গত তিন মাস ধরেই ছেলেটি আমার ফেসবুকে আছে, যদিও সেটি আমার ফেক আইডি ।
বিবাহ বিডি ডট কম নামের ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে একটা আইডি আছে আমার। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে একটি ছবিতে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো ।
খুব সুন্দর স্নিগ্ধ টলটলে পানির এক নদীতে মাঝির মত বৈঠা ধরে নৌকা বাইছে সে । মুখে তার ভুবন ভোলানো হাসি । পরনে নীল রঙের বড় হাতের শার্ট আর হাতে ঘড়ি ।
নদী ও নৌকা আমার অসম্ভব রকমের ভালো লাগে আর সেই হাসি ও হাতের ঘড়ি সব মিলিয়ে আমাকে বেঁধে ফেলার যে পারফেক্ট আয়োজন ।
সাধারণত আমি নিজে থেকে কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইনা সেটি আমার নিজের আইডি হোক আর ফেক কিন্তু এবার যেন নিয়ম ভাঙতেই হল নিয়ম না ভাঙলে কি আর ভালোবাসা যায়
একটু দুষ্টুমি করার জন্য "আশা লতা" নামের একটি ফেক আইডি খুলেছিলাম । সেই আইডি থেকে তার নাম খুজে সাথে সাথেই পেয়ে গেলাম সেই একই নাম ও একই ছবি প্রোফাইলে। এক সেকেন্ডও আর দেরী না করে দিলাম সেন্ড করে রিকোয়েস্ট এবং সে অ্যাডও করে নিলো
তারপর একদিন কিংবা দুইদিন কিংবা আরও কিছুদিন অপেক্ষা না করে ওইদিনই আবারও নিয়ম ভেঙ্গে দিলাম একটা হাই। সে ওপাশ থেকে লিখলো হ্যালো । আমারতো দিল মে লাড্ডু ফুটছে তখন কিন্তু হ্যালো লিখেই সে উধাও আধা ঘণ্টা হয়ে গেলো আর খবর নেই । আমার তখন ইগোতে লাগলো খুব মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, ভাবলাম আমার সাথে চ্যাট করার ইন্টারেস্ট নেই তার । নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছিলাম কেন নিজে থেকে নক করতে গেলাম । অনেকক্ষণ পর সে লিখলো, সরি আম্মার সাথে একটু কাজ ছিল ।
আমার তখনও মেজাজ ঠিক হয়নি কি যেন একটি লিখলাম তারও লাগলো ইগোতে । তারপর সেখানেই সেদিনের মত কিসসা খতম । আমার মেজাজ খারাপ তারও মেজাজ খারাপ । তারপর চলে গেলো দীর্ঘ তিন মাস । এর মধ্যে না আর কোন হাই হ্যালো আর না কোন কমেন্ট ।
তারপর একদিন রাতে হঠাৎই ওপাশ থেকে ম্যাসেজ এলো । "আমার প্রোফাইলে ফোন নাম্বার আছে । চাইলে কল করতে পারো" ।
হঠাৎ এমন একটি ম্যাসেজে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম শুধু লিখলাম ওকে।
পরেরদিন অফিসে বসে আছি লাঞ্চ এর পর । কোন কিছু না ভেবে দিলাম একটা ফোন । ওপাশ থেকে হ্যালো বললো, ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজছে শুনতে পেলাম । আমারতো আরও ভালো লেগে গেলো
কথা শুরু করে সে সরাসরি আমাকে তুমি করে বলা শুরু করলো আর আমাকেও বললো তাঁকেও যেন আমি তুমি করে বলি । আমি বললাম আমি শুধুমাত্র আমার ফিউচার হাসবেন্ড কে তুমি করে বলবো আর কাউকে না আর সে বললো সে নাকি আবার কাউকে আপনি করে বলেনা । এমনিতেই প্রথম কনভারসেশন এর পর তিনমাস তাই আজ আর তর্কাতর্কি না বাড়িয়ে দেখা করার কথা বলেই ফেললাম । আমি জিগ্যেস করলাম কবে দেখা করবো, সে বললো তুমি চাইলে আজকেই দেখা করতে পারি । আমিও বললাম ঠিক আছে তাহলে আজ অফিসের পর সন্ধ্যা ৬ টায় আমি স্টার কাবাবের সামনে থাকবো , ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের সামনে যেটা ।
