গতি-দ্য স্পীড। বাংলা চলচ্চিত্রের এক নতুন দিগন্ত!
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
দেশ আজ এক ক্রান্তি লগ্নে উপনীত। সমগ্র দেশে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আজ এক স্থবির অবস্থা বিরাজমান। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাব, হত্যা-গুম সব মিলিয়ে দেশের মানুষের কাছে একটু প্রাণখুলে হাসতে পারা এখন সৌভাগ্যের বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে খুব কম উপলক্ষ্যেই সারা দেশের মানুষ একসাথে প্রাণ খুলে হাসার সুযোগ পেয়েছে। আর সর্বশেষ সেই উপলক্ষ্যটি এনে দিলেন বাংলাদেশের আলোচিত নায়ক ও প্রযোজক এম.এ.জলিল ওরফে অনন্ত।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বেশ কয়েকবছর ধরে সিআইপি মর্যাদা ভোগ করা এই ধনকুবের ব্যবসায়ী গত বেশ কিছুদিন যাবৎ দেশের চলচ্চিত্রের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। নিজের টাকায় সিনেমা বানিয়ে এবং নিজেই সেখানে নায়ক হয়ে তিনি পর পর উপহার দিয়েছেন “খোঁজ-দ্য সার্চ” এবং “হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ” এর মত দু’দুটি ব্লকবাস্টার কমেডি ছবি। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি এবার নিয়ে এসেছেন তার নতুন চলচ্চিত্র “দ্য স্পীড”, যেখানে তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছেন নিজের অতীতের সব পারফরম্যান্স!
একজন অনন্তভক্ত হিসেবে আমার দায়িত্ব তাঁর সব ছবি হলে গিয়ে দেখা। তাই দ্য স্পীড মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথেই তা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম। অপেক্ষার প্রহর শেষে গত শনিবার (১২মে) গেলাম বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে। গিয়ে দেখি সে এক এলাহী অবস্থা! সিনেপ্লেক্সে ঢোকার জন্য বিশাল লাইন। সবাই পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছেন অনন্ত তথা স্পীড দর্শনে। শুনলাম আজকের সব টিকিটই নাকি আগের দিন বিক্রি হয়ে গেছে! বুঝতে পারলাম, দেশের মানুষ হাসিনা-খালেদা-এরশাদ এমনকি ডঃ ইউনুসের চেয়েও অনন্তকেই বেশি ভালোবাসে।
যাই হোক, দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে ঢুকলাম মূল সিনেমা হলে। সিট খুঁজে বসার সাথে সাথেই দেখি শুরু হয়ে গেলো “দ্য স্পীড”। অনন্তর জনপ্রিয়তা নিয়ে আমার ভাবনা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ অনন্তর নাম পর্দায় ভেসে উঠার সাথে সাথেই সমস্ত হল জুড়ে দর্শকদের তুমুল করতালি।
এবার আসি সিনেমার বর্ণনায়। প্রথমেই দেখানো হলো বাংলাদেশের বিজনেস টাইকুন অনন্য চৌধুরীর (চলচ্চিত্রে অনন্তর নাম) পরিবার। পরিবার বলতে তার এই পৃথিবীতে একমাত্র সম্বল- আদরের ভাতিজি দৃষ্টি (দীঘি)। এছাড়াও আছে দৃষ্টির দুজন সেবিকা, যাদের দেখে আপনারা আবার কেউ ব্রক্লেসনার অথবা জন সিনা ভেবে ভুল করবেন না যেন! রীতিমত হাতির বাচ্চা সদৃশ এই দুই সেবিকার একমাত্র কাজ, হাতে ট্রে নিয়ে দীঘির দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা। দীঘির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুরু চলিলেন নিজের ফ্যাক্টরি এ.জে.আই গ্রুপে। যাওয়ার পথে এক বেকার যুবককে দুইটাকার নোটের মত করে একখানা চাকরিও দিয়ে গেলেন। ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার পর বোঝা গেল, অনন্য চৌধুরী একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হলেও আদতে তিনি একজন যন্ত্রপ্রকৌশলী। কেননা ফ্যাক্টরীতে দক্ষ মেকানিকও যেই মেশিন ঠিক করতে পারলো না, অনন্যর এক ছোঁয়াতেই তা ধপাধপ কাজ করা শুরু করে দিল।
অনন্য চৌধুরীর সততার কাছে দেশের অন্য সব ব্যবসায়ী তখন রীতিমত অসহায়। সমস্ত দেশে চাল, ডাল, কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পর্যন্ত সব ব্যবসাতেই তার আধিপত্য। এদিকে অসৎ ব্যবসায়ীদের নেতা আলমগীর, যিনি কিনা ধূমপান ছাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, হাতে একটি নেভানো সিগারেট ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন, “নোবেল প্রাইজ কীভাবে আসে তা আমরা যেমন জানি, তেমনি অনন্য চৌধুরী কি খেয়ে এইসব সিনেমা বানায়, তাও আমরা জানি।” বোঝা গেল, হিলারী ক্লিনটনের তদবিরেও অনন্য চৌধুরীর বাঁচার চান্স কম। আলমগীরের নির্দেশে অনন্যকে মারতে বিশাল গুন্ডা বাহিনী আসলো, যারা অনন্তর সুডৌল দেহের ঝলকানিতে এক মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেলো! উপায় না দেখে আলমগীর খবর দিলেন বিখ্যাত মাফিয়া ডন অ্যান্ড্রুকে। ঘটনাচক্রে জানা গেল, অ্যান্ড্রু আসলে বাংলাদেশেরই কৃতী শ্যুটার এনায়েতুল্লাহ। ২৫বছর আগে বিদেশে শ্যুটিং টুর্নামেন্টে খেলতে যেয়ে তিনি চম্পট মেরেছিলেন। অ্যান্ড্রুর এই কাহিনী শুনে হঠাৎই আমার চোখের সামনে ম্যাঞ্চেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে চম্পট দেওয়া বাংলাদেশের কৃতী সাঁতারু কারার ছামেদুলের চেহারা ভেসে উঠলো। আহারে! ছেলেটা দেশে থাকলে এতদিনে মাইকেল ফেলপস আর ইয়ান থর্পের নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলতো।
যাই হোক, এরপর বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়ালো, সেই জলে অনেক বেওয়ারিশ লাশও পাওয়া গেলো। হঠাৎই দৃশ্যপটে হাজির অনন্যর অফিসের ম্যানেজারের বোন সন্ধ্যা (মালয়েশিয়ান সুপার মডেল(!) পারভীন)। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে তিনি আসলেও এত ফ্লাইট থাকতে ঠিক কী কারণে তিনি পাকিস্তান এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে করে ঢাকায় এলেন, তা বোধগম্য নয়। তিনি এসেই অনন্যর প্রেমে পড়লেন, অনন্যও তার প্রেমে পড়লো। দুজনে মিলে গান গাইলো “আমি রোমিও, তুমি জুলিয়েট। প্রেম করিতে আজ, করবো নাকো লেট।” এরপর দীঘিকে নিয়ে ওয়ান্ডারল্যান্ডে যাওয়ার অপরাধে সন্ধ্যা অনন্যর কোম্পানি হতে বরখাস্ত হলেন, তবে জরিমানা স্বরূপ ঐ রাতেই অনন্য তাকে বিবাহ করলেন। আমাদের এম.এ.জলিল ওরফে অনন্ত ওরফে অনন্য সাহেব যে হা-ডু-ডু খেলার খুব ভক্ত, তার প্রমাণ তিনি বাসর ঘরে দিয়েছেন। অনেক কসরত করে সন্ধ্যাকে জাপটে ধরে তিনি নিজেদের চাদরে ঢেকে ফেলে বুঝিয়ে দিলেন, এই সিনেমা ছোট-বড় সবার জন্যই।
এরপর শুরু হলো আসল সিনেমা। জ্বি, প্রিয় পাঠক, প্রায় এক ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর বুঝতে পারলাম আসল সিনেমা এখন শুরু হয়েছে, যখন দেখলাম অনন্য সাহেব আর সন্ধ্যা হানিমুনে যেয়ে একই ডিজাইনের আলাদা রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি পরে কক্সবাজারের সৈকতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, হঠাৎ করে আবারও দুষ্টু আলমগীরের গুন্ডা বাহিনী সেখানে অ্যাটাক করলো, আর ‘ক্রসফায়ারে’ পড়ে দীঘির করুণ মৃত্যু হলো।
এরপর সিনেমায় যা ঘটলো, তা বর্ণনা করার সাহস/ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই। প্রিয় ভাতিজিকে হারিয়ে অনন্য গেলো মালয়েশিয়ায়। সেখানে ইলিয়াস আলীর মত সন্ধ্যাকেও হঠাৎ করে গুম করে ফেলা হলো। ধুন্ধুমার অ্যাকশান, হৃদয় উথাল-পাথাল করা আবেগ, এক মালয়েশীয় ললনার সাথে সাময়িক প্রেম এবং সন্ধ্যাকে খুঁজে বের করার মিশন – সব মিলিয়ে এক অবিশ্বাস্য “ঈশপীড” এ ছবি এগিয়ে গেলো। আর শেষ দৃশ্যে যে ক্লাইমেক্সটি দর্শকদের জন্য অপেক্ষা করছিলো, তা বর্ণনা করতে স্বয়ং রবী ঠাকুরও উপমার সংকটে পড়বেন নিশ্চিত। শুধু এই ক্লাইমেক্সটি দেখার জন্যই আমি ঠিক করেছি, আরও একবার পুরো ছবিটি দেখবো। আর পুরো সিনেমায় অনন্য সাহেবের কাজাখস্তান এবং হন্ডুরাসের ভাষার মিশ্র উচ্চারণে ইংরেজী বলা শুনলে আমি নিশ্চিত, ব্রিটিশ কাউন্সিল এদেশ থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালাবে! বিশেষ করে “ঈশটপ। গিব মি ইয়ুর কাড়।” অথবা “আই ডন ওয়ান টো কিলিউ। আই ওয়ান ইয়ুর আই কোন্টাক।” টাইপ ডায়ালগ শুনলে যে কেউ ভিড়মী খেতে বাধ্য।
এতক্ষণ যা বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তাতে পুরো সিনেমার সিকি ভাগ আমেজও আপনি পাবেন না। পুরো মজা নিতে হলে আপনাকে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও হলে যেয়ে পুরো ছবিটি দেখতে হবেই! বর্তমানে এর চেয়ে কম খরচে এত খাঁটি বিনোদন সমস্ত পৃথিবী চষে বেড়ালেও আর কোথাও পাবেন না। আর সমস্ত দেশবাসীর পক্ষ থেকে জনাব এম.এ.জলিল অনন্ত কে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন। দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আপনার এই প্রয়াস অবশ্যই সফল। এজন্য আপনাকে অবিলম্বে নোবেল শান্তি পুরস্কারে (সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কর্তৃক যাচাইকৃত) ভূষিত করার দাবি জানাচ্ছি।
৩৮টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প
তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।
সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন