somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

কল্পদ্রুম
জ্ঞানিরা বলেন মানুষ জন্মমাত্রই মানুষ নয়,তাকে যোগ্যতা অর্জন করে তবেই মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে হয়।যোগ্যতা আছে কি না জানি না,হয়তো নিতান্তই মূর্খ এক বাঙ্গাল বলেই নিজেকে নির্দ্বিধায় মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ফেলি।

গল্পঃ দ্বিধান্বিত প্রকৃতির ঘাসফরিঙ

১৫ ই জুন, ২০২১ রাত ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"জায়গাটা আসলেই সুন্দর।" মিতিনার কথায় শামসুর নিজের বাছাই করা প্রকৃতির এই অংশকে আর একবার লক্ষ্য করে।

ওরা দুজন আদিগন্ত বিস্তৃত রেললাইনের এপার আর ওপার ধরে হাঁটছে। প্রথম বিকেলের আলোয় ঝাঁকড়া পাতার ছায়া পড়েছে পথের উপর। দুধারের উঁচু উঁচু রেইন ট্রি গুলো যেন অতন্দ্র প্রহরী। এদের পরেই বিস্তৃত সবুজ মাঠ। মাঠ শেষে আরো গাছের সারি। ফাঁকে ফাঁকে টিনের ছাউনি। তার উপরে পরিষ্কার নীল আকাশ। শামসুরের দৃষ্টি প্রকৃতির জড় অনুষঙ্গ থেকে প্রাণের দিকে ফিরে আসে। মিতিনা ধীর পায়ে ওর সমান্তরালেই হাঁটছে। কাঁধে ছোট্ট একটি ব্যাগ। সাদা কামিজ। যতদূর মনে পড়ে ওর পিঠে লম্বা চুল ছড়ানো ছিলো। এখন বব কাট। এটাও কি একরকম শোকের বহিঃপ্রকাশ...খুবই নিয়ন্ত্রিত আকারে!

শোক সম্পর্কিত একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা ঘন্টাখানেক আগেও শামসুরকে ভাবিয়েছিলো। চিন্তাটা এরকম, শোকের তীব্রতার প্রকাশ কি নর-নারীতে একই মাত্রায় হয় কি না? মেয়েদের শোক যতই তীব্র হোক না কেন, তার প্রকাশভঙ্গি এতই সুক্ষ্ম যে তাদের সাথে শোকার্ত হবে কি না ভেবে প্রকৃতিরও দ্বিধায় পড়ে যাওয়ার কথা।

এই আনকোরা দার্শনিক ভাবনাটি খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য শামসুরের মনে উদয় হয়েছিলো সুপ্রিয়া গ্যালারির সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বাদাম খেতে খেতে। ঠিক ঐ মুহুর্তে সে মিতিনার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। একটা সময় মেয়েটি যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, সে এই ভাবনার শেষ টেনেছিলো দুটি সম্ভাবনা সামনে রেখে। প্রথমত, হয় তীব্র শোকের প্রকাশ নর নারীতে নিশ্চিতভাবে ভিন্ন। অথবা মিতিনার লাভ লাইফ ও তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মাসুদের দেওয়া তথ্যে ব্যাপক গড়মিল আছে। শান্ত সুন্দর মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে দ্বিতীয় সম্ভাবনাই অধিক গ্রহণীয়। এর মধ্যে মিতিনা যখন তাকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করে, 'আপনার নাম মিয়া শামসুর সিদ্দিক?'
হতবিহ্বল সে কেবল উপর নীচে মাথা নেড়ে নামের দায় স্বীকার করে নিয়েছিলো। মিতিনার পরের প্রশ্ন,'আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি কেন এসেছি?'
'হ্যাঁ', শামসুরের তখন জবান ফোটে।
'আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। আপনার কাজের জন্য যেখানে যেতে সুবিধা হয়, সেখানে যেতে আমি রাজি আছি।'
চলন্ত গাড়িতে মিয়া শামসুর সিদ্দিক মনে মনে কথার ক্রম গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
''তুমি তো এখানে প্রথম আসলা?"
"হ্যাঁ।"
"ঢাকার বাইরে হলেও আমাদের রাস্তাঘাট কিন্তু বেশ সুন্দর। প্লাস লোকজন কম। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অনেক কম এখানে। মফস্বল শহর হলেও প্রকৃতি অনেক সুন্দর। তুমি কিছুদিন থাকলে আমি ঘুরায়ে দেখাতে পারবো। থাকবা কয়দিন?"
"কাজটা হয়ে গেলে, আজই চলে যাবো।" এতক্ষণ মিতিনা চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কথা বলছিলো। এবার ওর দিকে তাকিয়ে বললো। তখন দুপুর শেষে বিকেল শুরু। কড়া রোদের তেজ অনেকটাই মিইয়ে গেছে। এই সময়ে এত সুন্দর, শান্ত মুখের দিকে শামসুরের মাথায় তৈরি হয় কথার জট। এক বুক আশা নিয়ে এইটুকু বলতে পেরেছিলো, "তোমার সাথে আগে কিছু কথা বলে নেওয়া জরুরি। আমার জন্য সুবিধা হবে তাতে।"
"বেশ।" মিতিনার উত্তর।
"আমাদের এখানে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা গুলোর একটা হলো রেললাইন। এই কাছেই। চলো হেঁটে আসি। কথাও বলা যাবে সেখানে। তবে তার আগে আমাকে আপনি থেকে তুমিতে নামাতে পারো। আমরা তো একই ব্যাচে ছিলাম।'

