somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

কল্পদ্রুম
জ্ঞানিরা বলেন মানুষ জন্মমাত্রই মানুষ নয়,তাকে যোগ্যতা অর্জন করে তবেই মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে হয়।যোগ্যতা আছে কি না জানি না,হয়তো নিতান্তই মূর্খ এক বাঙ্গাল বলেই নিজেকে নির্দ্বিধায় মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ফেলি।

ঝরা পাতার দিনে একজন মতিন (গল্প)

০৮ ই আগস্ট, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখনো রাত বেশি হয়নি। বৃষ্টিস্নাত শহরের রাস্তায় একটি মাইক্রোবাস ছুটছে। গতি — না বেশি না কম, রঙ সাদা, জানালা কালো। ফলে ভেতরের যাত্রীরা অনেকটা আড়ালে পড়ে গেছে, যাদের একজন মতিন, কিছুটা ঘোরাচ্ছন্ন। ঘোর তৈরিতে গতিময় বাহনের দায় আছে। মুখোসাবৃত মুখের প্রশ্নঝড় সেই অনুভূতিকে জিইয়ে রাখছে আরো। মতিন বারবার প্রশ্নের পরম্পরা বুঝতে ভুল করছে, যেখানে সঠিক উত্তরই হতে পারে মুক্তির পথ। থট ব্লক কাটাতে একজন সাহায্যের হাত এগিয়ে দেয়। প্রচন্ড থাপ্পড়ে ওর ডান দিকের নীচের পাটির পুরানো ডেন্টাল ক্যারিজটা নাড়িয়ে দিলে মুখের ভিতর রক্তের পরিচিত স্বাদ, স্নায়ুতে ব্যাথার অনুভূতি মতিনকে বরং আরো গভীর চিন্তাভ্রমে ফেলে দিলো। এরা বলছে, সে প্রায়ই বিশেষ একটি ব্যাগ বহন করে। দুপুরের ঐ ব্যাগটার কী খবর? আমজাদ হোসেনকে কতদিন ধরে চেনে? তার ব্যাপারে কী জানে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মতিন সঠিক মানুষ নয় — তারা একমত হতে পারে না। কীসের যেন অপূর্ণতা রয়েই যাচ্ছে। বাইরের ভরা বৃষ্টি আর সাদা মাইক্রোর অন্তস্থ জটিলতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। যা পক্ষান্তরে জার্নি বাই বাসকে আরো প্রলম্বিত করে।

*
থমকানো বাতাস, মেঘলা দুপুর।

মুহুর্ত কয়েক দুইদিকে লক্ষ করে মতিন রাস্তা পার হলো। তারপরে ফুটপাতে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলো। বাসায় পৌছে আবার অফিসে ফিরতে হবে। দেরী হবেই — যত কম হয় তত ভালো। ভ্যাপসা গরমে নাক মুখ ঘেমে জঘন্য অবস্থা। পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করে বেকায়দায় পড়ে গেলো। মুখোসটা খুলে রাখবে কোথায়! পকেটে রাখলে ঘামে ভিজবে। থুতনির নীচে ঝুলালে অস্বস্তি হয়। তাহলে বাজারের ব্যাগ? না কি পোর্টফোলিও?
"স্লামালাইকুম, মতিন ভাই। ভালো আছেন?"
"অলাইকুম। ভালো।"
"বাজার থেকে আসলেন?"
"জ্বি।"

বিরতিহীন হাঁটায় কথার সমাপ্তি এখানেই। অন্য বক্তাটিও নিজের জায়গাতে স্থির থাকলো। যেতে যেতে স্মৃতির ভাগাড়ে দ্রুত লোকটাকে খুঁজে দেখে মতিন। নো রেজাল্ট ফাউন্ড। হয়তো সে কিছু বলতে চায়। কথায় কথায় বেরিয়ে আসবে দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়ের আত্মীয়। অফিস কলিগ কিংবা বন্ধুর বন্ধু। বিস্মৃত পাওনাদার অথবা ভাবি দেনাদার হওয়ার ব্যাপারটাও বাদ দেওয়া যায় না। যেটাই হোক, ওসব তার না শুনলেও চলবে। সে খুব ব্যস্ত। হাতঘড়িতে সময় দেখে হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলো। সেই গতির সাথে সাথে একজোড়া সন্ধানী চোখ অনেকদূর অনুসরণ করে চলে, তার অজান্তে। কিছু সময় পর একটি সাদা মাইক্রোবাস সেগুলো তুলে নিয়ে দ্রুত ছুটতে শুরু করে।

