somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘পুনরুত্থান’ ঘটে!

১৭ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিদ্যার হাড়মানুষের হাড় নিয়ে সংগঠিত পড়াশোনা শুরু হয়েছিল লিওনার্দো দা ভিঞ্চির স্কেচ থেকে। এই ধরনের কাজে ব্যবহৃত কঙ্কালের কথা প্রথম জানা যায় ১৫৪৩ সালে। চিকিৎসা শাস্ত্র যত এগোলো, চিকিৎসকদের মানব শরীর নিয়ে ধারণাকে আরও গভীর করে তোলার জন্যে কঙ্কালের প্রয়োজন বেড়ে চলল। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া নাগাদ ইউরোপে কঙ্কালের চাহিদা জোগানের থেকে অনেক গুণ বেড়ে গেল।
দুনিয়ার বড় বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে দেহ চুরির একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছিল। এমনকী কিছু কিছু সমাধিক্ষেত্র শোকগ্রস্ত পরিবার আর কঙ্কালের জন্যে দেহ দখলে মরিয়া চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্রদের মধ্যে হাতাহাতি মারামারির জন্যে বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু আমেরিকায় গল্পটা ছিল আরও কঠিন। সেখানে চিকিৎসা ব্যবসা জন সংখ্যার থেকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছিল। ১৭৬০ সালে আমেরিকায় পাঁচটি মেডিক্যাল স্কুল ছিল। একশো বছরে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় পঁয়ষট্টিতে। আমেরিকায় নানান রকম অসুখ বিসুখ লেগেই থাকত। ফলে ডাক্তারিতে রোজগারের সম্ভাবনা ছিল খুবই ভাল। ঠিকঠাক ভাবে শিখলে আর খাটতে রাজি থাকলে ডাক্তার হতে আর কোনও বাধা ছিল না। অন্যান্য অনেক জীবিকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে গরিব বড় লোকের যে প্রশ্ন উঠত, ডাক্তারিতে ভর্তির ক্ষেত্রে উঠত না। এই পেশায় যোগদানে কোনও রকমের সামাজিক বাধা ছিল না। আর্থিক সংস্থান করতে পারলেই ভাল রোজগারের জন্যে পড়া যেত।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্র সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকল, আর শেখানোর জন্য জরুরি জিনিসপত্রে টান পড়ল, বিশেষ করে শবদেহে।
ঐতিহাসিক মাইকেল স্যাপল তাঁর ‘আ ট্র্যাফিক ইন ডেড বডিজ’ বইয়ে লিখেছেন, কী ভাবে মেডিক্যাল কলেজে শব ব্যাবচ্ছেদের ঘরগুলো ডাক্তারি ছাত্র আর দেহ জোগানদারদের দহরম মহরমের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। পড়াশোনায় সাহায্যের জন্যে মৃতদেহ ছিল জরুরি, তাই সব ছাত্ররাই কঙ্কাল-কারবারিদের হাতে রাখার চেষ্টা করত।
যিশুর জীবন কাহিনি থেকে ধার করেই যেন এই দেহ জোগানদারদের বলা হত, ‘রেজারেকশনিস্ট’ বা পুনরুত্থানবিদ। ভেবে দেখুন, শল্যবিদ, অস্থিবিদ-এর মতো পুনরুত্থানবিদ! কারণ, তাঁদের হাতেই কবর থেকে দেহগুলোর ‘পুনরুত্থান’ ঘটে! এই বিশেষজ্ঞরা মেডিক্যাল কলেজে আড্ডা জমাতেন। তরুণ ডাক্তাররা তাদের সঙ্গে, যাকে বলা হয় ফাঁসুড়ে রসিকতায় মাততেন। এই সময়ের অনেক রিপোর্টে পড়া যায়, ডাক্তাররা কী ভাবে দেহগুলোর সঙ্গে পোজ দিতেন আর মেডিক্যাল কলেজের জানলা দিয়ে রাস্তার পথচারীদের দিকে কাটা হাত পা নাড়াতেন।
আমেরিকান সমাজ এই দেহ চুরির ব্যাপারটাকে মোটেও ভাল চোখে দেখত না। বেশির ভাগ দেহই চুরি হত কালো মানুষ বা আইরিশদের কবর থেকে। কারণ, এই দুই ধরনের মানুষই ছিলেন সমাজের সবচেয়ে নিচু তলার বাসিন্দা।
দেহ চুরি এতই বেড়েছিল যে, বড় লোকেদের সমাধিগুলো আস্তে আস্তে সুরক্ষিত হয়ে উঠল। সমাধিতে প্রহরী, কংক্রিটের স্তম্ভ এমনকী অ্যালার্ম লাগানোর প্রচলন হল। তবে মোটের ওপর ডাক্তারি শিক্ষার কথা মাথায় রেখে আইন এই ব্যাপারে তত কঠোর হয়নি। এই কারণেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে শুরু করেছিল। ১৭৬৫ থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে দেহ চুরি নিয়ে আমেরিকা জুড়ে একটা-দুটো নয়, কুড়ি-কুড়িটা দাঙ্গার খবর পাওয়া যায়। লোক জন কবরখানায় জমায়েত হত, ফাঁকা কবর দেখলে গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে হামলা করত। কিন্তু এই আন্দোলনের ফলে দেহ ব্যবসা বেআইনি হয়নি। সেটা অন্য একটা গল্প। এ বার সে গল্পে আসা যাক।