আমি অফিস শেষ করে ঠিক ৬ টায় হাজির । তাঁকে কল দিলাম, কই আপনি ।
এইতো আমি রাস্তায়, আসছি ।
স্টার কাবাবের সামনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছি তার জন্য । ৬ঃ১৫ এর মত বাজে তখন সে কল দিলো এবং আমাকে বললো রাস্তায় জ্যাম আছে তার আসতে দেরী হবে আমি যেন একটু এগিয়ে ২৭ নম্বর জেনেটিক প্লাজায় চলে যাই ।
কি আর করার, দাড়িয়ে দাড়িয়ে অপেক্ষা করার চেয়ে না হয় ওখানেই যাই । কিছুটা বিরক্ত হয়ে রওনা দিলাম জেনেটিক প্লাজা ।
জেনেটিক প্লাজার সিঁড়িতে দাড়িয়ে আমি অপেক্ষা করছি আর রাস্তার এদিক ওদিক তাকাচ্ছি কোনদিক দিয়ে সে আসবে । আমি তার ছবি দেখেছি কিন্তু সে তখনো আমাকে দেখেনি কারন আমার ফেক ফেসবুক আইডি ছিল ।
সময় তখন ৬ঃ৪০ । এর মধ্যে আমি তাঁকে দুইবার কল দেই এবং দুইবারই সে এইতো চলে এসেছি বলে বলে আর আসেইনা
আমার বিরক্তির মাত্রা তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আর মেজাজও খারাপ।
৬ঃ৫০ এ আমি আর কোন ফোন না দিয়ে জেনেটিক থেকে বের হয়ে সোজা হাটা ধরলাম সাত মসজিদ রোডের দিকে । হাটতে হাটতে যখন মিনা বাজার পর্যন্ত চলে এসেছি আমি তখন এলো কাঙ্ক্ষিত সেই কল।
তুমি কই আমিতো চলে এসেছি ।
আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি চলে এসেছি। আপনি থাকুন আমি আসছি ।
তারপর আবার হাটা দিলাম সেই জেনেটিক প্লাজার উদ্দেশ্যে । যেতে যেতে আমার পুরনো এক কলিগ ফোন দিলে তার সাথে কথা বলতে বলতে আমি তখন জেনেটিক এর সামনে । একটু দূর থেকে দেখতে পেলাম লম্বা করে খয়েরী রঙ এর বড় হাতার শার্ট পরা মাথায় পাগড়ীর মত করে স্কার্ফ পেঁচানো এক যুবক দাড়িয়ে আছে । সেও দেখলাম আমার দিকেই তাকিয়ে আছে তার মানে আমাকে না দেখলেও চিনতে অসুবিধা হয়নি তার ।
কাছে গিয়ে আমি তাঁর চোখের দিকে তাকালাম । জ্বরের কারনে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে আর কি যেন এক মায়া তাতে । লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলে যে কথাটি আছে আমি কখনো তাতে বিশ্বাস করতাম না কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যে সেটিই হলো । তবে পার্থক্য হচ্ছে সাধারণত এ ক্ষেত্রে কাউকে প্রথম দেখায় ভালো লাগে তার চেহারা দেখে, প্রেমে পরে যায় আর ভালোবাসে পরে। কিন্তু আমি যে প্রথম দেখায়ই তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছি তাঁর মায়ায় পরেছি আর প্রেমে পরেছি অনেক পরে । তবে তাঁর মানে কিন্তু এই নয় যে প্রথম দেখায় তাঁকে আমার ভালো লাগেনি, আসলে ভালোবাসাতে বেশী মগ্ন ছিলাম তাই ভালোলাগা নিয়ে ভাবার সময়ই হয়নি ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই লাইনটির কথা আমার মনে পরে যায় "প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ"
