কিশোরবেলায় ''গ্যাং'' ব্যাপারটিকে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগতো। চলচ্চিত্র এবং বই সেক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী। রঙ্গিন পর্দায় কিংবা ছাপানো পাতায় তাদের অতি ভয়ঙ্কর কাজকেও মনে হত রোমাঞ্চকর কিছু। এই দশকে "কিশোর গ্যাং" শব্দটা যে পর্যায়ে এসেছে। এখন একে বিষফোঁড়ার নামান্তর বলেই মনে হয়। চারপাশে এরা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, চাইলেও উপেক্ষা করা যায় না৷ সেটা উচিতও হবে না।
কেন এই বিষফোঁড়াগুলো তৈরি হচ্ছে? এ নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়েছে। আমার মতে প্রয়োজনের তুলনায় সেটা কম। এটা কেবল বর্তমানের সমস্যা নয়। বরং ভবিষ্যত প্রজন্মান্তরে বড় বিপদের ইঙ্গিতবাহক। এবং এ সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা অপেক্ষা ব্যক্তিগত অবদানটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বাগ্রে যেটি কৌতূহলউদ্দীপক, এই "কিশোর গ্যাং" দের কেন "গ্যাং" বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়? নানারকম অপরাধের কারণে এরা আমাদের কাছে পরিচিতি পাচ্ছে। অপরাধ না করলে এবং ধরা না পড়লে আমরা এদের অস্তীত্ব সম্পর্কেও জানতাম না (স্থানীয়গুলো বাদে)। তাহলে এদের সরাসরি অপরাধী কিংবা সন্ত্রাসী না বলে কেন "গ্যাং" বলা হচ্ছে? এর পিছনে সম্ভাব্য দুটো কারণ থাকতে পারে। হয়তো এদের ধরে নানান প্রশ্নোত্তরের পর দেখা গেছে —এদের বৈশিষ্ট্য সেরকমই। তাই এরা "গ্যাং"। অথবা এই দলগুলো নিজেদের "গ্যাং" বলে পরিচয় দেয় (সত্যিই দেয়)। ওদের ব্যবহৃত শব্দটাই সংবাদ মাধ্যম এবং আইন প্রয়োগকারীরা বেছে নিয়েছে। সংবাদ শিরোনামে আলাদা লেভেলিং করার সুবিধার্থে। যাতে অন্য অপরাধীদের থেকে এদের পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায়।
চিন্তার বিষয় হলো, একটা সমাজে "গ্যাং" তৈরির পিছনে যে কয়টি ধারণা চালু আছে। তার ভিতর ''লেভেলিং থিওরি'' অন্যতম। কোন গ্যাংকে তাদের নামেই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো আমরা পরোক্ষভাবে তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সে যে তার নিজের নামে দেশ ব্যাপী পরিচিতি পাচ্ছে। এটাই 'গ্যাং' মেম্বারদের কাছে একটা বড় সাফল্য। এদেশের প্রেক্ষিতে সম্ভবত সবচেয়ে বড়ও বটে।
এরা 'গ্যাং' কি না সেটা বোঝার জন্য যে গবেষণা দরকার সেটা এখনো হয়েছে কি না আমি জানি না। করোনাকালীন সময়ে কিশোরদের মানসিকতা নিয়ে কিছু জরিপ হয়েছে। এরকমটা পড়েছি। নির্দিষ্ট করে এই বিষয়ে কিছু হয়নি। তবে ''গ্যাং'' কনসেপ্ট নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে সেই অর্ধশত বছর আগে থেকে।