মতিনের পাশে বছর দশেকের নয়া দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কয়েক পাতা ছবি। সাধারণত যা হয়, জুতা বাঁধা শেষ করে সে কাগজগুলো হাতে নেয়। তারপর চোখ বড় বড় করে বলে, "খুব সুন্দর ছবি।" বাবা মেয়ের প্রতিদিনের এই ছোট্ট রুটিনের আজ ব্যত্যয় হলো। ওর হাতে নিতুর দেওয়া আরেকটি কাগজ। দ্রুত পড়ে নিয়ে বুঝলো এটা বাড়িওয়ালার লিখিত নোটিশ। হিসাব মতে এই জিনিসের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। থাকলেও গ্রহীতা হিসেবে নিজের উপযুক্ততা নিয়েও মতিন সন্দিহান। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের সাথে একবার কথা বলা জরুরি। একমাত্র এই সময়ে তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পাঁচতলার শিখরে তার অবস্থান। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা মতিনের ঘন নিশ্বাস মুখোসে বেঁধে চশমার কাচকে অস্বচ্ছ করে দেয়। ঝাপসা দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গৃহদ্বার আগলে দাঁড়ানো একটি তরুণী মেয়ে। বাড়িওয়ালার কন্যা, স্ত্রী, পরিচারিকা অথবা অন্যকিছু। প্রতিবারের মতো আজও সম্বোধনহীন আলাপের শুরু,
"চাচা আছেন?"
"জ্বি না।"
"কখন ফিরবেন?"
"বলে যান নাই। কী জন্য দরকার?"
"নোটিশের ব্যাপারে কথা ছিলো।"
"লাভ নাই। উনি বলছেন নোটিশের কথা ফাইনাল।"
"কিন্তু চুক্তিতে তো লেখা ছিলো ছয় মাস পর্যন্ত ভাড়া একই থাকবে। তাছাড়া এখন তো...।"
"আমি বলতে পারবো না। উনি যা বলতে বলছেন তাই বললাম৷"

হিসাবের ভুল যেহেতু পরপর হয়। সময়ের হিসাবেও গোলমাল লেগে যেতে পারে। হয়তো বাস পাওয়া যাবে না। পেলেও দেরী হবে। লাঞ্চের পরপরই উর্ধ্বতনের ডাক পড়বে। হিসাবের ব্যাপারটায় তাই সতর্ক হওয়া জরুরি। ভাড়ার বাড়তি টাকা পুঙ্খানুপুঙ্খ যোগ বিয়োগে বের করতে হবে। অনাঙ্ক্ষিত কিছু আক্ষেপও বের হবে সাথে। কি আর করার! মতিন একবারে একাধিক সিঁড়ি লাফিয়ে নামতে থাকে। বাড়িটার মূল গেইটের বাইরে একটি বৈশিষ্ট্যহীন কানা গলি। গলির দুই পাশে খাঁড়া উঠে যাওয়া দালান। গলির অন্যপ্রান্ত মুক্ত হয়েছে তুলনামূলক বড় রাস্তায়। উপরে ঝুলন্ত তারের জটে আটকানো ময়লার ব্যাগগুলোতে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সে মূল রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। তারপর একরকম ছুটতে শুরু করে। ছোটাছুটির কারণেই বোধহয় সাদা রঙের মাইক্রোবাসটি তার চোখে পড়লো না। পড়লে দেখতে পেতো অনেকটা দুরত্ব বজায় রেখে সেটা চলতে শুরু করেছে।

