somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন সামান্য বাংলাদেশীর মেসি দর্শন!

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নেই বেঢপ আকারের এই লেখার জন্য। আসলে অনেক ছোট করতে চেয়েও এর চেয়ে ছোট করতে পারিনি। আর সত্যি কথা বলতে আমি এখনো অনেকটাই ঘোরের মাঝে আছি। তাই লেখা হয়তো খানিকটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। আশা করি আপনারা তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন।]
দৃশ্য ১ - মাঠে বল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন মেসি!! হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দিলেন তার সেই ট্রেডমার্ক থ্রু! আর তা ধরেই সোজা লক্ষ্যভেদ করলেন সুযোগসন্ধানী হিগুয়াইন! গোল!!!!!!! চিৎকার করে উঠলেন কোচ সাবেলা!! পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম আমিও!!!!
দৃশ্য ২ – বল পায়ে পেয়ে হঠাৎ করেই দৌড় শুরু করলেন মেসি। মুহূর্তের মধ্যেই ছিটকে ফেললেন দুজন মার্কারকে। এরপর পায়ের জাদুতে আরও দুজনকে বোকা বানিয়ে চলে গেলেন একেবারে ফাঁকায়! এরপর তার আলতো প্লেসিং শট গোলরক্ষক ঠেকিয়ে দিলেও ফিরতি বলে গোল করতে ভুল করলেন না অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া!!! গোল!!!!!!! চিৎকার করে উঠলেন কোচ সাবেলা!! পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম আমিও!!!!
এই ধরনের দৃশ্য সাধারণত মাঝে মধ্যেই স্বপ্নে দেখি। এরপরের দৃশ্য আসার আগেই কোন না কোন কারণে ঘুমটা ভেঙ্গে যায়!! তাই গত ৬সেপ্টেম্বর যখন এই দৃশ্যগুলো সত্যিই ঘটছিলো, তখনও বারবার মনে হচ্ছিল হয়তো স্বপ্ন দেখছি, এখনই ঘুমটা ভেঙ্গে যাবে!
কিন্তু না। এর এক বিন্দুও স্বপ্ন নয়। পুরোটাই বাস্তব! কঠিন বাস্তব! সত্যিই ডাগ আইউটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি! সারা জীবন টিভিতে যাদের খেলা দেখে এসেছি, তারাই খেলছিল আমার চোখের সামনে, নিঃশ্বাসের দূরত্বে!
গত কয়েকদিনের কাজের প্রচন্ড চাপের কারণে এই লেখাটা লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়নি। আজ সময় পেয়েই বসে পড়লাম!
শুরু থেকেই বলি। যেদিন জানতে পারলাম, আর্জেন্টিনা দলের ঢাকা সফরে তাদের সহকারী লিঁয়াজো কর্মকর্তা হিসেবে আমি নিয়োগ পেয়েছি, সেদিন থেকেই আমার খুশি যেন বাঁধ মানছিল না। শুধু ক্যালেন্ডার আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় গুনছিলাম, কখন আসবে সেই দিন, কখন দেখতে পাবো মেসিকে!!!
তারপর ধীরে ধীরে এলো সেই দিন। গত কয়েকটি দিন কীভাবে কাটিয়েছি, তাই এখানে তুলে ধরলাম!

প্রথম দিন – ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১

বিকাল ৪টায় যেয়ে হাজির হলাম বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে। আজ আমাদের ব্রিফিং দেওয়া হবে। যেয়ে দেখি, সে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা। নিচতলায় ফ্রী টিকিটের জন্য স্কুলের বাচ্চাদের হৈ চৈ। উপরতলায় চলছে ফ্রী টিকিটের জন্য বড়দের আবদার। কী যে অবস্থা, তা সামনে থেকে না দেখলে বোঝার কোন উপায় নেই। বাফুফে কর্মকর্তারা উদ্ভ্রান্তের মত ছুটছেন! এরই মাঝে খবর এলো আর্জেন্টিনা দলের ৬জন অগ্রবর্তী প্রতিনিধি কিছু না জানিয়ে হাজির হয়েছেন এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে সোজা স্টেডিয়ামে! এই খবর পাওয়ার পর হাউকাউ আরও দ্বিগুন বেড়ে গেলো। আমি ঝিম ধরে বসে থাকি কখনো এই রুমে তো কখনো ঐ রুমে। ব্রিফিং তো দূরের কথা, সেদিন এক অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড হাতে পেয়েছি রাত ১১টায়!! (যেটা পাওয়ার কথা ছিল ২দিন আগে) আর SB’র ক্লিয়ারেন্স কার্ড পেয়েছি পরদিন বিকালে!!
যাই হোক, রাত ১১টায়ই কার্ড পেয়ে নেমে পড়লাম কাজে। সোজা চলে গেলাম হোটেল রূপসী বাংলায়। পরিচিত হলাম সেই প্রতিনিধিদের সাথে। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা দলের এজেন্ট রড্রিগোর সাথে। আর্জেন্টিনা দলের পুরো ৬০জনের বহরে যে বিরল ৪/৫জন মানুষ ইংরেজী (তাও ভাঙ্গা ভাঙ্গা) বলতে পারে, তাদের মধ্যে এই রড্রিগ একজন। এরপর হোটেলে নিজের রুম চেক-ইন করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১টা বেজে গেলো। পরদিন সকাল ৭টায় যেতে হবে বাফুফে ভবনে। অথচ চোখে একফোটাও ঘুম নেই। তবুও কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।