সাধারণত গ্যাং বলতে বোঝায় একটা দল যাদের সদস্যরা কিশোর থেকে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক। এই দলের নির্দিষ্ট নাম থাকে। যেটা তাদের নিজেদেরই ঠিক করা। নির্দিষ্ট টহল এলাকা আছে। হয়তো নির্দিষ্ট ড্রেসকোড এবং সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ পর্যন্ত আছে। তবে যেটা বলে নির্দিষ্ট কোন কাজ নাই। এই দলের একজন নেতা থাকে। সাধারণত নেতার কাজই হলো গ্যাং এর পরবর্তী টার্গেট ঠিক করা। কাকে দলে রাখবে কিংবা কাকে রাখবে না সেটা নির্দিষ্ট করা৷ গ্যাং মেম্বারদের যে কোন বিপদে আপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমার মনে হয় আমাদের সমাজে গ্যাং/কিশোর অপরাধী দল তৈরি হওয়ার পিছনে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। একটা কিশোর বয়সের ছেলে মেয়ের কাছে তার গ্যাং একটি আশ্রয়স্থল৷ সে যখন বিপদে পড়ে তার গ্যাং তাকে নিরাপত্তা দেয়। তার অপমানকে সবার অপমান বিবেচনা করে প্রতিপক্ষকে উচ্চতর শিক্ষা দেয়৷ তার যে কোন সমস্যার মুশকিলে আসান হলো এরা। যেটা আসলে ছেলে বা মেয়েটির পরিবারের দায়িত্বের ভিতরে পড়ে। কোন ভাবে তারা সেটা পালনে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা হচ্ছে। ব্যর্থতার কারণ কি? সন্তানের সাথে বাবা মায়ের জেনারেশন গ্যাপ, বাবা মায়ের ব্যক্তিগত হতাশা, পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব, অর্থনৈতিক দুর্বলতা এগুলো মোটাদাগে বলা যেতে পারে। অনেক পরিবারে দেখা গেছে বাপ চাচারাও তাদের জমানায় এগুলোই করেছেন। ছেলে পারিবারিক লিগ্যাসিটাই বহন করছে। কিছু ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদেরও ছাড়িয়ে গেছে। কারণ হিসেবে এটাও খুব দুর্লভ নয়। প্রজান্মন্তরে যেই বড় বিপদগুলোর কথা অপরাধবিজ্ঞানীরা বলেন তার ভিতর এটা একটা। অপরাধ বিজ্ঞানী ম্যালকম ক্লেইনের এ ব্যাপারে বক্তব্য এমন, "দলীয় সহিংসতার (gang violence) সবচেয়ে বড় শিকার হলো তাদের নিজের সদস্যরাই। এদের সার্বিক কর্মকান্ডের মধ্যে সহিংসতা ক্ষুদ্রাংশ। পার্থিব প্রভাবও সাধারণত খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। সত্যিকারর্থে, আগামী প্রজন্মের একজন স্বামী, পিতা ও অভিভাবক হিসেবে তার ব্যর্থতাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি।"
একজন কিশোরের বিচরণ ক্ষেত্র তিনটি। পরিবার, এলাকা এবং স্কুল কলেজের বন্ধু সার্কেল। ঐ কিশোরের ব্যক্তিত্ব, আচরণ, চিন্তাভাবনা এই তিনটি ক্ষেত্রের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। কোন এক বা একাধিক ক্ষেত্র তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সে অন্য ক্ষেত্রের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে৷ এই কিশোর দলগুলোর ক্ষেত্রে পরিবারগুলোর বরাবরই অভিযোগ এরকম — এরা বাড়ির কথা শুনে না। প্রতিবেশীদেরও সেরকমই মত। এরা তাহলে কাদের কথা শোনে বা মানে? নিজের তথাকথিত "গ্যাং" এর ভাই বেরাদরদের কিংবা এলাকার ক্ষমতাবান বড় ভাইয়ের কথা। এই