**

গুমোট আকাশ, ভ্যাপসা আবহাওয়া, বৃষ্টির পূর্বাভাস।

দুই কান ধরে ঝুলে থাকা মুখোসের ভিতরটা ঘামে ভিজে নাকমুখ জাপটে আছে। চাইলেও যে এটাকে ফেলা যাচ্ছে না, প্রতিমূহুর্তের প্রশ্বাসকে বিশুদ্ধ রাখার একটা আপ্রাণ চেষ্টা তার অন্যতম কারণ, এটা সত্য। সাথে এটাও ঠিক যে স্বাস্থ্যগত দিকটি ছাড়াও এই বস্তুর উপযোগীতা বহুমুখী। আজকে বাজারের আধফোলা ব্যাগটা একহাতে এবং অন্য হাতে পোর্টফলিও চেপে ধরে মতিন যে আকবরের দোকানটা পাশ কাঁটিয়ে বেরিয়ে এলো। আসলে আকবরের দোকান এখানে গৌণ। মূখ্য বিষয় মাসের এই সময়ে আকবরের চর্বিত হাসি, "আছেন কেমন মতিন ভাই? দেখতেছেনই তো বেঁচাকিনি নাই একদম। আপনারা পুরানা কাস্টোমাররাও যদি..." সম্ভবত এত এত মুখোসধারীর ভিড়ে সে মতিনকে চিনতে পারেনি। তাকেও কথার প্যাঁচে ঋণশোধের ব্যাপারটা দীর্ঘায়িত করতে হলো না। এটা হলো সামাজিক দিক। অন্য একটা ব্যাপারও সে ভেবে দেখেছে। বাসের ভিতর অল্প কিছু মানুষ কয়েক সিট দুরত্ব রেখে বসে আছে। সবাই হয়তো বাঁচার তাগিদে বাধ্য হয়েছে বেরোতে। এই তাগিদ পূরণে তাদের একেক জনের প্লান কি? তার মতো ছা-পোষা, মুখচোরা, গোবেচারা, গৃহচারী, নির্বিবাদী মানুষ এখানে ক'জন আছে! মুখের অর্ধেকটাই তো মুখোসে ঢাকা। ঝানু গোয়েন্দা হলে এক নিমিষে এদের সবার চোখ পড়ে বলে দিতে পারতো কার মনে কি আছে। আপাতত দুই সিট পিছনে বসে থাকা লোকটার উপর একটা ছোট পরীক্ষা চালানোর চেষ্টা করে সে। পুরোটা পড়া যায় না। দায়ী বাসের অপরিষ্কার ব্যাক মিরর। তবে এটা বোঝা যায় সেও মতিনকে লক্ষ করছিলো। কি ভাবছে লোকটা? চেহারা দেখলে না হয় সে বুঝতে পারতো পরিচিত না কি অপরিচিত। সম্ভাব্য কী কারণ। বাস থেকে নামার পরেও অনেকটা পথ ওকে অনুসরণ করে। অফিসে ঢোকার আগ মুহুর্তে সন্দেহ দূর করতে মনস্থির করলেও মতিন তাকে খুঁজে পায় না। তার সন্দেহ হয় একে অথবা অন্য কাউকে এর আগেও কোথায় যেন দেখেছে।

আর এক ডে জ্যাঁ ভু আবারো সিঁড়ির বেয়ে উঠতে গিয়ে অনুভূত হয়। মনে হয় এই একই সিঁড়ি কিছুক্ষণ আগেও সে পার হয়ে এসেছে। ধাপে ধাপে উপরে উঠে এক মালিকপক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। নিজের অবস্থানের ব্যাখ্যা দিতে। এখানেও হয়তো তাই করতে হবে। টেবিলে পৌছানোর পর মতিনের ক্লান্ত শরীর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। পিওনকে ডেকে নিশ্চিত হয়ে নেয় তার জন্য কোন জরুরি তলব অপেক্ষা করে নেই। অল্প ক'জনকেই নিয়মিত আসতে হচ্ছে। নির্দিষ্ট দুরত্ব পর পর একেক জনের বসার জায়গা। এরকম নীরব পরিবেশ মতিনের ভালোই লাগে। অফিস আওয়ার শেষের ঠিক আধা ঘন্টা আগে তার ডাক পড়লো।

