‘ভয়ের কারণ নেই, এত সহজে কার্যোদ্ধার হবে না।’
‘গুরু…।’
‘মনে রাখিস, পালে থাকলে মাল মিলে না, মালদার হতে হলে একলা একলি কাজ করতে হয়। আর শোন, চার পোয়ায় এক সের। ষোলো পণে এক কাহন এবং এক কাহনে এক শো আটাশ। সোনা মাপার অন্য হিসাব আছে।’
‘চোখ গেছে এতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু কানের মাথা খেয়ে খামোখা ঝামেলায় পড়েছি।’
‘আমিও কালের জাঁতায় আছি, সব বদলাবে, বদলাব আমি। ইতিপূর্বে কয়েকবার বদলেছিলাম। মনে রাখিস, বিবেক আমাদেরকে বোকা বানায়।’
‘আমি সত্যি তালের তলায় বসতে চাই, কিন্তু ডর লাগে গো গুরু। মাথায় পড়লে ভরতা হব।’
‘হাসতে হাসতে আমি এখন হাঁস হব।’
‘হায়, দিনে দিনে দিন গত হয়ে আগামীকাল গতকাল হয়েছে।’
‘কম কাজ ভালো যদি আজুরা আগে মিলে। বেশি কাজ করে আজুরা না পেলে কাজ যত বেশি হোক না কেন তা ভূতর বেগারি, তাই না?’
‘জি গুরু। মনে কোনো টানচিন্তা নেই। খাই দাই ঘুমাই।’
‘নিজের খেয়ে পরের করি লাভ, মনে আছে বিষ, মিছে যত ভাব।’
‘সারকথা আমি বুঝিনি।’
‘নকলে আসল নষ্ট, ভোঁতা দাঁতে ভোঁদড় অতুষ্ট।’
‘জি গুরু, বয়স বেড়ে বুড়া হলে পীড়া বাড়ে।’
‘তোর আক্কেল দাঁতে হয়তো গজাচ্ছে।’
‘গুরু, আক্কেল দাঁতে এত ব্যথা কেন?’
‘অঘর হাঘরে হলে ঘোরে বেঘোর হয় কেন বললে ব্যথা কমবে।’
‘টান বেড়েছে যার জন্য জানে টানে, সে কেন দূরে থাকে? ভালোমানুষ হয়ে ভোলায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই তাই না গুরু?’
‘যাওয়ার দরকার নেই, বেড়াতে গেলে সকল দিকে লোকসান, ঘরে বসে থাকলে খালি লাভ। সমস্যা হলো, চাওয়ার সবকিছু পাওয়া হয় না। চল, বেকার সময় উপভোগ করতে হবে।’
‘জি গুরু, তাদের বাড়িতে যখন এসেছি তখন পেট ভরে চাট্টি ভাত খেয়ে যাই।’
‘যার সন্ধানে যে থাকে সে তারে পায়।’ বলে আনীল যখন রেস্তোঁরায় প্রবেশ করে অনিল তখন কাকুতি মিনতে করে বলল, ‘আম্মা, আর কখনো এত মারাত্মক ভুল করব না।’
‘ঠিকাছে শোন, তোর সাথে থাকার জন্য আগামীকাল তোর দাদা দাদি আসবেন। কোথাও গেলে উনাদেরকে সাথে নেবে নইলে একটাও মাটিতে পড়বে না।’
‘আমি জানি গো আম্মা। আর কোথাও একলা যাব না। আব্বা কখন আসবেন?’
‘এই নে, আর কথা না বলে ভাত খেয়ে ঘুমা যেয়ে। কোথায় গিয়েছিলে, এত ক্লান্ত হলে কেমনে?’
‘চিন্তাক্লিষ্ট হলে আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হই।’ বলে অনিল হাসার চেষ্টা করলে মা চোখ পাকিয়ে মাথা দিয়ে ইশার করেন এবং ভাত খেয়ে সে তার কামরায় চলে যায়। পরদিন মা বাবাকে বিমানবন্দর পৌঁছিয়ে বাসায় ফিরে গাড়ি থেকে নেমে উত্তেজিতকণ্ঠে দাদিকে ডেকে অনিল বলল, ‘দাদিজান, আমার এক সহাধ্যায়িনী নাফাখুমে গোসল করার জন্য আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করেছে। লিখেছে, সাহস থাকলে দাদিকে সাথে আনিস। কিন্তু! তোর দাদি আস্ত একটা মিয়নো চাইলেও আসতে পারবেন না।’
‘কী বললে? ওর এত সাহস টরেটক্কা ভাষায় আমাকে উসকানি দিয়েছে। নুরিকেও সাথে নেব। কবে যেতে চাস?’