হাড় চাই হাড়ওয়েস্টপোর্ট শহরে উইলিয়াম হেয়ার-এর একটা ভাঙাচোরা বোর্ডিং হাউস ছিল। সেই বোর্ডিংয়ের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিল হতভাগ্য গরিব মানুষ। প্রায়শই না খেতে পাওয়া বোর্ডাররা সেখানে মরে যেত। আর হেয়ারকে তাদের দেহগুলোর সদগতির দায়িত্ব নিতে হত।
এক বার এই রকম একটা দেহের শেষকৃত্যের জন্যে হেয়ার সেটি নিয়ে যাচ্ছিলেন। এক জন মানুষ দেহটি তাঁর কাছ থেকে কিনে নিতে চান। বিনিময়ে হেয়ার ১০ পাউন্ড পান। ক্রেতা হেয়ারকে আরও বলেন যে, আরও দেহ পেলে তিনি এই রকম টাকা দিতে রাজি আছেন। এই ঘটনার পরে হেয়ারের মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপে। তিনি বার্ক বলে আর এক জনকে সঙ্গে নিয়ে এক বছর ধরে সতেরো জনকে বীভৎস ভাবে হত্যা করে দেহগুলো বিক্রি করে দেন। অনেকটা এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ইংল্যান্ডে ১৮৩২ সালের ‘অ্যানাটমি অ্যাক্ট’ চালু হয়।
মৃতদেহটি জীবিত অবস্থায় কে ছিল, এই নিয়েও কিন্তু চিরকালই মাথাব্যথা ছিল। অনেক সময় ডাক্তারদের চেম্বারে ঝোলানো দেহগুলোতে লেখা থাকত যে সেগুলো মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কালো মানুষদের দেহ। তার ফলে সাদা মানুষরা নিশ্চিত হতে পারতেন যে, তাঁদের জাতের দেহের মরণোত্তর অসম্মানের ভয় নেই। তাঁরা যে দেহ কঙ্কাল নিয়ে কাটাছেঁড়া করছেন, সেগুলো কালো মানুষের।
কিন্তু সমস্যা হল যে যথেষ্ট পরিমাণ কালো লোকেদের কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্রিটিশ ডাক্তারদের তাই চোখ পড়ল উপনিবেশগুলোর ওপরে। স্বভাবতই উপনিবেশ ভারত বাদ পড়ল না।
ভারতে ডোম জাতির লোকেদের এই হাড় জোগানের কাজে লাগানো হল। ১৮৫০ সাল নাগাদ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ বছরে ১০০টা কঙ্কাল জোগান দিচ্ছিল। প্রায় ১০০ বছর পরেও নতুন স্বাধীন ভারত এই জোগানে অগ্রণী ছিল।
১৯৮৫ সালে ‘শিকাগো ট্টিবিউন’-এ খবর বেরোয় যে ভারত তার আগের বছর ষাট হাজার খুলি ও কঙ্কাল রফতানি করেছিল। ব্যবসার ভাল সময়ে কলকাতার হাড় কারখানার মোট বাৎসরিক ব্যবসার মূল্য ছিল দশ লক্ষ ডলার।

ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়াকঙ্কাল ব্যবসায়ের স্বর্ণ যুগে কলকাতায় হাড়ের কারখানায় চাকরি করাটা বেশ সম্মানজনক ছিল। এই কারখানাগুলোতে শারীরবিদ্যা চর্চাভিত্তিক একটা বৈজ্ঞানিক পরিবেশ ছিল।
কলকাতা শহরের প্রশাসনও তখন প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্ণ সহায়তা করত। ব্যবসাটার ভাল দিকও ছিল। কেবল বেওয়ারিশ লাশের গতি হত তাই নয়, একটা বাণিজ্যিক ভাবে মরে যাওয়া শহর যেন তার কঙ্কাল বেচে করে খাচ্ছিল। কিন্তু সমস্যাটা হল যে কেবল বেওয়ারিশ লাশ আর ছোটখাটো কবর চুরি দিয়ে চাহিদা মেটানো যাচ্ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মরণোত্তর কঙ্কাল দানের ভরসায় জীবিতদের আগাম দাদন দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সেও তো খুব সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কবে মরবে সেই ভরসায় তো নিয়মিত জোগান চালিয়ে যাওয়া যায় না। তাই বড় ধরনের মড়া চুরিতে জড়াতেই হল। ১৯৮৫ সালে পনেরোশো শিশুর কঙ্কাল আবিষ্কার হওয়ায় দেশ জুড়ে আলোড়ন তৈরি হল। খবরের কাগজ দাবি করল, ওই শিশুদের চুরি করে হত্যা করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ বলে মানব শরীরের রফতানি বেআইনি বলে ঘোষিত হল। কঙ্কালের ব্যবসা প্রকাশ্য ভাবে বন্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু কোনও কোনও নদীর বুকে এখনও জালে ভরে ডোবানো থাকে লাশ। মাছেরা ঠোকর মারে। ফুটে ওঠে হাড়। এর পরে সে অ্যাসিডে ফর্সা হবে, পালিশ হবে। নানান নোটের হাত বদল হবে নানান থানায় আর এয়ারপোর্টে। এক দিন সেই মানুষ উড়ে যাবে কোনও এক উন্নত দেশে, অবশ্য মানুষ হিসেবে নয়, কঙ্কাল হয়ে। যেমন ওই মাছেরাও এক দিন দারুণ হোটেলে যাবে, অবশ্য ‘খাবার খেতে নয়, খাবার হিসেবে’।

সূত্র: দ্য রেড মার্কেট। স্কট কার্নি, উইলিয়াম মরো
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×