দ্বিতীয় দিন – ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১

ঠিক ভোর ৫টায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো! কোন মতে গোসল করে খেয়ে দেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম সকাল ৬টায়। প্রথমে হোটেল রুপসী বাংলায় নিজের লাগেজ রেখে সোজা চলে গেলাম বাফুফে ভবনে। গিয়ে দেখি দুই দলের সব বাস, গাড়ি, কার্গো ভ্যান রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল সাড়ে ৭টায় রওনা হলো আমাদের গাড়ি বহর। জীবনে এই প্রথম পুলিশ আর র্যাসবের প্রহরায় কোথাও যাচ্ছি- সে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা!! মাত্র ২৫ মিনিটে ঢাকার সকালের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে মতিঝিল থেকে পৌছে গেলাম এয়ারপোর্টে। সেখানে যেয়ে শুরু হল দীর্ঘ অপেক্ষার পালা। অবশেষে প্রায় আড়াই ঘন্টা পড়ে খবর পেলাম, আর্জেন্টিনা দল বহনকারী বিমান ল্যান্ড করেছে। এখনই মেসিরা প্লেন থেকে নামবেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সাথে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম তাদের অভ্যর্থনা জানাতে। এরপরই এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এই তো তারা নেমে আসছেন। প্রথমেই এলেন মাসচেরানো। তার ঠিক পিছনেই মেসি!! আমার সেই সময় কেমন যে লাগছিলো, তা কোনভাবেই বলে বোঝানো সম্ভব না। সবার সাথে হ্যান্ডশেক করলাম। তবে হ্যান্ডশেক শেষ হওয়ার পরেও আমার হাত “শেক” করছিলো এক অদ্ভূত আনন্দে, উত্তেজনায়, রোমাঞ্চে!! এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি তারা বাসে উঠে গেলেন, আমি উঠলাম পিছনের গাড়িতে। পুরা প্রধানমন্ত্রী স্টাইলে রাস্তা বন্ধ করে মাত্র ৫মিনিটে চলে আসলাম হোটেলে। মেসিরা সোজা চলে গেলো তাদের জন্য নির্ধারিত রুমে। কিছুক্ষণ পরেই তারা নামলো দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। যতদিন মেসিরা হোটেলে ছিলেন, হোটেল রূপসি বাংলার “ভিন্টেজ” রেস্টুরেন্টটি তাদের জন্য রিসার্ভ করা ছিল। তাদের সব খাবার রান্না করতো দলের সাথে থাকা আর্জেন্টাইন শেফ। [পেপারে যে লিখসে মেসি আলু ভর্তা, ডাল, শুটকি, পান্তা, ইলিশ আরও কত কিছু খাইসে, এটা পুরাই ভুয়া কথা!ঐখানে এসবের নাম গন্ধও ছিল না!] লিঁয়াজো অফিসার হিসেবে রেস্টুরেন্টের ভিতরেই আমিও বসে ছিলাম। কেননা মেসিরা বের হওয়ার আগেই হোটেলের লবি ক্লিয়ার করার কথা পুলিশকে জানাতে হবে। খেয়েদেয়ে তারা আবারো চলে গেলো তাদের রুমে।
এর মাঝে অবশ্য ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ভীড়ের মাঝে আমি আমার মোবাইল হারিয়ে ফেলেছিলাম। মোবাইল হারিয়ে পুরাপুরি অকূল পাথারে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে বিকেলের মাঝেই আপদকালীন একটা মোবাইল জোগাড় করে বিপদ সামাল দিয়েছি।
মেসিদের সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করার কথা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। অথচ ৪টার সময় তাদের এজেন্ট রড্রিগো এসে হাজির, এখনই ৫০ বোতল Gatoride আর ৫০ বোতল পানি নিয়ে ড্রেসিং রুমের ফ্রিজে রেখে আসতে হবে। আমার বস গাফফার সাহেবের সহযোগিতায় তা জোগাড় করে ৫টার মাঝেই তাদের ড্রেসিং রুমে সাজিয়ে রাখলাম। এরপর আবারো রড্রিগোর ফোন। অর্ধেক Gatoride আর পানি যেন মাঠে রাখা হয়। তাও বরফ সহ। আবারো হোটেল থেকে বরফ এনে তাদের আইসবক্সে বরফ দিয়ে Gatoride আর পানি নিয়ে মাঠে রেখে দিলাম। অবশেষে ঠিক সাড়ে ৬টার সময় তারা ঢুকলেন মাঠে। সমগ্র স্টেডিয়াম যেন পাগল হয়ে গিয়েছে। নিজে অনুভব করেছি বলেই হয়তো দর্শকদের এই উন্মাদনার কারণ টের পাচ্ছিলাম! যথাসময়েই শুরু হল প্র্যাকটিস। সেই সাথে চলতে থাকলো দর্শকদের তুমুল “মেসি! মেসি!” ধ্বনি। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ডাগ আউটের ঠিক পাশেই। কখন কী লাগে, তার তো কোনই ঠিক নেই। প্রচন্ড গরমের মাঝে স্যুট পরে থাকতে যেয়ে রীতিমত ঘেমে গোসল হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই আর্জেন্টিনার সহকারী কোচ কামিনো আমাকে আকারে ইঙ্গিতে বুঝালেন, স্যুট খুলে তাদের সাথে ডাগ আউটে বসতে। নিজে থেকেই আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা Gatoride এর বোতল। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না! আমি বসে আছি আর্জেন্টিনা দলের দাগ আউটে!!!!! এও কী সম্ভব!!!
এরপর যথারীতি প্র্যাকটিস শেষ হল। কিন্তু আর্জেন্টিনা দলের দুই লাগেজ ম্যান তাদের সব লাগেজ গুছাতে দেরি করে ফেলায় আমি তাদের সহ গাড়ি মিস করলাম! এরপর অপেক্ষা গাড়ির জন্য। তাদের নিয়ে স্টেডিয়ামের গেটে দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির অপেক্ষায়। এমন সময় সাধারণ মানুষ তাদেরকেই খেলোয়াড় ভেবে গণহারে ছবি তোলা শুরু করে দিল। উত্তেজনায় এক ভদ্রলোককে দেখলাম তাদের পায়ে ধরে সালাম করতে!! লাগেজ ম্যানরাও অবশ্য এই ধরনের পাব্লিসিটি পেয়ে বেশ খুশি! অবশেষে পুলিশ ভাইদের সহযোগিতায় তাদের নিয়ে গাড়িতে করে হোটেলে ফিরলাম। সেদিন রাতে মেসিদের জন্য বাফুফে অফিসিয়াল ডিনারের আয়োজন করে। তবে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে মেসিরা সেই ডিনারে আসেননি। এ নিয়ে আর্জেন্টিনা দলের সাথে বাফুফের খানিকটা মনোমালিন্যও হয়েছিল। আর এর ঝড় গেছে আমার উপর দিয়েও। রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আর্জেন্টিনা দলের এজেন্ট রড্রিগো আর মার্সেলোর সাথে বসে কথা বলতে হল। তারা বাফুফেকে কী বলতে চায়, বাফুফে তাদের কী বলতে চায়, দুনিয়ার সব হাঙ্কিপাঙ্কি! তবে সারাদিনে বিভিন্ন ফাঁকফোঁকরে ছবি তুলে নিয়েছিলাম গুতিয়েরেজ, কোচ সাবেলা সহ কয়েকজন খেলোয়াড়ের সাথে। তবুও মনটা খচখচ করছিল। কেননা বড় কোন খেলোয়াড়ের সাথে যে এখনো একটা ছবিও তুলতে পারলাম না!!

