somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

কল্পদ্রুম
জ্ঞানিরা বলেন মানুষ জন্মমাত্রই মানুষ নয়,তাকে যোগ্যতা অর্জন করে তবেই মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে হয়।যোগ্যতা আছে কি না জানি না,হয়তো নিতান্তই মূর্খ এক বাঙ্গাল বলেই নিজেকে নির্দ্বিধায় মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ফেলি।

অণুগল্পঃ সাত রাজার মানিক

২২ শে জুন, ২০২০ রাত ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শিকদার বাড়ির বড় উঠোনে ছড়ানো ছিটানো কিছু জমায়েত দেখা যাচ্ছে। ভাবভঙ্গী দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় এরা স্রেফ বিনোদনপ্রত্যাশী জনগণ। জমায়েতের এক অংশ ৭-১০ বছরের ছেলেপেলে। এরা মাঠে খেলা বাদ দিয়ে এখানে এসে জুটেছে। বাকীরা মহিলা — আশেপাশের বাড়িরই বউ ঝি এক একজন। বিনোদনের উৎস উঠোনের মাঝে দাঁড়ানো হিজড়ার দল।

দলের সদস্য সংখ্যা সব মিলিয়ে পাঁচজন। দলের সবচেয়ে বয়সী সদস্য পান মুখে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। আর একজনকে ঘিরে বাকী তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। তারা দুহাতের তালুতে বিকট শব্দে তালি দিয়ে তাল দিচ্ছে। দরকারে কোরাস দিচ্ছে। আর মাঝখানের জন ঘুরে ঘুরে গান গাইছে। সুরের অবস্থা বেশ বেগতিক। তবে সুরেলা কণ্ঠ এ দলের কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ নয়। মাঝের বেসুরো গাতকী এই দলের নেত্রী। শিশুটি তাই তার কোলে। শিকদার বাড়ির প্রধান রসু শিকদারের কনিষ্টতম পৌত্র।

রসু শিকদারের তিনপুত্রের সবাই বিবাহিত। তিন পুত্রের বউই বাড়িতে থাকে। বড় বউ আর ছোট বউয়ের ঘরের আলো আরো দুইবছর আগেই জ্বলেছে। মেজো বউয়ের বেলায় একটু দেরী হলো। তবে দেরী হলেও যে শেষমেষ ছেলে হয়েছে এতেই রসু শিকদার খুশি। বাড়ির ভিতরের বারান্দায় বউয়েরা তাঁদের শাশুড়ি স্থানীয় মুরব্বিদের সাথে দাঁড়ানো। হিজড়াদের হই হুল্লোড়ে তারাও ক্ষণে ক্ষণে তাল দিচ্ছে।

শিকদার বাইরের বারান্দায় বসে। ভাবলেশহীন মুখে জ্বলন্ত বিড়ি। আর আড়চোখে বউদের কাণ্ডকারখানা দেখছে। ''বেক্কল মেয়েছেলে। এখন তাল দিতেছো। এরপরে যখন এরা শাড়ি কাপড় ধরে টান দেবে তখন বুঝবা ঠ্যালা।‘' বিড়বিড় করে সে। এদের এখনই বিদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। টাকা পয়সা কত চায় কে জানে!

''নগদ এক হাজার টাকা আর তিনটা ভাজ করা শাড়ি দিবি। এর কমে হবে না।'' দলের নেত্রী বলল। এর নাম জবা। এতক্ষণ নাচ গানের কারণে সে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবুও গলার জোর ঠিক আছে।

''টাকার গাছ আছে তো আমার! আশীর্বাদ যা করছো ভালো করছো। খুশি হয়ে নতুন নোটে তিনশ টাকা দিচ্ছি।নিয়ে যাও তো বাপু। আর দিতে টিতে পারবো না।''

''পারবি না ক্যান? সাত রাজার মানিক পাইছিস ঘরে। তাও কিপটামি ছাড়লি না। টাকাও দিবি। শাড়িও দিবি।' বলেই বিশেষ ভঙ্গিতে দুইবার হাততালি দিলো জবা।

আরো কিছু সময় ধরে এই দরাদরি চলতে থাকে — সম্পূর্ণ অপার্থিব এক বিষয়ের মূল্য নির্ধারণের প্রচেষ্টায়। আশ্চর্য এই রীতির তাৎপর্য বোধহয় পৃথিবীর আর কোন সংস্কৃতির মানুষ কখনো বুঝতে পারবে না।

উপস্থিত জনতা মাঝেমাঝে দুই পক্ষের কথায় ফোঁড়ন কাটে। উদ্দেশ্য দরাদরিটা আরো মজাদার করে তোলা।বেশিরভাগই অবশ্য জবার পক্ষে। কারণ জবার জিত হলেই যে বিনোদনটা বেশি পাওয়া যাবে। জাতি হিসেবে আমাদের কাছে বিনোদনের গুরুত্ব বেশি।