‘দাদিজান, আমি আর যেতে চাই না। আমাদের সাথে দাদাজান যাবেন। দাদাজানের সাথে আমি নিরাপদবোধ করি না।’
‘চোপ। সট করে তৈরি হয়ে আয়। এখুই রওনা হব। ছুকরির এত সাহস, আমাকে উসকানি দেয়।’ বলে দাদি রেগে কশকশ করে দাদাকে ডেকে তৈরি হওয়ার জন্য বলে হনহন করে হেঁটে ভিতরে যান। দুহাতে মাথা চেপে ধরে অনিল মাটিতে বসে হায় হায় করে বলল, ‘আত্মহত্যার কুবুদ্ধি কোন ভূত ওকে দিয়েছে। মারধর করলেও দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য নীলগিরি যাব না।’
‘কী হয়েছে, হাভাতের মত বসেছিস কেন?’ বলে দাদা মাথা দিয়ে ইশারা করলে, পা লম্বা করে কাঁধ ঝুলিয়ে অনিল বলল, ‘নাফাখুমে গোসল করলে নির্ঘাত নিউমোনিয়া হবে।’
‘কী বলছিস বুঝিয়ে বল, রক্তে উচ্চচাপ অনুভব করছি।’
‘দাদাজান, আমি কিচ্ছু বলিনি।’ বলে অনিল মাথা এবং হাত নাড়লে বুক ভরে শ্বাস টেনে হাঁপ ছেড়ে দাদা বললেন, ‘বাড়াবাড়ি করে বুড়ি এবার বেড়াজালে বেড় খেয়েছে।’
‘সাগরে ভেসে পিপাসিত হলে নির্ঘাত মৃত্যু হয়।’
‘আমাকে কিছু বলছিস নাকি?’
‘জি না। আমি বাতাসের সাথে কথা বলছিলাম। বেজুইতে হলে কিচ্ছু করা যায় না।’
‘জানি, বেজায়গায় বেজুত হলে বেশি কিছু করার থাকে না। এখন ঘোড়ারাণ্ডা আর কাঁচকলা খা।’ বলে দাদা মাথা নেড়ে ভিতরে গেলে নিম্নকণ্ঠে অনিল বলল, ‘নন্দে নন্দিত হয়ে আমি পরমানন্দিত হয়েছি।’
দাদি হাঁকাহাঁকি এবং হাঁকপাঁক শুরু করলে অনিল কান্নার ভান করে বলল, ‘দাদিজান, এখন কী করব?’
‘দাদার সাথে পিছনে বস, আমি জিপ চালাব।’ বলে দাদি মাথা দিয়ে ইশারা করলে দাদা শরীর কাঁপিয়ে হাসেন। অসহায়ের মত অনিল জিপের দরজা খুলে বলল, ‘দুশ্চিন্তার কারণ নেই, আমি চালাব।’
কথা না বলে দাদা দাদি উঠে বসলে অনিল চালাতে শুরু করে নুরির বাসার সামনে যায়। নুরি উঠে বসলে দোয়া দুরুদ পড়ে চালাতে শুরু করে এবং মহাসড়কে উঠার পর হঠাৎ তাদের সামনে সামরিক হেলিকপ্টার নামে। দাদি চেঁচামেচি শুরু করলে কপাইলট বেরিয়ে দৌড়ে যেয়ে জিপের দরজা খুলে বলল, ‘সামনে কাল্পনিক অঘটন ঘটেছে, আজ আর কোথাও যেতে পারবেন না।’
‘প্রয়োজনে কল্পনাপ্রবণ হয়ে হাঁটব।’
‘বাপরে বাপ, সত্যি সামরিক মেজাজি।’ নিম্নকণ্ঠে বলে কপাইলট মাথা দিয়ে ইশারা করে বলল, ‘কোথায় যাবেন?’
‘নীলাচল।’
‘হেঁটে যেতে হবে না, একটুপর আমরা ওখানে যাব। চাইলে আমাদের সাথে যেতে পারবনে।’ বলে কপাইলট অনিলের দিকে তাকায়। পরখ করে তাকিয়ে অনিল চমকে কিছু বলতে চাইলে দাদি তাড়া দিয়ে বললেন, ‘চল, উনাদের সাথে আমরাও যাব।’
হতাশ হয়ে অনিল কাঁধ ঝুলায়, দাদি এবং নুরি বেরিয়ে হাঁকাহাঁকি শুরু করলে দাদা হেলিকপ্টারে উঠে বসেন। পাইলট বিদ্রুপ হেসে উড়াতে শুরু করলে কম্পিতকণ্ঠে কপাইলট বলল, ‘ওস্তাদ, এখন কী করব?’
