somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চড়ুই নীড়ের শূন্যতা

২৭ শে মে, ২০২৫ রাত ৮:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাইরে স্কুল মাঠ; ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে, কণ্ঠ ভেসে আসে বাতাসে। পুরাতন এক বিল্ডিং এর ভেতরে আমি, কাগজপত্র আর মাথার ওপরে ঘূর্ণমান পাখা৷
ঘরের দরজার ওপর ছোট একটা ভেন্টিলেটর গ্রিল আছে।
সেই ফাঁকে বহুদিন হয়, একটি চড়ুই পাখি ঘর বেঁধেছে । মানুষের ঘরের ছোটো এক কোনে চড়ুইদের ঘর সাধারণ বিষয়৷ দুজনের একই আশ্রয় বলে, ও আসত, বসত দরজার কোণে।
মাঝেমাঝে জানালার গ্রিলে দাঁড়িয়ে ঘরটাকে পর্যবেক্ষণ করত। কখনো আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকত,
যেন কিছুর সন্ধান করছে৷ পাখিটির উপস্থিতিতে মনে হতো, এই পুরাতন ঘরটিরও একটা হৃদস্পন্দন আছে। ও যেন এই ঘরের ভেতরের প্রাকৃতিক এক ক্ষুদ্র দূত।
ওর সাথে, এ ঘরে আসা-যাওয়া করা যান্ত্রিক জীবনের, কোনো চুক্তি নেই সম্পর্কের৷ তবু আমার নিয়মিত আয়োজনে, এক অপার মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে থাকায় যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷
আজও ঘরের পাখা ঘুরছিল, আমি খাতা দেখছিলাম৷ হঠাৎ একটা শব্দ৷ তাকিয়ে দেখি পাখিটি মেঝেতে পড়ে আছে৷
ও আর নড়ছে না। ডানার নিচে লাল একফোঁটা দাগ,
ছোট্ট, অথচ বুকে ছুরি বসিয়ে দেওয়ার মতো গাঢ়। পাখার বাড়িতে ওর পা ছিড়ে গিয়ে পড়েছে বহুদূর৷
আমি শব্দ না করে ওকে কাগজে মুড়িয়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে রেখে এলাম।
আজ আর কোনো কিচিরমিচির নেই। ঘরের নীরবতাও যেন আর শান্ত নয়, অবসন্ন।
প্রতিদিনের কাজ চলছে, মনে হয় সে আছে কিন্তু তাকাতেই সেখানে কিছুই নেই৷
দৃষ্টিতে পাখিটি ছিল না কিন্তু স্নায়ুর স্পন্দনে যেন ওর উপস্থিতি ছিল জীবন্ত। এখন ও নেইতবু ওর অনুপস্থিতিটাই যেন সবচেয়ে প্রবল।
ঘরের প্রতিটি কোণে, জানালার ধারে, দরজার ওপর, তাকালেই মনে হয়, কিছু একটা শূন্য হয়ে গেছে।
আর তা ভরাট করার মতো কিছু পৃথিবীর কোথাও নেই।
আমি এখন আগের মতোই মানুষ, আগের মতোই কর্মচারী,
তবে মাঝে মাঝে ভাবনা এলো, আমি কি প্রকৃতির এক ছোট বন্ধুকে হারিয়ে ফেললাম?
যে নীরবে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, গল্প শুনিয়েছিল প্রতিদিন?
না, ওর জন্য আমি কিছুই করিনি তবুও আমার পাশাপাশি এসেছিল। কতজন শখ করে পাখি পালন করার চেষ্টা করে কিন্তু ওকে পোষ মানানোর দরকার পড়েনি৷
এ যেন ভার্জিনিয়া উলফের 'stream of consciousness'—প্রবাহমান এক অনুভব, যা ঠেকিয়ে রাখা যায় না, আবার স্পষ্ট করাও যায় না।
প্রতিদিনের মতো আজও মনে পড়ে সেই প্রশ্নটি:
"পৃথিবীর সমস্ত কিচিরমিচির কি একদিন এভাবেই থেমে যাবে?"
হয়তো থেমেই যাবে।
হেমিংওয়ের মতো সংক্ষিপ্ত ও তীব্র এক নীরবতায়।
চড়ুইটি ক্ষণস্থায়ী, সামান্য, দাবি-নাহীন একটি সত্তা, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ঘরের নির্জনতাকে অর্থ দিত, সময়কে সংগীতময় করত। যখন সে নেই, তখন উপলব্ধি হয়, তার প্রভাব কতটা গভীর ছিল।
এটি হাইডেগারের "Being-in-the-world" ধারণার সঙ্গেও মেলে—আমরা অস্তিত্বকে বুঝি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে, বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা হিসেবে নয়।
পাখিটির অস্তিত্ব খুব স্বাভাবিক, অভ্যাসের মতো ছিল—প্রতিদিন আসত, কিচিরমিচির করত। আমাদের মস্তিষ্ক এ রকম নিয়মিত জিনিসগুলোকে “background presence” হিসেবে গ্রহণ করে।
কিন্তু তার হঠাৎ অনুপস্থিতি আমাদের চেতনায় একধরনের ভাঙন ঘটায়।
এই ঘরানার ব্যাখ্যায় ফ্রয়েড বলতেন—এই ধরনের ক্ষতি আমাদের অবচেতনে এক ‘loss object’ হিসেবে প্রবেশ করে, এবং তা প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাকে ছায়া দিয়ে রাখে।
এই পাখি তাই শুধুই পাখি নয়, সে এক স্মৃতিবাহী symbolic object—যার মৃত্যুতে দুঃখ নয়, বরং আত্মোপলব্ধি তীব্র হয়।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২৫ রাত ৮:৫১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×