গত কয়েকদিন আগে রাজশাহী থেকে ফিরতেছিলাম। গাড়িতে আমাদের পরিবারে প্রায় সবাই ছিল। তখন মধ্যরাত! আমরা যখন বাসায় ফিরছি তখন গলির রাস্তাগুলোতে অদ্ভুদ এক দুশ্য নজরে আসল। আইন শৃঙ্খলায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ঐ মধ্যরাতে যাকেই পাচ্ছে তাকেই সার্চ করতেছে। আর তাদের সার্চ করার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যক্তির মানিব্যাগ। একজন ব্যক্তিকে দেখলাম কান্না জড়িতে কন্ঠে বলছে, “স্যার! আমার টাকা নিয়েন না”! আজকে আইন এর রক্ষকরাই যখন ভক্ষকের ভূমিকায় তখন আমাদের মানবাধিকার কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে, তা কি অনুধাবন করতে পারছেন??
জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষনা অনুযায়ী, মৌলিক অধিকার হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার, যা জাতি, গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। বাংলাদেশ সংবিধানের, ৩৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, ৩৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সমাবেশের স্বাধীনতা, ৩৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংগঠনের স্বাধীনতা ও ৩৯নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, এই সব অধিকারের সবগুলিই বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বর্নিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে বাংলাদেশের কোন নাগরিকই পরিপূর্ণভাবে অধিকারগুলি ভোগ করতে পারছেনা। অথচ রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব নাগরিকের এই অধিকারগুলো পরিপূর্নভাবে নিশ্চিত করা।
আমি বা আমরা মানবিক দৃষ্টিকোন এবং মানবাধিকার এর অংশ হিসেবে মনে করি, সংবিধান স্বীকৃত মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে না পারলে এবং মানুষ মত প্রকাশের স্বাধীনতা না পেলে শুধু কাগজে কলমে গণতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করলেই সেটিকে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বলা যায়না। রাষ্ট্র পরিচালনার সকলক্ষেত্রে জনগণ নিজেদেরকে নাগরিক ভাবতে ও অংশগ্রহন করতে না পারলে সেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। এজন্য সাম্য, ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে আইন কাঠামো প্রনয়ন অতীব গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে কোনদিনই মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম, প্রশাসনের হেফাজতে নির্যাতন, সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশী হত্যা ও নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর এবং তাদের উপাসনালয়ে হামলা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশেষ করে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বিচার ব্যবস্থা অবনতির কারণে দিন দিন ধর্ষণ যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এতে সমগ্র দেশের নারী সমাজের নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে পড়েছে। জানুয়ারী’২০১৫ থেকে ডিসেম্বর’২০১৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বার্ষিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণে নিম্মোক্ত চিত্র উঠে এসেছে।
জানুয়ারী’২০১৫ থেকে ডিসেম্বর’২০১৫ পর্যন্ত এক বছরে সারা দেশে ২২১৯ জন লোক হত্যার স্বীকার হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৮৫ জন মানুষ হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪৮ টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ২০৩ জন নিহত হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহিংসতার অংশ হিসেবে ক্ষমতাশীন দলের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় কোন্দলকে কেন্দ্র করে ১৩৫ টি সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছে ৮ জন মেধাবী ছাত্র, আহত হয়েছে ৩৯২ জন ছাত্র।
গত এক বছরে ৬৭৩ টি সহিংস হামলার ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫৫৩ জন, আহত হয়েছে ৫৩৩ জন এবং গুলিবিদ্ধ ৬২ জন। গণপিটুনির ৮৬ টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ১১৯ জন। বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ ৩০৮ জন পুরুষের, ১৪৩ জন মহিলার এবং ১২০ জনের অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করে।
বিগত বছরে ৩৬৫ টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৫৯ জন, আহত হয়েছে প্রায় ৪১০১ জন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১১২ জন। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন’২০১৫ ও পৌরসভা নির্বাচন’২০১৫ এ জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারায় জনমনে অস্বস্থি বিরাজ করছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে সহিংসতার ৪২ টি ঘটনায় আহত হয়েছে ৩০৫ জন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছে ২২ জন। পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে সহিংসতার ৭৫ টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ জন, আহত হয়েছে ৩৮১ জন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছে ৩১ জন। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হয়রানী ও নির্যাতনের অংশ হিসেবে ৭৭৫ টি ঘটনায় বিরোধী দল ও মতের ১৬৪১১ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ও উপাসনালয়ে ১৮ টি হামলার ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ জন, আহত হয়েছে ৩৫ জন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছে ৪জন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১৮১ জন নারী, যৌতুকের জন্য নির্যাতনে নিহত হয়েছে ১২৩ জন নারী এবং শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৫৫ জন নারী, পারিবারিক কলহে নিহত হয়েছে ১৯৭ জন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯৭ জন নারী, এসিড নিক্ষেপের ৩২ টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ৩ জন এবং আহত হয়েছে ৩৪জন, আত্মহত্যার শিকার হয়েছে ১২৩ জন, ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৬০ জন নারী ও শিশু এবং ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৭ জন নারী ও শিশুকে।
এ বছর আইন-শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক গুম হয়েছে ৩৯ জন মেধাবী ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী। এছাড়া অপহরন হয়েছে ২৩৮ জন, এর মধ্যে লাশ উদ্ধার হয়েছে ৪৫ জনের এবং জীবিত উদ্ধার হয়েছে ৮৫ জন।
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ‘বিএসএফ’ কর্তৃক ৭০ টি হামলার ঘটনায় শারীরিক নির্যাতন ও গুলি করে ৪২ জন বাংলাদেশী হত্যা করা হয়েছে, আহত হয়েছে ৩৯ জন বাংলাদেশী এবং গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে ৫৯ জন বাংলাদেশীকে। এবং মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘বিজিপি’ কর্তৃক ২ টি হামলার ঘটনায় আহত হয়েছে ৫ জন বাংলাদেশী এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ১ জন বিজিবি কর্মকর্তাকে।
এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সন্ত্রাসী ও সরকার দলীয় নেতাকর্মী কর্তৃক সাংবাদিকদের উপর ৪৭ টি হামলায় নিহত হয়েছে ৩ জন সাংবাদিক, আহত হয়েছে ৭৩ জন সাংবাদিক এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ১১ জন সাংবাদিকে। অপরদিকে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে ১৮ জন সাংবাদিক এবং হুমকির সম্মুখিন হয়েছেন ৪১ জন সাংবাদিক।
২০১৫ সালের এই চিত্র থেকে বলা যায় যে জনগণের মৌলিক, নাগরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে। সুতরাং সরকারকে দেশে সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে আরো সচেষ্ট হওয়া উচিত। তাই সচেতন এবং বিবেকবান নাগরিকদের পক্ষ থেকে দেশের সকল সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দেশি-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরো সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
আপনি আমি এবং আমরা যদি নিজের অধিকার এবং দায়িত্বের প্রতি সচেতনতা ও জবাবদিহিতা বাস্তবায়ন করেত পারি তাহলেই আমরা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশে পরিনত করতে পারব।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৩৪