উল্লেখ্য, প্রশ্ন-উত্তরটি উক্ত পত্রিকার ১৯৪৫ সালের জুন মাসের প্রকাশনায় প্রথম প্রকাশিত হয়। যাতে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথাই আলোচিত হয়েছে।
-----------------------------------------------------------------
প্রশ্নঃ আজকাল যুদ্ধাপরাধীদের থেকে তাদের অপরাধের প্রতিশোধ গ্রহণ করার প্রচলন দেখা যায়। এ বিষযে ইসলামের বিধান কি?
-----------------------------------------------------------------
জবাবঃ এই 'যুদ্ধাপরাধী' পরিভাষাটি এক বিস্ময়কর পরিভাষা। বর্তমান যুগে ইউরোপের কুটনৈতিক চরিত্র পরিভাষাটি আবিস্কার করেছেন। কোন একটি জাতির সাথে কেবলমাত্র জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্যে যে লড়াই হয়েছে, তাতে বিজয় লাভ করার পর বিজিত জাতির সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার উন্মাদনা ছাড়া এর মূলে অন্য কোনো যৌক্তিকতা নেই।
উভয় পক্ষই নেতৃত্ব ও স্বার্থ লাভের জন্যে যুদ্ধ করেছে।
একপক্ষ আগেই দুনিয়ার উপর জেঁকে বসেছিল। এখন তারা তাদের এই কবজা এবং সেইসব স্বার্থ সংরক্ষন করতে চায় যা জোর যুলুম করে কবজা করার বদৌলতে লাভ করেছে।
দ্বিতীয় পক্ষ এসেছে পরে । তারা প্রথম পক্ষের আধিপত্য ও নেতৃত্বকে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের পথে প্রতিবন্ধক দেখতে পায় এবং তা দূর করার জন্যে ময়দানে অবতীর্ণ হয়। এ দিক থেকে কোন পক্ষের যুদ্ধই পবিত্র নৈতিক উদ্দেশ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলনা।
কিন্তু এখন একপক্ষ যখন বিজয় লাভ করলো, তখন তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধোন্মুখ হয়ে উঠলো শুধুমাত্র এ কারণে যে, প্রতিপক্ষ কেন তাদের নেতৃত্ব ও আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করলো!!! এখন তারা তাদের এ প্রতিশোধোন্মদনাকে নৈতিক রং মাখিয়ে বলতে শুরু করলো যে,
আমরা নই, বরং আমাদের প্রতিপক্ষরাই ডাকাত বদমাশ।
সারা দুনিয়ায় তারা শান্তি ও নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটিয়েছে (যেন তারা নিজেরা কখনো নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটায়নি)।
তারা অসামরিক লোকদের উপর জুলুম করেছে (যেন তাদের দ্বারা কখনো কোন যুলুম সংঘটিত হয়নি)।
তারা চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে (যেন তারা নিজেরা চিরদিন চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে আসছে)। সুতরা তাদের বড় বড় নেতা ও কমান্ডাররা অপরাধী। তাদেরকে যুদ্ধবন্ধী করার পরিবর্তে নৈতিক অপরাধী হিসেবে শাস্তি দিতে হবে।
অথচ বাস্তবে এরা নিজেরা যে জাতীয়তাবাদী আবেগের বশবর্তী এবং এদের নেতারা যেরূপ জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছে অপর পক্ষও একই রকম জাতীয়তাবাদী আবেগের বশবর্তী ছিলো এবং একই ভাবে নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেছে। এ প্রচেষ্টায় উভয় পক্ষ যেসব পন্থা অবলম্বন করেছে, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার মৌলিক পার্থক্য ছিলনা।। এখন বিজয়ী পক্ষের আসল উদ্দেশ্য হলো, প্রতিপক্ষের সেই সব লোকদের শেষ করে দেয়া, যারা নিজ লোকদের জাতীয়তাবাদী আবেগকে উদ্বেলিত করতে, জাতিকে সুসংগঠিত করতে এবং সমস্ত সাজ সরঞ্জামের উন্নতি সাধন করে মুকাবিলার ময়দানে ব্যবহার করতে সক্ষম।। এদেরকে তারা এজন্যে শেষ করে দিতে চায় যেনো সে জাতি তাদের নেতৃত্ব মেনে নেয় এবং তাদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার যোগ্য না হতে পারে। কিন্তু এই নিরেট প্রতিশোধোন্মাদনাকে মূলত তারা নৈতিক বিচারের মনোহরী আবরণে ধামাচাপা দেয়ারই চেষ্টা করে।।
এক পক্ষ বিজয়ী হবার পর যেমন এই নৈতিক বিচারের প্রহসন চালানো হয়, অপর পক্ষ বিজয়ী হলে ঠিক একই আচরন তারাও করে। এটা একটা নিকৃষ্ট ধরনের নৈতিক ধোঁকা ও ষড়যন্ত্র।
আমি বিস্মিত যে বর্তমান সভ্যতা পৃথিবীর বড় বড় সভ্য ও ক্ষমতাবান জাতিগুলোর শাসকদের মধ্যে কতোটা নিকৃষ্ট ধরনের লজ্জাহীনতা সৃষ্টি করে দিয়েছে।। তাদের বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকরা নিজেদের নৈতিক অনুভূতিকে কতোটা ভোঁতা করে নিয়েছে যে, তারা প্রকাশ্য ধোঁকা ও প্রতারণামূলক কথাবর্তা বলে বেড়াচ্ছে; অথচ তাদের মধ্যে কোনো প্রকার লজ্জা শরমের অনুভূতিটা পর্যন্ত নেই।
যিনি ইনসাফের সামান্যতম অর্থও বুঝেন, এমন কোন বুদ্ধি ও বিবেকবান ব্যক্তি কি করে এমনটি ধারণা করতে পারেন যে, যুদ্ধের একপক্ষ বিচারের আসনে বসে অপর পক্ষের সাথে বাস্তবেই কোনো প্রকার ইনসাফ করতে সক্ষম?! ব্যক্তিগত জীবনে যখন একপক্ষ অপর পক্ষের বিচারক হতে পারেনা, তখন জাতীয় একটি সামরিক পক্ষ অপর সামরিক পক্ষের বিচারক কেমন করে হতে পারে??
আপনি জানতে চেয়েছেন, এ বিষয়ে ইসলামের বিধান কি? আমি বলি ইসলাম এ ধরনের ধোঁকা প্রতারণাকে ধোঁকা প্রতারণাই মনে করে। ইসলামের দৃষ্টিতে উভয় সামরিক পক্ষের পরস্পরের হতে পরস্পরের যেসব লোক ধরা পরে তারা সকলেই যুদ্ধবন্দী। আর যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে ইসলামের যাবতীয় বিধান আমি আমার বিভিন্ন গ্রন্থে পরিস্কারভাবে আলোচনা করেছি। যুদ্ধের পর বিচারাসনে বসে অপর পক্ষের বন্দীদের অপরাধী ঘোষনা করে নিজেরাই তাদের বিচার ফায়সালা শুরু করা একটা নিকৃষ্ট ধরনের নৈতিক লজ্জাহীনতা।। আর ইসলাম হলো সেই জীবন ব্যবস্থা যা লজ্জাহীলতাকে কেবল নৈতিকতার অংগই বলেনি, বরঞ্চ ঈমানের অংগ বলে ঘোষনা করেছে।।।
------------------------------------------------------------------
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১০ রাত ১২:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




