলো হাইড্রোজেনের বর্ণালীতে প্রাপ্ত বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো মূলত ইলেক্ট্রনের এক কক্ষপথ থেকে অন্য একটি কক্ষপথে পতিত হওয়া, হাইড্রোজেনের বর্ণালীতে একাধিক তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের উপস্থিতিতে নিশ্চিত হলো ইলেক্ট্রন একাধিক কক্ষপথে পতিত হতে পারে,
মৌলের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ একটা অনিশ্চিত তাৎক্ষণিক বিষয়, এখানে অসংখ্য পরমাণুর প্রতিটিরই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ করে অন্য একটি পরমাণুতে পরিণত হওয়ার সম্ভবনা থাকলেও কখন কোন পরমাণুটি তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রদান করে ভিন্ন একটি পরমাণুতে পরিণত হবে সেটা নিশ্চিত বলা সম্ভব ছিলো না।
বোরের পরমাণুর ইলেক্ট্রন আরও নতুন জটিলতা তৈরি করলো, ইলেক্ট্রন একাধিক কক্ষপথে যেতে পারে কিন্তু কখন কোন ইলেক্ট্রন কোন কক্ষপথে যাবে সেটা নির্ধারণ করে কে? একটি পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা আরও অসংখ্য জটিলতা তৈরি করলো।
পরবর্তীতে সমারফিল্ডের কাছে গবেষণা করতে আসা শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় এসব বর্ণালী বিশ্লেষণ করে ইলেক্ট্রনের সাম্ভাব্য কক্ষপথ পরিবর্তনের বিষয়গুলোকে যাচাই করেছেন। কিন্তু সেটাও এক ধরণের অনুমাণের ভিত্তিতে, তেমন কোনো গ্রহনযোগ্য ব্যখ্যাবিহীন অবস্থায় বিভিন্ন সংখ্যা ধরে নিয়ে সমীকরণ মেলানোর এ বিধি সে সময়ে সমারফিল্ডের সাথে কাজ করা হাইজেনবার্গের তেমন পছন্দ হয় নি।