টং টং টং টং টং টং ঘণ্টা বেজেই চলেছে
শিশির এর চোখ তন্দ্রাচ্ছন্ন । মাত্র বিছানায় গা টা এলিয়ে দিয়েছে । মা এসেছিলো দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে কিন্ত সে বললো রাতে ঘুমুতে পারেনি একটূ ঘুমিয়ে নিক তারপর খাবে ।
রাতে এক ফোটাও ঘুম হচ্ছেনা । ল্যাপটপ নিয়ে শুয়ে বসে এটা ওটা করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে যায় তারপরও ঘুম আসেনা । ভোরের দিকে ঘুমুতে গেলেও এক ঘণ্টা পর পর ঘুম ভাঙ্গে তারপর দুপুরের দিকে উঠে বিছানা ছাড়ে । আবার সেই মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ গুঁতোগুঁতি । এভাবেই চলছে গত দুই মাস।
একটু ঘুম ঘুম লাগায় শিশির সুযোগ টা হারাতে চাইলোনা । ঘণ্টার আওয়াজ অবজ্ঞা করে চেষ্টা করছে আরও ঘুমে তলিয়ে যেতে । কিন্তু ঘণ্টা যে বেজেই চলেছে বেজেই চলেছে । সেইযে স্কুল এ থাকতে ঘণ্টার আওয়াজ শুনেছে তারপর তো আর শুনতে পায়নি সেই শব্দ । ওদের এলাকায়ও তো কোন স্কুল নেই তাহলে কিসের ঘণ্টা বাজছে । শিশির খুবই বিরক্ত হচ্ছে । ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে যে ঘণ্টা বাজাচ্ছে তাঁকে ইচ্ছে মত গালিগালাজ করে আসে । কিন্তু সে কোনভাবেই ঘুমটা নষ্ট করতে চাচ্ছে না । ওপাশ ঘুরে সে কানের উপর বালিশ দিয়ে দিলো । তারপরও কানে আসছে টং টং টং টং টং । মনে হচ্ছে মাথার ভেতর কেউ হাতুড়ী পেটাচ্ছে ।
আবার ওপাশ ঘুরে ফুল সাউন্ডে গান ছেড়ে দিয়ে দুই কানে এয়ার ফোন গুজে দিলো । এখনও সেই শব্দ টং টং টং টং টং
এবার সে আর থাকতেই পারলোনা । তাঁকে এই অসহ্য ঘণ্টার আওয়াজ বন্ধ করতেই হবে। ঘরের বাইরে এসে দেখলো বাসায় কেউ নেই সদর দরজাও খোলা । কি ব্যাপার সবাই কই গেলো । এই লকডাউনের সময়ে কারও তো বাইরে যাওয়ার কথা না । সে দরজা খুলে বাইরে বের হল । সিঁড়ি দিয়ে নামছে । কিন্তু ঘণ্টা বেজেই যাচ্ছে এখনও ।
নিচের গেট দিয়ে বাইরে বের হতেই পশ্চিমে হেলে যাওয়া সূর্যের আলো এসে চোখে লাগলো শিশিরের । আর ওমনি যেন চোখ জ্বালা করে উঠলো ।
পাঁচতলা বাসার তিন তালায় থাকে ওরা । বাসাটা পেছন দিকে হওয়ায় সূর্যের আলো আসেনা আর এই দুইমাস বন্দী থাকা অবস্থায়ও বাড়ী ওয়ালার কাছে থেকে ছাঁদে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়নি ।
শিশিরের মন চাইলো কিছুক্ষণ সূর্যের আলো গায়ে লাগুক কিন্তু ঘণ্টা যে তখনও বেজেই চলেছে । সবার আগে এই ঘণ্টার আওয়াজ থামাতে হবে ।
একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলো অনেকগুলো মানুষ জড়ো হয়ে আছে সামনে । পুরুষরা অনেকে একে অপরের সাথে কোলা কুলি করছে আর মহিলারাও একে অপরের সাথে খুব হেসে আনন্দ নিয়ে কথা বলছে । আজকে তো ঈদ না তাহলে কেন সবাই এতো খুশী । আরও একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলো একটা ১০ কি ১১ বছরের বাচ্চা একটু উচু একটা জায়গায় দাড়িয়ে ঘণ্টা বাজাচ্ছে । শিশির কে দেখেই বাচ্চাটা ঘণ্টা বাজানো থামিয়ে দিলো । শিশির ভাবলো কাউকে জিগ্যেস করে কি হচ্ছে । কিন্তু জিগ্যেস করলোনা ।
থাক হবে কিছু একটা । ঘণ্টার বিরক্তিকর শব্দ যে থেমেছে এতেই সে খুশী ।
মনেতে শান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলো সে । এবার যদি ভাঙা ঘুমটা পুরো করা যায় ।
বাড়ি ফিরেই দেখলো বাবা মা আর বড় আপা খুব হাসি হাসি চেহারা নিয়ে খবর দেখছে । শিশির টিভির পর্দায় চোখ রাখতেই দেখলো খবরের শিরোনাম - "অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও গত ১৫ দিনে নতুন কোন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে করোনা মুক্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন ও সবাইকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে বলেছেন" ।
ওমনি শিশির এক দৌড় দিলো ঘরের বাইরে । বাবা জিগ্যেস করলো কই যাচ্ছিস তুই ।
আকাশ দেখবো বাবা, নিঃশ্বাস নেবো সূর্যস্নানে আর ঘণ্টা বাজাবো ।
-------------
এবার ঘরের দরজায় টোকা পরছে একের পর এক । শিশির ঘড়ি দেখলো সন্ধ্যা ৬ টা বাজে । মা ডাকছে, কিরে ভাত খাবিনা? উঠ। ধুম করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরলি । সন্ধ্যা হয়ে গেলো যে ।
দরজা খুলে দিয়ে শিশির মা কে জিগ্যেস করলো , মা, তুমি কি কোন ঘণ্টার আওয়াজ শুনেছো ?
কই না তো । কি বলছিস আবোল তাবোল । এই লকডাউন এর সময়ে ঘণ্টার আওয়াজ কই থেকে শুনবো ? যেতে যেতে মা বললো, এখন শুধু সারাক্ষণ করোনা সংবাদ শুনি আর অপেক্ষা করি কবে শুনবো পৃথিবীর আর কোথাও কোন করোনা ভাইরাস নেই ।
শিশির মন খারাপ করে খাটে গিয়ে বসলো ।
পাশের রুম থেকে গানের আওয়াজ আসছে
"একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাবো
নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশীতে হারাবো"
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:১৪