অবশেষে রাত ১টায় ঘুমানোর সুযোগ পেলাম। সারাদিনে সবমিলিয়ে ১ঘন্টাও বসার সুযোগ পাই নি। ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর ভেঙ্গে আসছিলো। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই ঘুম।

তৃতীয় দিন – ৬সেপ্টেম্বর

ঘুম ভেঙ্গে গেলো সকাল ৭টায়। সাড়ে ৭টার মাঝেই রেডী হয়ে নিচে নামলাম। নেমে শুনি আরেক যন্ত্রনা। আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়েরা দুপুরের আর রাতের খবর পুরা দল একসাথে খেতে নামতো। আবার খাওয়া শেষে একসাথে উপরে যেত, যেন সিকিউরিটি একসাথে সবাইকে গার্ড দিতে পারে। কিন্তু সকালের নাস্তা দলের সবার জন্য বাধ্যতা মূলক না। তাই যার যখন খুশি নাশতা করে যাবে। অগত্যা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ভিন্টেজে বসে থাকা লাগলো। একজন করে যায় আর আসে। এগারোটার সময় ৩জন গেলেন বাফুফে ভবনে ম্যানেজার’স মিটিং এ, ৩জন গেলেন মাঠ পরিদর্শনে আর ৩জন গেলেন শপিং এ। অবশ্য এদের মাঝে কেউই খেলোয়াড় ছিলেন না বলে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। সকালটা তাই মোটামোটি শুয়ে বসেই কাটালাম। তবে ঠিক একটার সময় রড্রিগো হাজির তার চাহিদা পত্র নিয়ে। আজ লাগবে ১০০ বোতল করে Gatoride আর পানি। ড্রেসিং রুমে নাকি ম্যাসাজ টেবিল আছে একটা, আরও একটা লাগবে। লাগবে বড় একটা টেবিল, যেটাতে কাগজপত্র ও ল্যাপ্টপ রাখা হবে। তাড়াতাড়ি রুমে গেলাম রেডী হয়ে আসার জন্য। লিফটের জন্য ৯তলায় দাঁড়িয়ে আছি। যেই লিফট খুলল, দেখি ভিতরে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া!!! আমার খুশি আর দেখে কে! তাড়াতাড়ি পকেটে থাকা ক্যামেরা বের করে একটা ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম! মারিয়াও সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলো! কী যে খুশি লাগছিলো তখন, তা বলে বুঝাতে পারবো না!!