ছেলে বা মেয়েটা যখন হত্যাকান্ডের মতো বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তখন আমরা অবাক হই। ভাবি, এইটুক একটা ছেলে আর একজনের পেটে চাকু মেরে দিলো!! সবই 'আকাশ সংস্কৃতির ফসল', 'লেখাপড়া করে না', 'ধর্ম কর্ম করে না' ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে এইগুলো প্রভাবক মাত্র। মৌলিক সমস্যা পরিবার ও পরিবেশে অনেক আগে থেকেই ছিলো। এগুলো ব্যর্থ হচ্ছে বলেই এই প্রভাবকগুলো প্রভাবিত করতে পারছে৷
আকাশ সংস্কৃতির (প্রচলিত তাই লেখা। আদতে এটার সাথে একমত নই।) প্রভাব, শিক্ষার অভাব, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব এগুলোর ভূমিকা যে একেবারেই নেই তা নয়। নৈতিক শিক্ষা বা মূল্যবোধের অভাবে সমাজে ইতোমধ্যে ভুল উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত হয়েই আছে। সেগুলোই এদেরকে এই বেপরোয়া পথে হাঁটতে আরো উৎসাহিত করছে। এরা যখন দেখছে এলাকার বড় ভাইয়ের নামে এক ডজন মামলা আছে। পুলিশ তাকে দেখলে সালাম দেয়। এলাকায় একজন অধ্যাপকের থেকে একজন অর্ধশিক্ষিত পাতি নেতার দাম বেশি। স্বভাবতই সে নেতাই হতে চাইবে। নেতারাই তার রোলমডেল। তাদের ধারণা অনুযায়ী নেতা হতে গেলে যেই "ম্যানলি" বৈশিষ্ট্য থাকতে হয় (মাদক গ্রহণ, অস্ত্রবহণ, রমণীবশীকরণ, ফিল্মি কায়দায় বাইক স্ট্যান্ট, এলাকা দখল ইত্যাদি) তার পাঠ নিচ্ছে এসব নেতাদের দেখে। সাথে আছে সেলিব্রেটিদের উদ্ভট ফ্যাশন সেন্স। এই পাঠেরই প্রারম্ভিক শিক্ষা হলো যার নেতৃত্বগুণ আছে সে বিষফোঁড়া তৈরি করো। যার নাই সে অন্যের বিষফোঁড়ায় সদস্যপদ নাও।
আমাদের আশেপাশের কিশোর গ্যাং/অপরাধী দলগুলো সমাজের দুটো স্পেক্ট্রামে তৈরি। একটা হলো যাদের কোন অভাব নেই। অন্যটি যাদের সবকিছুরই অভাব। মধ্যবিত্তকে এই সাবকালচারে ভাসতে খুব কমই দেখছি। সবচেয়ে উপরের স্পেক্ট্রামের দলগুলোর কাজকর্ম এবং পত্রিকায় অপরাধ সংঘটনের মোটিভগুলো দেখলে কেন জানি আমার এন্থনি বার্জেসের "ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ" উপন্যাসের কথা মনে হয়৷ সবচেয়ে নীচের স্পেক্ট্রামের দলগুলোর থেকে এদের কাজকর্ম, চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নীচের দলগুলো তৈরি হওয়ার পিছনে টাকা পয়সা, সুযোগ সুবিধার অভাব একটা বড় কারণ। এদের সমস্যাগুলো অনেকখানি বাস্তবিক। উপরের দলগুলোর সমস্যা অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক। এই ব্যাপারগুলো আলাদা করা প্রয়োজন৷ কেননা এই দুদলের কারেকশনাল প্রোগ্রাম কখনো একই রকম হওয়া উচিত হবে না। এদেরকে একই কাতারে রাখাও ঠিক না।