সামনে গিয়ে আমি ফোন রেখে দিয়ে কথা বলা শুরু করলাম । সে বললো তার জ্বর এসেছে, ঘেমে গিয়েছে অনেক গরম লাগছে ভেতরে গিয়ে বসি কোথাও । আমি কোন রেস্টুরেন্টে বসতে চাইলাম না তাই একটু ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য জেনেটিক প্রথম তলা আর দ্বিতীয় তলা রাউন্ড দিলাম । সে আমাকে বললো তুমি চাইলে আমাকে তুমি করে বলতে পারো । আমি শুধু একটু মুচকি হাসলাম কিছু বললাম না ।
তারপর জেনেটিক প্লাজার পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে একটা দোকান থেকে মিরিন্ডা কিনে দিলো সে সাথে আমার বাসার জন্য কিছু কিনে দিতে চাইলো। আমি না করলাম । সে আমার মিরিন্ডা আমার হাতে দিয়ে তারটার বোতলের মুখের পলিথিনের কভারটা খুলে দিতে বললো তার নাকি আঙ্গুলে ব্যাথা । আমার কাছে বিষয়টি ভালো লাগলো প্রথম দেখাতেই সে কোন রকম ইতস্তত বোধ না করে আমাকে বোতলের মুখ খুলে দিতে বললো ।
তারপর আমরা মিরিন্ডা খেতে খেতে আর গল্প করতে করতে জেনেটিক এর পেছন দিয়ে হাটতে হাটতে লালমাটিয়া আড়ং এ ঢুকলাম । সেখানে একটি মাটির মূর্তি দেখিয়ে বললো সেটি তার খুব পছন্দ হয়েছে আর এই মূর্তি সম্পর্কে দু একটা কথা । এক ফাঁকে জিগ্যেস করলো আমি খিচুড়ি রান্না করতে পারি কিনা তার নাকি খিচুড়ি খুব পছন্দ ।
এভাবে আরও দু একটি কথায় কথায় আমরা আড়ং থেকে বের হয়ে আবার একই পথে জেনেটিকে ফিরে আসলাম । তারপর সে আমাকে বাসা পর্যন্ত রিকশা করে দিলো ও রিকশায় উঠার আগে হ্যান্ড শেকও করলো । আমি চলে গেলাম বাসায় ।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সময়টা বেশিদিন আগের নয় । মাত্র সাতটি বছর । তবে আমার কাছে মনে হয় এইতো সেদিন । জন্মদিনের মাসেই যেন নতুন করে জন্ম হলো আমার । ভালোবাসা, প্রেম, পাগলামি এগুলো নিয়ে ব্যাঙ্গ করা আমি নিজেই ডুব দিলাম তাঁর ভালোবাসায় । তাঁরপর থেকে সেই ভালোবাসার সমুদ্রে মনের সুখে সাতার কেটে যাচ্ছি তো যাচ্ছি ।
কখনো আমাদের প্রথম দেখার এই বিশেষ দিনটি নিয়ে কিছু করা হয়নি । তাঁর মনেও নেই তারিখটির কথা। ছেলেদের সাধারণত এসব মনেও থাকেনা তবে আমি প্রায়ই আমাদের পরিচয় ও দেখা হবার সেই দিনটির কথা ভাবি । হয়তো সেও ভাবে কিন্তু আমি জানিনা
তবে আজ ব্লগে সেই ঘটনা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না
মজার বিষয় হচ্ছে, প্রথম দেখার সেই দিনটির মত এখনও হয় এদিক থেকে ওদিক আর অপেক্ষা। তবে এখন কিন্তু আর আমি বিরক্ত হয়ে উল্টো পথে হাটা ধরিনা। ভালোবাসি যে তাই......
আজকের এই বিশেষ দিনে তাঁকে বলতে চাই "তুমি চাঁদ হয়ে এসে জ্যোৎস্না ঢেলে দিলে অন্ধকারে আমার"
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০২০ সকাল ১০:৩৩