দুপুরের যে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো তার সাথে এই দরজার তফাৎ হলো এইখানে দোর আটকে কোন রহস্যময় তরুণী দাঁড়িয়ে নেই। আগেরটায় ভেতরে ঢোকার অনুমতি ছিলো না। এবারেরটায় পাওয়া গেছে। কথা শুরুর আগে তার দিকে জীবাণুনাশক বোতল এগিয়ে দেওয়া হলো। ছাফসুতরো নিষ্পাপ মতিন চেয়ার টেনে বসলো। টেবিলের উপর নির্মিত কাচের দেওয়ালের ওপাশে ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে টিকে আছেন জনাব হায়দার আলি। তার মুখেও মুখোস। সাবধানতার মার নেই। মতিনের এতক্ষণের রিহার্সাল করা কথাগুলো এড়িয়ে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জনাব হায়দার আলী কথা বলে যাচ্ছেন। অতিমারী, জীবন, সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতিতে তার প্রভাব নানান বিষয় একের পর এক আসছে যাচ্ছে। মতিনের কানে ঢুকছে সামান্যই। তার মনোযোগ বরং হায়দার আলীর মাথার উপরে নিবদ্ধ। সেখানে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সময়ের স্রোত কখন বৃষ্টির ধারায় পরিণত হবে তার অপেক্ষায় থাকে সে।

***

বহুল প্রতীক্ষিত বৃষ্টি।

মতিনের কাছে শহুরে বিকেলের শেষ আলো সবসময় একটু মন মরা বলে মনে হয়। দিবাচর মানুষগুলো এ সময়ে ঘরে ফেরে। যদিও সে ফেরাতে ব্যস্ততা কম থাকে। অসময়ের বৃষ্টি চিরায়ত এই মন্থরতায় কিছুটা গতি এনেছে৷ রাস্তায় অল্প কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ মেঘকালো দেখে যারা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে ছিলো, তারাও দ্রুত পায়ে হাঁটছে। যারা দেখতে পায়নি অথবা উদাসীন ছিলো, তারা ছুটছে আশ্রয়ের খোঁজে। মতিন সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোই লাগছে তার। "মেঘের কল, বৃষ্টির জল, চোখ টলমল..." "কেমন আছেন মতিন ভাই?" আচমকা কথার তীরে কবিতার অকাল মৃত্যু ঘটে।
"ভালো আছি?"
"চিনতে পারছেন?"
"না।"
"ঐ যে দুপুরে বাজারের সামনে যে কথা বললাম।"
"ও আচ্ছা।''
"আপনার সাথে কথা ছিলো কিছু।"

ইতোমধ্যে একটা মাইক্রোবাস ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। দরজা খোলা, ভিতরে আরো দুইজন। এদের একজন বাসের ভিতরের সম্ভাব্য মুখোসধারী। মতিনের ডান হাত অন্যলোকটির মুঠোয় আবদ্ধ, যাকে সম্ভবত বজ্রমুষ্ঠি বলে। আপত্তি করে যে লাভ নেই সেটা সহজে অনুমেয়। একরকম হ্যাঁচকা টানে ওকে মাইক্রোবাসে তুলে ফেলা হলো। তারপর প্রায় ঘন্টা চারেক পর বাসা থেকে একটু দূরের রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হলো। নামানোর আগে একজন অমায়িক হাসি দিয়ে বললো, "উই আর সরি ফর হোয়াট হ্যাপেন্ড। আমরা মিসইনফর্মড ছিলাম। তবে আমাদের প্রস্তাবটা ভেবে দেখেন। চিন্তা ভাবনা করে যত শীঘ্রই পারেন ফোন দিয়েন৷ তাতে আপনিও সন্দেহের তালিকা থেকে বেঁচে যাবেন।" শাট করে দরজা বন্ধ করতে করতে গাড়িটা চলে গেল। মতিন সেদিকে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ না সেটা দৃষ্টির বাইরে চলে যায়৷ তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে।