জবাব না দিয়ে পাইলট শিষ দিয়ে গান গাইলে অনিল হাঁইহুঁই শুরু করে। নুরিকে ডেকে পাইলট বলল, ‘নুরি বেগম, নীলকান্তমণির মালা দেব বাতাসে কোঁতকা মার।’
‘এই নুরি, আমার নাতিকে কোঁতকা মারলে ধাক্কা মেরে নাফাখুমে ফেলব।’ বলে দাদি দাঁত কটমট করে চোখ পাকালে হাত জোড়ে অনিল বলল, ‘দয়া করে আমাকে নামিয়ে দাও নাফাখুমে আমি যাব না। ও আম্মা গো আপনি কোথায়?’
অনিলের দিকে তাকিয়ে নুরি মাথা দিয়ে ইশারা করলে অনিল চোখ বুজে দুহাত তুলে দোয়া শুরু করে। ব্যাগ থেকে মানচিত্র বার করে দাদা ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে হেঁকে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় আনীল?’
দাদার কথা শুনে অনিল চিল্লাচিল্লি শুরু করলে পাইলটের দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে দাদি বললে, ‘ওরে ওরম্বা, তুই তো যমের অরুচি হয়েছিস।’
‘বুড়ি বেগম, আজ নাফাখুমে ডুবিয়ে মারব। আপনার কারণ আমি আমার ভালোবাসাকে গুপ্তগুহায় সংগুপ্ত করেছি। বেশি ভাঁড়ামি করলে ধাক্কা মেরে ভালুকের গুহায় ফেলব।’
‘তাই তো নীলার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি গো! গুপ্তগুহায় ওর লাশ সংরক্ষণ করেছিস নাকি?’
‘নীলা এখনো জীবিত।’
‘কেউ বিশ্বাস করবে না।’
‘আপনি হয়তো জানেন, নুরিকে দেখে অনিল রূপোন্মত্ত হয়েছিল। নীলাকে দেখে আমি রূপোন্মাদ হয়েছিলাম। আপনার রূপদর্শনে দাদা নিশ্চয় রূপান্তর হয়েছিলেন?’
‘মুখ বন্ধ কর নইলে কিলিয়ে কাহিল করব, বেয়াড়া বান্দর কোথাকার।’
‘দাদি, ইংলিস ফুল স্টপের বাংলা বললে এখুনি আপনার তালতোবোনের সাথে দেখা করাব।’ বলে আনীল শরীর কাঁপিয়ে হাসলে দুহাতে মাথা চেপে ধরে অনিল বলল, ‘এই লোকের সাথে দেখা করার জন্য আমি বান্দরবনের বাদাড়ে বেড়াতে চেয়েছিলাম, সর্বনাশ। দাদা গো! নিদানে ঠেকেছি নাদান, নিরানন্দ মন আনন্দ চায়, নন্দিত হতে চাই দক্ষিণা।’
আনীল আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, ‘আমার মাঝে আছ তুমি কোথায় জানি না, জলে ডুবে খুঁজি আমি ছায়ার দেখা পাই না।’
ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে অনিল বলল, ‘আর কত কাল অপেক্ষা করতে হবে? হে কবিতা, সদয় হয়ে আমার খাতার পাতায় ভাসো, আমি তোমাকে দেখতে চাই, তৃপ্ত হতে চাই কবি। জানি আমি কবি হতে পারব না। ভাবুক হলে পেটের ভিতর বুদ্বুদ শব্দ হয়। হে কবিতা, তুমি নগরে চলে যাও, জলকেলি করার জন্য আমি এখন সাগরে যাব, অলস সময় আমাকে নিমন্ত্রণ করেছে।’
‘কবিতার লেখক অনেক বড় কবি হতে পারে কিন্তু কবিতায় কবিতার বিষয় বিশ্লেষিত না হলে তা কবিতা হয় না।’ বলে নুরি মুখ বিকৃত করলে মাথা নেড়ে আনীল বলল, ‘কষ্টে ক্লিষ্ট হলে মন এমন আকুতি করে। কবিতা মনেরাকাশে কালো মেঘের মতন। কষ্ট যেন কবিতার খোরাক। শব্দে সময় স্তব্ধ হয়।’
প্রথম প্রকাশ ২০/১২/২০১৭
Copyright © 2017 by Mohammed abdulhaque
ISBN-13: 978-1982087326
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:৪৬