এই সমস্যার সমাধান নিয়ে অনেকেই ভাবছেন। পাঠাগার তৈরি, খেলার মাঠ তৈরি, স্কুল কলেজের বিতর্কের ব্যবস্থা, নাচ গান নাটক কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি সৃজনশীল ধারার চর্চা — এগুলো সমস্যার সমাধান হিসেবে চমৎকার। পুলিশ ইতোমধ্যে 'গ্যাং' প্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করেছে। বিভিন্ন "গ্যাং"–ভুক্ত ছেলে মেয়েগুলোকে একজায়গায় ডেকে নীতিবাক্য শোনাচ্ছে। যারা অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে৷ এগুলো সবই ভালো কাজ। কিন্তু আমার মনে হয়, এগুলো আশানুরূপ ফলপ্রসূ হবে না। যদি না যেই পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক দায়িত্বহীনতার কথা বলছি সেটা নিয়েও একই সাথে কাজ করা হয়৷ কাউন্সেলিং বা কর্মশালা যেটাই হোক৷ সেটা সবার আগে হওয়া উচিত এই ধরণের দলীয় সদস্যদের পরিবারগুলোকে নিয়ে। চিহ্নিত এলাকাগুলোতে কমিউনিটি ভিত্তিক এপ্রোচই সবচেয়ে জরুরি। উপরন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে "কিশোর সংশোধন কেন্দ্র" আইডিয়াটাই অচল। প্রথমত আমাদের এসব সংশোধন কেন্দ্রের অন্দরচিত্র কেমন সেটা কয়েক মাস আগে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের হত্যাকান্ড থেকে কিছুটা অনুমেয়। দ্বিতীয়ত এই পদ্ধতি এদেরকে পরিবার এবং সমাজের বাকী অংশ থেকে আরো বিচ্ছিন্নই করে ফেলছে। যেখানে বিচ্ছিন্নতা কমানোই মূল উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিলো।
পুরো লেখাতে 'গ্যাং' শব্দটি উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে আছে। কারণ আমার মনে হয়, বাংলাদেশে যেভাবে "কিশোর গ্যাং" লেভেলিং করা হচ্ছে। এটা ঠিক না। এরা আসলে গ্যাং ঠ্যাং কিছু না। যদিও তারা সেরকমটাই হতে চায়। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা গ্যাং মেম্বারদের ভিতরে যে ধরণের "কোহেসিভনেস" এবং "ডেডিকেশন"-এর কথা বলেন। এসব দলে সেরকম কিছু দেখা যায় না। যারা হত্যাকান্ড কিংবা ধর্ষণের মতো অপরাধ করে ধরা পড়ছে তারা অপরাধীই। যারাই এসব ফ্যান্সি নাম দিয়ে গ্যাং তৈরি করছে তাদের সবাই এরকম অপরাধে জড়িত নয়। যেটুকু উগ্র জীবন যাপন এরা করছে৷ সেগুলো সুকান্তের দুঃসাহসিক আঠারোর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া৷ সব প্রজন্মেই এটা ছিলো। কিন্তু এর আগের প্রজন্মগুলোর ইন্টার্নাল কন্ট্রোল (পরিবারের শাসন, মানবিক মূল্যবোধ) এবং এক্সটার্নাল কন্ট্রোল (আইনের প্রয়োগ, সামাজিক বিধি নিষেধ) যেভাবে কাজ করতো। এখন সেগুলো করছে না। এটাই দুশ্চিন্তার বিষয়। এরা গ্যাংস্টার না হয়েও গ্যাংস্টার ভাব নিতে গিয়ে সবাইকে নিয়ে বিপদে পড়ছে।
আমরা যখন এদের নিয়ে সমালোচনা করি পুরো দোষটা এদের উপর চাপিয়ে দেই। অথচ বেশিরভাগ দায় অগ্রজ প্রজন্ম হিসেবে আমাদেরই। এদের প্রতি আমাদের সহানূভুতিশীল হওয়া উচিত। এরা একটা শক্তি। এদের বেশিরভাগেরই কাজের স্পৃহা অনেক বেশি। এই শক্তিকে গৎবাঁধা নিয়মে আটকাতে চেষ্টা না করে, কিভাবে উপকারী পথে প্রবাহিত করা যায় সেটা ভেবেই কাজ করা উচিত৷
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০২১ রাত ৮:৪৫