সব ক্যাম্পাসেই কিছু জুটি থাকে। যাদের প্রেম যতটা না তাদের, তার চেয়ে বেশি ক্যাম্পাসের। মিতিনা সাইফ জুটি সেরকম ক্লাসিক জুটির একটি উদাহরণ। বাকী সবার মতোই শামসুরও তাদের দেখতো। হিংসায় পড়ে মাঝেমধ্যে সাইফকে দুই একটা গালি দিতো, মনে মনে। মিতিনার কথা ভেবে বুকের ভেতরটা কেমন কেমন করতো। এতটুকুই। দিনশেষে সবাই যখন ভেসে গেছে। সেও এইখানে এসে থিতু হয়েছে। ঢাকায় থাকতে থাকতেই শুনে এসেছিলো এই জুটির বিয়ের খবর। এতে তার নিজস্ব জীবনে বিশেষ কোন অদল বদল ঘটেনি। মাসখানেক আগে মিয়া শামসুর সিদ্দিক জানতে পারে মিতিনার স্বামী সাইফ, রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। এবং খুবই আশ্চর্য কারণে মিতিনা পরিচিত বন্ধু মহলে তার খোঁজ করছে। সেই খোঁজাখুঁজির ফলেই বাংলাদেশের এক অখ্যাত মফস্বল শহরে বেঁচে থাকা মিয়া শামসুরের জীবনে আজকের এই স্মরণীয় দিনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।

"তুমি কি বলবে বলছিলে?" মিতিনা জানতে চায়।
শামসুর কয়েক মুহুর্ত সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে, "সাইফ কতদিন হলো মারা গেছে?"
"একবছর।"
"কি হইছিলো?"
"বাইক এক্সিডেন্ট।" মিতিনার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