সবশেষে পাঁচশত টাকা এবং দুইটি নতুন শাড়ির দাবিতে জবা কোমরে আঁচল বেধে বসলো। এর কমে সে নড়বে না। শিকদার পড়লো দ্বন্দ্বে। যেভাবে গো ধরে আছে এদের দাবি না মেনে আর উপায় নাই মনে হচ্ছে। ভিতরের বারান্দা থেকেও উশখুশ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সত্যি বলতে জবার কিপ্টামির খোঁটা একেবারে ভিত্তিহীন না। এই পাঁচশ টাকার আফসোসও যে অনেকদিন পোড়াবে এইটা শিকদার ঠিক বুঝতে পারছিলো।

এমন সময় সম্ভবত বাড়ির ভিতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, ''এত কিছু যে চাও। এই বাচ্চা তোমারে দিয়া দিবো। কয় ট্যাকা দেবা কও দেহি?''

জবা যেন কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। তারপর ঝণাৎ করে শব্দ হলো মাঝ উঠানে। একটা কাপড়ের থলে পড়ে আছে। খোলা মুখ দিয়ে সোনালি রঙ উঁকি দেয়। আওয়াজে বোঝা যায় ভিতরে ভারী কিছু আছে।

''এইখানে যা আছে সব তোগো। নগদ টাকা আমার যা আছে দিয়া দিমু। দিবি আমারে বাচ্চা?''

বিচিত্র এক ব্যাপার ঘটলো। জবার বলার ভঙ্গিতে কি ছিলো কে জানে। অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলো বা প্রকৃতির খেয়ালিপনায় অলভ্য সম্পদের প্রতি জবার হাহাকারের কতটুকু অনুধাবন করতে পারলো তাও সন্দেহজনক।

হয়তো ঘটনার আকস্মিকতার কারণেই চারিদিক হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেলো। শুধু রসু শিকদারকে দেখা গেলো ফতুয়ার পকেটে হাত ঢুকাতে। ঝামেলা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলানোই ভালো।



(কিছুটা পরিমার্জিত করে রিপোস্ট করা হলো।)


বছর খানেক আগের সেই পোস্টে শ্রদ্ধেয় ডঃ এম এ আলীর একটি মন্তব্যের কিছু অংশ তুলে দিলাম।

"আমরা সকলে্ই জানি জীবন ধারণের যে মৌলিক অধিকার আছে তা থেকে বঞ্চিত হিজড়া জনগোষ্ঠী। মানুষ হিসেবে চলাফেরা করতে গেলেই সব স্থানেই উপহাসের পাত্র হতে হয়। হিজড়াদের সরকারি চাকরীর কোন কোটা নেই। বয়স্ক, প্রতিবন্ধ, বিধবা ভাতা থাকলেও হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোন ভাতা নেই। ভোটাধীকার থাকলেও ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার নেই। পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থা নেই।অনেক হিজড়া পারিবারিকভাবে লোক চুর অন্তরালে থাকে। পরিবারের অন্য সদস্যরা লজ্জা ও ভয়ে তাদের কথা প্রকাশ করেন না।তাদের রুচি পছন্দও প্রকৃতিরই অংশ। প্রকৃতির এই হিসেবকে মেনে নিতে না পারলে তাদের প্রতি যে অবিচার করা হচ্ছে এই বোধও আমাদের মাঝে জাগ্রত হয়না । হিজড়ারা তাদের পছন্দমতো জীবন যাপন করবে এটা সবাইকে মেনে নেয়া উচিত কিস্তু তাও আমরা মানছিনা । আর পাঁচজন মানুষের মতোই তাদের জীবন। নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হিজড়া সম্প্রদায় দলিত শ্রেণীর মানুষ হিসেবে বাংলাদেশে বসবাস করে।এদের নানা ঢং-এর পোশাক এবং ব্যবহারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও বস্তিবাসীরা হয়ে উঠেছে তাদের আপনজন। সামাজিকভাবে নিঘৃত এই সম্প্রদায় সদা হাস্যোজ্জ্বল ও অন্যের আনন্দের খোরাক হলেও কেউ তাদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসে না। যে কারণে তারা বিকৃত যৌন পেশা, মানুষের কাছে জোর করে টাকা আদায় এবং নাচ গানকে জীবিকা নির্বাহের আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। নিজেদের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি পিতা-মাতা, ভাই-বোন সহ অন্যদের প্রতিও তারা দায়িত্ব পালন করে । চিকিৎসা গ্রহণ করতে গেলেও কোন ডাক্তারের চেম্বারে তাদেরকে ভালভাবে বসতে দেয়া হয় না। অনেকেই বলে থাকেন হিজড়াদের জন্য প্রতিটি জেলায় একটি হিজরা পল্লী স্থাপন আরে ও তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গড়ে তুললে সামাজিক অবস্থানে পরিবর্তন আসবে তাদের প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা অবহেলা থাকবেনা ।"
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ২:৪৯
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×