এইটুকু বৃষ্টিতেই গলিটা প্যাঁচ প্যাঁচ করছে। আগের তুলনায় পথটাকেও দীর্ঘ মনে হচ্ছে। মতিন সারা শরীরে শিরশির করে বয়ে আসা জ্বর অনুভব করে। মাঝরাতে নিতুকে ঘুম থেকে তুলে যখন সামনের মাস থেকে চাকরি না থাকার সংবাদ দেয় তখন নিতুর চোখগুলোকেও স্বচ্ছ কাচের মতো মনে হয়। সম্ভবত জ্বরতপ্ত শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিংবা ঘোর লাগা চোখে দেখার ভুল। এরপরের কয়েকটি দিন ভুল নির্ভুল পার্থক্য করতে গিয়ে সে হোঁচট খেতে থাকে। ভাঙ্গা রাস্তায় চলন্ত গাড়ির মতো। ব্যাথায় কাতড়াতে গিয়ে দেখে তার মুখ স্কচটেপে আটকানো। নড়তে গিয়ে দেখে তার হাত পা বাঁধা। কাছেই তাকে বস্তায় ভরার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বস্তাবন্দী মতিনকে শূন্যে ছুঁড়ে দিলে নীচে পড়তে পড়তে নদীর খরস্রোতের ক্রমশ জোরালো শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। মাটির ডেলার মত ডুবে গিয়ে শ্বাস নেওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় ভেসে উঠে নিজেকে পুনরায় গাড়ির ভিতর আবিষ্কার করে। কেবল মুখে স্কচটেপের বদলে মুখোস। হাত পায়ে কোন দৃশ্যমান বন্ধন নেই। বাইরে তীব্র দিনের আলো। চট করে একবার দেখে নেয় বাসের বাকী যাত্রীদের মধ্যে সন্দেহজনক কেউ আছে কি না। নাহ! সাদা মাইক্রোবাসটিও আপাতত কোথাও নেই। হাঁটতে পথে তাকে কেউ অনুসরণ করে না। করলেও সে বুঝতে পারছে না৷ যদিও সে বুঝতে চায়৷ কলিংবেলের সুইচে আঙ্গুল রেখে সে বুঝতে চায় এখানে সে কেন এসেছে৷ তৃতীয় বারের মতো যান্ত্রিক সুরেলা আহ্বানের পর ভিতরে সাড়া পড়ে। দরজা খুলে দেন স্বয়ং ইমারত মালিক, আমজাদ হোসেন। পৌঢ়, বর্তমানে আধা নিদ্রাচ্ছন্ন একজন মানুষ।
"কী ব্যাপার?"
"জরুরি কথা বলা দরকার। অন্যসময় তো আপনাকে পাওয়া যায় না, আমারও অফিস থাকে..."
"ঠিক আছে। আসেন।"

ভদ্রলোককে অনুসরণ করে মতিন আলিসান ড্রইং রুম এসে পৌছায়। ওকে বসিয়ে রেখে তিনি ভেতরের ঘরে চলে যান। চমৎকার, সুশোভিত, কৃত্রিম সৌন্দর্য মন্ডিত এই ঘরের নরম গদিতে তলিয়ে যেতে যেতে মতিনের মনে একাধিক সম্ভাব্য দৃশ্যপট তৈরি হয়।

প্রথম দৃশ্যপট

ভদ্রলোকের শান্ত প্রশ্ন, "নিন। আজ ভালোই গরম পড়ছে কী বলেন?"
বরফের কুচি ভাসা শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বললেন।
"জ্বি।"
"তো কী মনে করে আসলেন?"
"জ্বি। আপনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন ঘর ভাড়ার ব্যাপারে।"
"ও হ্যাঁ। বুঝতেই তো পারছেন। এখন সবারই ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস চলছে। আপনাদের সমস্যাটাও বুঝতে পারছি। আমাদের দিকটাও তো দেখতে হবে।"
"কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী..."
"আহা! ওসব বাদ দিন। ওটা তো আমারও মনে আছে। এইজন্যেই আপনাদের উপর কোন জোর নাই। পাঠানোর দরকার তাই পাঠানো হয়েছে। আপনাদের বিবেচনার জন্য দেওয়া হয়েছে৷ যদি না দিতে চান, আপনারা চুক্তি অনুযায়ী আরো দুই মাস পর থেকে দিয়েন।"
"আচ্ছা, আসি। স্লামালাইকুম।"