বিংশ শতাব্দির শোকের বয়স একবছর হয়ে থাকলে, একবিংশ শতাব্দির শোক আরও আগেই শেষ হওয়ার কথা। তারপরেও এক দুই শব্দের উত্তরে শামসুর কথোপকথন ঠিক জমাতে না পেরে আরো উপযুক্ত প্রশ্ন খুঁজতে থাকে। এর মধ্যে আচমকাই মিতিনা জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা, মৃতদের আত্মা ডেকে আনা কি এতোই সহজ?"
"সহজ কে বললো! খুবই কঠিন। তবে ব্যাপারটা হলো ডেকে আনার চেয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করা আরো কঠিন।"
"কেন?"
"প্রকৃতিই চায় না।"
"কিন্তু প্রকৃতি না চাইলেও কেউ কেউ মৃতদের সাথে কন্টাক্ট করতে পারে?" মিতিনার গলায় আগের মতো নিষ্প্রভ ভাব নেই। তার বদলে বেশ উত্তেজনার আভাস।
"ব্যতিক্রমও প্রকৃতিরই সৃষ্টি।"
"তোমার সেই ক্ষমতা আছে।"
"হ্যাঁ।" শামসুর আস্তে করে উত্তর দেয়।
"জানো, আমি আত্মা,জীবন,মৃত্যু এসব নিয়ে কখনো ভাবি নাই।"
"তাহলে এখন ভাবছো কেন?" এই প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য উত্তর শামসুর মনে মনে ভেবে রেখেছিলো। মিতিনা সেই দিকে গেলো না। সে নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছে।
"গত একবছর ধরে আমার বারবার মনে হয়েছে। একজন মানুষ তার সারা জীবন কত কিছু করে। কত কিছু ভাবে। মানুষটা মরে গেলো আর সব হারিয়ে গেলো। এর কোন মানে হয়!"
"মানুষের কাজ তো থেকেই যায়। অন্যের ভিতরে তার তৈরি অনুভূতি, তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া স্মৃতি এগুলো জীবিতদের ভিতরে বেঁচে থাকে।"
"হ্যাঁ। সেটাই। মানুষটা চলে যায়। কিন্তু তার কাজের প্রভাব থেকেই যায়। সেই কাজের কোন প্রতিফল তাকে ভোগ করতে হয় না।" মিতিনার গলার স্বরে কিছু একটা ছিলো সেটা বুঝতে পারলেও এই কথার প্রকৃত অর্থ শামসুর ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সে বরং হাঁটা থামিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলে,"গন্ধ পাচ্ছো কোন?"
"হুম। কিসের এটা?"
"ছাতিমের।" ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, শামসুর যেদিকে, সেদিকে একটা ছোট্ট পুকুর। অন্যপারে কয়েকটি ছাতিম গাছে অসময়ের ফুল ফুটেছে।
"যাবে?"
মিতিনা ইতস্তত করে বললো, "ওটা তো কারোর বাড়ি মনে হয়।"
"স্থানীয় লোকে জমিদার বাড়ি বলে। আসলে কোম্পানি আমলের কোন সরকারি বাসভবন ছিলো। এখন আর কেউ থাকে না।"

পুকুরের পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটার সরু রাস্তা চলে গেছে। সেদিক দিয়ে হেঁটে গেলে এই প্রাচীন বাড়ির ত্রিসীমানায় যাওয়া যায়। মূল বাড়িটা ইউ শেপের। একদিকে দোতলা ঘর দাঁড়িয়ে আছে। নীচতলায় পাঁচটা ঘর কোনমতে টিকে থাকলেও দোতলা একেবারেই ধ্বংসপ্রাপ্ত। অন্য দুইদিকে দুটো করে ঘর। সবচেয়ে ভালো দিক হলো চমৎকার একটা শান বাঁধানো পুকুরঘাট এখনো অক্ষত। কোন এক কালে কেউ হয়তো সংস্কার করিয়ে ছিলো। মিতিনা সেই ঘাটে গিয়ে বসে। পুকুরের সুস্থিত প্রাচীন জলে চোখ রেখে মিতিনা হারিয়ে যায় পুরানো স্মৃতিতে। ঠিক স্মৃতি নয়। কোন কোন স্মৃতি নিজের স্বার্থেই স্রেফ ঘটনা প্রবাহের ছিন্ন প্রতিরূপ নিয়ে হাজির হয়। মস্তিষ্ক হয়তো চায় না এই স্মৃতিগুলো ধরা পড়ুক। আবার এদের আটকাবার ক্ষমতাও তার নেই। ফলে সে জলের সাথে রঙ মিশানোর মতো, প্রকৃতির অন্য অনুষঙ্গের সাথে মিশিয়ে এদের আগ্রাসনকে প্রশমিত করার চেষ্টা করে। যেমন এই মুহুর্তে মিতিনার মনে হয়, সে এই বাড়িটিতে একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছে। এ ঘর থেকে ও ঘরে। বেরোবার সকল পথ বন্ধ। দেয়াল জুড়ে পুরানো হয়ে যাওয়া রক্তের দাগ। ঘামের কটু গন্ধ। চাপা কান্না মেশানো নিশাত হাওয়া। মিতিনা একসময়ে অস্থির হয়ে ছুটতে শুরু করে। নীচ তলা থেকে উপরে যায়। এই বাড়ি থেকে তার মুক্তি চাই। এই বাড়ি আসলে অন্য কোন গোপন স্মৃতির প্রতিরূপ। শামসুরের ডাকে সে ফিরে আসে শান্ত কালো জলের পুকুর ঘাটে। "কই হারাইছিলা?" মিতিনা মাথা নাড়ে। ছাতিমের গন্ধে ওর নেশা ধরে গেছে।