অবশেষে দেড়টার সময় না খেয়েই স্টেডিয়ামে দে ছুট! সবকিছুর ব্যবস্থা করে এসে দেখি আর্জেন্টিনা দলও খেয়ে দেয়ে হোটেলের এগারো তলায় টীম মিটিং এ ব্যস্ত। আবার ৩টার সময় খবর এলো এখনই তাদের লাগেজ ম্যানরা লাগেজ নিয়ে স্টেডিয়ামে চলে যাবে। তাদের সাথে আমিও গেলাম। যথাসময়েই আমরা স্টেডিয়ামে হাজির। কীভাবে তারা ড্রেসিংরুম রেডি করে, তা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। তাদের লাগেজ আনতে পুরো একটি কভার্ড ভ্যান লেগেছে, শুধু এটা শুনেই আপনারা খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য ৩সেট জার্সি, ২জোড়া বুট, শেভিং কীটস, বডি স্প্রে, পারফিউম, চুইংগাম আরও কত কিছু যে রেডি করা থাকে। ড্রেসিং রুমে ওয়্যারলেস স্পীকারে সর্বক্ষণ গানও বাজতে থাকে। অবশেষে মেসিরা স্টেডিয়ামে এলেন। দল চলে আসার পর অবশ্য ড্রেসিং রুমে বাহিরের কারও ঢোকার অনুমতি নেই। তাই ওদের ডেলিগেটদের ভিভিআইপিতে বসিয়ে দিয়ে আমি চলে আসলাম ডাগ আউটের পাশে। যথাসময়ে খেলা শুরু হলো। সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগছিলো। আর্জেন্টিনা দলের ডাগ আইউটের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি!!!! সব সময় টিভিতে যা দেখেছি, ঠিক সেভাবে হাতে কাগজ কলম নিয়ে গবেষণা করছেন কোচ ও তার স্টাফরা, গোল হলে খেলোয়ারদের সাথে ডাগ আউটেও উল্লাস!! সব কিছুরই সাক্ষী ছিলাম আমি! মাঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম মেসি ম্যাজিক, দেখলাম আমার প্রাণের দল আর্জেন্টিনার জয়। খেলা শেষে দলের সাথেই পৌঁছে গেলাম হোটেলে। খেলোয়াড়েরা সবাই সরাসরি খেতে চলে গেলো। আর আমার দায়িত্ব পড়লো তাদের সমস্ত লাগেজ এয়ারপোর্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করার।
সব কাজ শেষ করে বসে আছি হোটেলের লবিতে, আর্জেন্টিনার চলে যাওয়ার অপেক্ষায়। রাত তখন সাড়ে এগারোটার মত। হঠাৎ করেই রড্রিগো আর পার্নেস এসে হাজির। আমাকে ডেকে বলল, “আমাদের সাথে একটু আসো, দরকার আছে।“ ভাবলাম, আবার কোন নতুন কাজ ধরিয়ে দিবে হয়তো! কিন্তু না!! তারা আমাকে সরাসরি নিয়ে গেলো ১০তলায়, ১০০৮নং রুমে! ঢুকে দেখি রুমে আয়েশী ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন আধুনিক ফুটবলের অবতার!! ফুটবলকে অন্যগ্রহের রূপ দেওয়া লিওনেল মেসি স্বয়ং!!! আমাকে ঢুক্তে দেখে নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেন। হাত মেলানো শেষে নিজেই পাশে বসতেও বললেন। এত বড় একজন মানুষ, যাকে এক পলক দেখার জন্য সমগ্র বিশ্বের মানুষ ব্যাকুল হয়ে থাকে, তার কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেয়ে আমি রীতিমত অভিভূত!!! উত্তেজনায় আমার শরীর তখন রীতিমত কাঁপছে! পার্নেস আমাকে বলল, “তুমি এই কয়দিন আমাদের জন্য যেভাবে পরিশ্রম করেছো, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য! তোমার এই পরিশ্রমের কথা মেসিও জানে। তার প্রতি তোমার অন্ধ ভক্তর কথা শুনে সেই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে!!” শুনে মনে হল এখনই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো! কোন মতে পকেটে থাকা ক্যামেরা রড্রিগোর হাতে দিয়ে বললাম ছবি তুলে দিতে। আর মেসির দিকে অটোগ্রাফের জন্য বাড়িয়ে দিলাম সাথে থাকা একটি ছবি। ছবি হাতে নিয়ে মেসি বলল আগে সেখানে আমার নাম লিখতে। লিখে দেওয়ার পর সেই ছবিতেই তিনি দিলেন তার সেই মহামূল্য অটোগ্রাফ!!! এরপর নিজেই দাঁড়িয়ে আমার সাথে ছবি তুললেন। আমি খুশিতে তাকে স্প্যানিশে বললাম, “TE QUIERO!” যার অর্থ “I LOVE YOU!” এটা শুনে মেসিও হেসে ফেললেন। আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যারাডোনার জামাতা সার্জিও আগুয়েরো চিৎকার দিয়ে বললেন, “WHY MESSI?? WHY NOT ME?” আমিও তাকে ধরে বললাম, “TE QUIERO TOO!” এটা শুনে সে হাসতে হাসতে বলল, “THEN HAVE A PICTURE WITH ME!” এটা বলে সে নিজেই আমার কাধে হাত দিয়ে ছবি তুলল। এরপর রড্রিগোর সাহায্যে মেসি আর আগুয়েরোকে জিজ্ঞেস করলাম, কোলকাতা আর ঢাকার মাঝে কোথায় বেশি ভালো লেগেছে? অকপটে তারা জানিয়ে দিলো, কোলকাতার চেয়ে ঢাকার আয়োজন ছিল অনেক অনেক বেশী সুন্দর! খুশিতে মনটা ভরে গেলো! গত ২দিনের সব কষ্টই সার্থক মনে হচ্ছিল তখন। অবশেষে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লিফটের কাছে আসলাম। তখন আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে পার্নেস আমার হাতে তুলে দিলেন আর্জেন্টিনা দলের প্রায় সব খেলোয়াড়ের অটোগ্রাফ সম্বলিত একটি জার্সি। বলল, “এটা সমস্ত দলের পক্ষ থেকে তোমার জন্য উপহার। KEEP UP THE GOOD WORK.” একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে তা আমার জানা নেই। সেই সময়ের অনুভূতি লেখার অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। কেননা সেই ভাষা আমার জানা নেই।



অবশেষে রাত ৩টায় মেসিরা ঢাকা ছাড়লেন। সেই সাথে শেষ হল আমার স্বপ্নের চেয়েও স্বপ্নময় দুটো দিন। যেই দিন দুটো হয়তো মৃত্যুর পরেও কখনো আমি ভুলবো না।

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ২:৫৫
৭৫টি মন্তব্য ৬৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×