দ্বিতীয় দৃশ্যপট

ভদ্রলোক পূর্বাপর গম্ভীর প্রশ্ন, "বলেন কী কথা?"
"আপনি ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ দিয়েছেন।"
"হ্যাঁ।"
"কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী আরো দুই মাস আগের ভাড়াই থাকার কথা।"
"এই সময় সবারই ফিন্যান্সিয়াল সমস্যা। ব্যবসাপাতির অবস্থা ভালো না। বাড়ি ভাড়া দরকার আছে আমার। ভাড়া কি এমনিতে বাড়ছে। আপনারা চাকরিজীবী মানুষ৷ আমাদের কি বিপদ বুঝবেন না।"
"কিন্তু এভাবে তো আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।"
"থাকবেন না তাইলে।"
"আসি তাহলে। স্লামালাইকুম।"


তৃতীয় দৃশ্যপট

ভদ্রলোকের চিন্তিত প্রশ্ন, "কী ব্যাপার বলুন তো?"
"জ্বি। নোটিশের ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।"
"ও আচ্ছা আচ্ছা। বুঝতে পারছি। কী সমস্যা বলেন?"
"আসলে সামনের মাস থেকে আমার পক্ষে বাড়তি ভাড়া দেওয়া সম্ভব না।"
"আমি বুঝতে পারছি। এখন কঠিন সময়। সবাই অসুবিধার ভিতরেই আছি। ব্যবসাপাতি লাটে ওঠার জোগাড়। তাই বাধ্য হয়েই... তা আপনাদের কী অবস্থা?"
"সামনের মাস থেকে আমার চাকরি নেই।"
"বলেন কী? তাহলে তো চিন্তার বিষয়।"
"জি। অবশ্য এডভান্স কিছু টাকা ওরা দিয়েছে। নতুন কিছু ব্যবস্থা করে পরিস্থিতি সামলে উঠতে কিছুদিন সময় লাগবে। এইজন্যই ভাড়ার ব্যাপারটা যদি রিকনসিডার..."
"আরে। আপনাকে বলতে হবে না এসব। এত অমানুষ তো আমরা এখনো হই নাই।"

চতুর্থ দৃশ্যপট

ভদ্রলোকের সন্দিগ্ধ প্রশ্ন, "এই সময়ে কী মনে করে?"
"নোটিশের ব্যাপারে কথা ছিলো।"
"ওটা নিয়ে আর কি বলবেন। আগের দিনই বলেই দেওয়া হয়ে গেছে যা বলার।"
"জ্বি সেটা ঠিক। নোটিশ ছাড়াও আরো একটি বিষয় ছিলো।"
"কী বিষয়?"
"আপনি হয়তো জানেন না। আপনার পিছনে পুলিশ লেগেছে।"
"মানে? কী বলতে চান আপনি?", স্পষ্ট রাগত গলার স্বর।
"গোয়েন্দা পুলিশ আপনার বাড়ির দিকে নজর রাখছে। তারা আমার সাথেও কথা বলেছে।"
"আপনার সাথে কী কথা বলেছে? আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন?"
"কিছুই জানি না। তবে এটুকু জানি আপনার দৃশ্যমান ব্যবসাপাতি যা আছে সেগুলো লোক দেখানো। এই বাড়িতে আপনার পরিবার থাকে না। একটা অল্প বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে আপনি এখানে মাঝে মাঝে সময় কাটান। এই বাড়িটা আপনার অবৈধ বিজনেসের একটা পিক আপ পয়েন্ট মাত্র৷ এই বাড়িতে প্রায়ই বিশেষ একটা ব্যাগ আসে। ঐ ব্যাগে কি আনা হয় ঐটার ব্যাপারে পুলিশ আমার কাছে জানতে চেয়েছে।"
"আপনি কী বলেছেন?"
"কি বলেছি সেটা মনে করতে হবে। বুঝতেই পারছেন আপনার সাথে আমিও বিপদে আছি।"
"আহা! আপনি কেন বিপদে থাকবেন। তাছাড়া ব্যবসা ট্যাবসা করলে অনেক শত্রু হয়। তারাই কেউ পুলিশ লাগিয়েছে। আপনি মনে করে বলুন কি বলেছেন। আপনার ব্যাপারটা আমি দেখবো।"