"আচ্ছা, অনুভূতির সাথে আত্মার সম্পর্ক কি? মানুষের কষ্টের উৎস কি শরীর না কি এই সোল বা আত্মা তুমি যা বলছো?"

শামসুর একগাদা মাটির চাড়া কুড়িয়ে এনেছে। সেগুলো একটা একটা করে পুকুরে ছুঁড়তে লাগলো। প্রতিটাই পানির উপরের তলে বার কয়েক লাফ দিয়ে অন্য পাড়ে পৌছানোর আগেই ডুবে যাচ্ছে। "আমি জানি না। শুধু এইটা বুঝি আত্মা ছাড়া শরীরের কোন অনুভূতি নেই। আবার শরীর বিনে আত্মা রাগ,ক্ষোভ,ভালোবাসা কিছুই অনুভব করতে পারে না।"
"তোমার শরীরে যদি অন্য কাউকে রিপ্লেস করা হয়। সে কী নতুন করে কিছু অনুভব করতে পারবে?"
শামসুর কিছুক্ষণ মিতিনার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ও কি বলতে চাইছে। "হ্যাঁ, পারবে। অন্তত আমি যে মেথডে কাজ করি সেই অনুযায়ী পারবে। আমার শরীরে অন্য কোন কেউ এলে আমাকে স্পর্শ করার অনুভূতি সেই আত্মা, যাকে আনা হয়েছে, সে অনুভব করবে।"

মিতিনা তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে,"দেরী হয়ে যাচ্ছে। চলো তাহলে?"
"ফিরে যেতে চাচ্ছো?''
"হ্যাঁ।''
"এখানেই ডেকে আনা সম্ভব।"
মিতিনা সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো,"এখানে?"
"অবশ্যই। তোমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসার এটাও একটা কারণ।"

শামসুর হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে হাত তুলে চারিদিকে দেখিয়ে বললো, "এ ধরণের পুরোনো বাড়ি আত্মাদের পুল হিসেবে কাজ করে। আমাদের জীবিতদের ভিতরে কোন যোগাযোগ থাকে না। পৃথিবীর এক প্রান্তের জীবন্ত মানুষের সাথে অন্য প্রান্তের কারোর সারা জীবনে নাও দেখা হতে পারে। আত্মাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এরকম না। পৃথিবীর সব আত্মারা একটা শক্তিশালী বন্ধন দিয়ে একে অন্যের সাথে যুক্ত থাকে। আসলে জীবিত দেহে থাকা অবস্থাতে এই কানেকশন লুজ হয়ে যায়। মৃত্যুর পর আবার দৃঢ় হয়। এইজন্য এরকম বাড়ি, যেখানে অনেক আত্মার আনাগোনা, সেখানে যে কোন আত্মাকে ডেকে আনা সহজ।"

সে মিতিনাকে ঘাটে বসিয়ে রেখে আশেপাশের ঝোঁপে উবু হয়ে কিছু খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির ভিতরে হারিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বাদামের ঠোঙ্গায় করে জিনিসটা নিয়ে এসে পুকুরের দিকে পিঠ দিয়ে ওর সামনে বসে। ঠোঙ্গার মুখ খুলে দেওয়ার পর মিতিনা দেখতে পায় ভেতরে একটি মৃত ঘাসফড়িঙ।

"খুব সিম্পলিফাই করে বললে, আমাদের এই শরীরটা হলো আত্মাকে ধারণ করার পাত্র। আত্মা ছাড়া শরীরের কোন প্রয়োজন নেই। আবার শরীর ছাড়া বস্তু জগতের সাথে আত্মার যোগাযোগের কোন সুযোগ নেই। শরীর হলো লৌকিক ও অলৌকিক জগতের মধ্যে সেতুবন্ধন। একটি নির্দিষ্ট আত্মার জন্য একটি নির্দিষ্ট ধারক তৈরি করা আছে। সেটা প্রকৃতিই ঠিক করে দিয়েছে। চাইলেও সে ঐ নির্ধারিত শরীর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারে না। তবে মৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হিসাব ভিন্ন। তাদের আত্মা মুক্ত, বন্ধনহীন। তাদেরকে যে কোন শরীরে প্রবেশ করানো যেতে পারে। তবে সব শরীর তার নিজের আত্মার বাইরে নতুন কাউকে জায়গা দিতে প্রস্তুত নয়। কেউ কেউ পারে। যারা পারে তারা হলো গিয়ে মিডিয়াম অথবা মধ্যমা। যেমন এই আমি।" মিয়া শামসুর সিদ্দিক নিজের দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়।

"কিন্তু এখানে একটা সমস্যা হচ্ছে, প্রকৃতি মানব শরীরকে একাধিক আত্মাকে ধারণ করার ক্ষমতা দেয় নাই। অনেকটা রাসায়নিক বন্ধনের মতো। তাই সাইফের আত্মাকে এখানে ডেকে আনতে হলে আগে আমার আত্মাকে সাময়িক সময়ের জন্য শরীর থেকে বের করে জমা রাখতে হবে। যারা অনেক শক্তিশালী মিডিয়াম তারা নিজেদের আত্মাকে আশেপাশেই রাখতে পারেন। কোন সাহায্য ছাড়াই। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সাহায্যের দরকার হয়।" শামসুর ঠোঙ্গার ভিতরে রাখা সদ্য মৃত ঘাসফরিঙটাকে দেখিয়ে বলে,"এটা হলো আমার জন্য সাময়িক আধার। যখন এটাকে নড়ে উঠতে দেখবে, ঠোঙ্গার মুখ বন্ধ করে দেবে।"

এই বলতে বলতে মিতিনার চোখের সামনেই মিয়া শামসুর সিদ্দিকের গলার স্বর নীচু হতে হতে মনে হয় অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। মাথা ঝুঁকে বুকের সাথে থুতনি লেগে যায়। যেন বসে থেকে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। মিতিনা চোখ বড় বড় করে একবার শামসুরকে আর একবার হাতে ধরে রাখা ঠোঙ্গায় নিথর ঘাস ফড়িঙটাকে দেখতে থাকে। একসময় তাকে অবাক করে দিয়ে ঘাসফড়িঙ জ্যান্ত হয়ে ওঠে। মিয়া শামসুর সিদ্দিকের দেহে প্রাণ ফিরে আসলে সে সোজা হয়ে বসে। মিতিনাকে চমকে দিয়ে এক ভয়ঙ্কর চিৎকার করে ওঠে। বড় বড় করে দম নিতে নিতে একটা সময় স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস ফিরে আসে। মাথা নীচু করে ধিরে ধিরে কয়েকটা দম নেয়। তারপর সরাসরি মিতিনার দিকে তাকিয়ে বলে, "কেমন আছো, মিতিনা?" অবিকল সাইফের গলার স্বর।

কল্পনার সাথে বাস্তব অভিজ্ঞতার এরকম পার্থক্য হবে মিতিনা বুঝতে পারেনি। সাইফের গলার স্বর শুনে কি যেন এলোমেলো হয়ে যায়। দুই হাত তুলে ওকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ধাক্কা খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে সামনের জন উলটে পড়ে যায় পুকুরে। অশান্ত হয়ে ওঠে জলাধার। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাপাদাপি করে মাটির ডেলার মতো টুপ করে ডুবে যায় মিয়া শামসুর। পানির স্তরে তোলা ঢেউ মিলিয়ে গিয়ে পূর্বের নিস্পন্দন অবস্থায় ফিরে আসতে আসতে ঘাসফরিঙটা যে কোথায় গিয়ে লুকায়, তাকে আর পাওয়া যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২১ রাত ১২:৫১
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×