এইসবগুলোর ভিতরে যে কোন একটি বাস্তব হতে পারে। যার প্রেক্ষিতে মতিনের পরবর্তী দিনগুলো আবর্তিত হবে। স্লট মেশিনের আবর্তনের মতো উপস্থিত হয় অন্য একদিন, অন্য এক সকাল। পরিষ্কার আকাশ, মৃদু তেজী রোদ। দুই আকাশচুম্বী অট্টালিকার মাঝ দিয়ে এসে কিছুটা পড়েছে সরু গলিতে। আর কিছুটা নয়ার ছোট্ট মুখে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে জিনিসপত্র বের করতে দেখছে সে। দুইজন লোক এক একটা জিনিস বের করে তিন চাকার ভ্যানে তুলছে। গলির শেষ মাথায় পিক আপ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। মতিনকে আসতে দেখে নয়া ছুটে গিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরলো। মতিন মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো। এরমধ্যে আধপাকা চুল, ঢোলা ঢোলা শার্ট প্যান্ট পরা মধ্য বয়স্ক একজন বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়। এই লোকটি এর আগেও এসেছে। প্রতিবারই হাতে একটা বাজারের ব্যাগ থাকে। আজও আছে। লোকটা ব্যাগ হাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকলে মতিন কিছুক্ষণ তাকে লক্ষ করে মেয়েকে নিয়ে ঘরে চলে আসে। ভারী আসবাবগুলোর প্রায় সবগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নিতু বড় বড় কয়েকটা লাগেজ বাইরে বের করে দিলো। বারবার ডেকেও অন্যমনষ্ক মতিনের সাড়া না পেয়ে যখন নিজেই টেনে হেঁচড়ে সেগুলো বের করছে ততক্ষণে মতিনের হাতে সেলফোন। সারা ঘরে ছোটখাট অনেক কিছু ছড়িয়ে আছে। ছবি আঁকার ছোট্ট ইজেলটা তুলতেই নয়া বায়না ধরলো এটা সে নিয়ে যাবে। বাপ মেয়ে দুইজনে মিলে সেটাকে নিয়ে যখন গলির পথে নেমেছে, চার পাঁচ জন লোক দ্রুত ওদের পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেলো। "বাবা দেখো।" নয়া হাত বাড়িয়ে কিছু একটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মতিনের। এক টুকরো কাগজ বাতাসে ভাসতে ভাসতে মতিন এবং নয়ার মাঝে এসে পড়ে। উপরে তারজালে ঝুলন্ত পলিব্যাগগুলোর সাথে বেমানান নতুন তিনটি ব্যাগ ঝুলে আছে। সেগুলো থেকে বেগুনী, সবুজ সংখ্যাখচিত অসংখ্য কাগজ পিতা কন্যার উপর শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়ছে। অভিনব এই দৃশ্যের ফলে শিশু মনে সৃষ্ট বিস্ময়কর অনুভূতি নয়ার চোখে মুখে নির্লোভ মুগ্ধতা হয়ে ফুটে ওঠে। সেই মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায় মতিনকেও।

আগমনী পদশব্দে সবকিছু মিলিয়ে গিয়ে মতিনের সামনে মূর্তমান হয়ে ওঠে আমজাদ আলীর নিরাসক্ত মুখ, "তো মতিন সাহেব, কি বলতে চান?"

মতিন বড় করে দম নিয়ে কথা শুরু করে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ৯:৩৫
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×