গল্পঃ আলোর আধারের গল্প।
পিচের উপর চলতে থাকা ছায়াটা অতটা স্পষ্ট না, হয়ত চাদের আলো একটু কম তাই। কম তো হবেই, অন্যের কাছ থেকে ধার করে নেয়া আলো, কতটুকুই বা জমানো যায় ? সুন্দর হোক বা কালো, মানুষের ছায়া বোধহয় সবারই এক রকম হয়। কথা গুলার হিসাব মিলাতে মিলাতে পিচ ঢালা রাস্তার উপরে এক জোড়া নিজেদের ছায়ার দিকে তাকিয়ে হাটছি। সাথে আছে এক রমনী, দুজনে নিশ্চুপ।
শহরাঞ্চল, তবুও ঝিঝি পোকার শব্দ কানে ভাসে। শাড়ি পরা মেয়েটা আমার স্ত্রী, চাদের আলো ওর চেহারায় পড়লে কেমন লাগে তা জানা নেই, অমন করে দেখিনি কখনও। হাল্কা বাতাসে যখন ওর চুল ওড়ে, তখন আমার দিকে আড়চোখে তাকায় আমার দিকে, খেয়াল করে, আমি ওকে দেখি কিনা, শুনেছি রাতে চাদের আলোয়, হাল্কা বাতাসে মেয়েদের চুল উড়লে, তাদের দেখতে নাকি খুব সুন্দর লাগে, কিন্ত আমি এতটাই আনরোমান্টিক, কোনদিন সেইভাবে দেখিই নি ওকে।
আর আমি এমন এক লোক, আমার ভেতর কিচ্ছু নাই, দেখতে তো একেবারে কালিবাউস মাছের মত, চিকন শরীর, মাথায় যে কয়টা চুল আছে তাও কোকড়ানো। অরিজিনাল সরিষার তেল দিয়ে চুপচুপে করে রাখা লাগে, তার উপর এই কংকালসার দেহে একটা মিনি সাইজের ভুড়ি। সব মিলিয়ে কিম্ভুতকিমাকার লোক।
আমাকে নিয়ে আমার বউয়ের তো জ্বালার শেষ নেই। কিছু ঘটনা বলি,
এইতো সেদিন, বিয়ের কিছুদিন পরেই, সকালে নাস্তা করে অফিসের কাজে বের হবো, রোমান্টিক মুডে এসে বউ জামার বোতাম লাগিয়ে দিতে চাইলো, আমি সেই সুযোগে বউকে কপালে একটা চুমু দিবো, বউ এটা ভেবে একটা মুচকি হাসি দিলো, আমি সাত পাচ না ভেবেই বলে উঠলাম, যতই যা করো, আমার ভুরি কমাতে বলবা না, এইটা না থাকলে কেমন বেখাপ্পা লাগবে। বউ উল্টো বাকি বোতাম খুলে দিয়ে বলল, তুই আজীবন খ্যাত থাকবি, ভালোবাসা বুঝবি না।
আরেকবার বাসায় শেইভ করবো, ক্রিম পাইনা, বউ আমার জন্য গারনিয়ার ফেইসওয়াস নিয়ে এসেছিল, আমি সেইটা কাজে লাগালাম। বউ তা দেখে বলল, এরপর মাথায় শ্যাম্পুর বদলে হুইল পাউডার দিস, খ্যাত একটা।,
ওকে নিয়ে আমি বাইরে বের হই না, আমার কেমন যেন আনইজি লাগে, তো একদিন শখ করে বের হলাম, চিড়িয়াখানা যাবো, বাসে চড়লেই আমার বমি পায়, তাই বাইরে মুখ দিয়ে বসে আছি। আর বেচারি বাটন ফোন টিপতে টিপতে বিরক্ত হয়ে হঠাৎ একটা স্টপেজ এ বাস থেকে নেমে যেতে চাইলো।আমি বললাম নামছো কেন? উত্তরে বললো, আমি চিরিয়াখানার বান্দর নিয়ে সংসার করি, তাই চিড়িয়াখানা না গেলেও চলবে।
এভাবেই আমাদের দিন কাটছে, বুঝি আমি একদম মানানসই না ওর জন্য,
তবুও কেন জানি পারি না ওর মত হতে,
এই যেমন, আমি যখন মমতাজ, আসিফ, এস ডি রুবেলের গান শুনি, ও তখন কানে আংগুল দিয়ে বসে থাকে, আমার গান শুনা শেষ হলে ও অরিজিৎ সিং এর গান, হানি সিং এর গান, কান ফাটানো মিউজিক দিয়ে গান শুনে, একবার তো আমার পছন্দের গান শুনে ফোনই ভেংগে ফেলেছিল। কারণ হলো , রবীন্দ্রসংগীত। আমি আমার মনে গান শুনে প্রেম জাগাই, আর ওর কাছে মনে হয়, আমি যেন কাওয়ালী গান শুনছি।
এইভাবে টম আর জেরীর মত টুকটাক কথা নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হত। একবার একটা চড় দিয়েছিলাম ওর গালে, চারটি আংগুলের ছাপ পরে গিয়েছিল ওর গালে। খুব খারাপ লেগেছিল আমার। কান্না করতে করতে ও ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি ওর সেই গালে একটু চুমু দেই, সেটাই হয়ত আমার প্রথম চুমু ছিল, যেটা মিলনের সময় ছাড়া দিয়েছি।
আমি ওকে আলো বলে ডাকতাম। যদিও ওর নাম ছিল সানজিদা। দেখতে খুব সুন্দর, তাই আদর করে ডাকি, এতে সে আরো বেশি রাগ করত। কখনো ওকে বলা হয়নি, " আলো, ,অভিমান করলে তোমাকে সুন্দর লাগে, রাগ করলে লাগে ড্রাগনের মত "
কিছুদিন আগে, আলো আমার পাশে এসে বসে আমার হাতে হাত রাখলো, আমিও ওর হাত ধরলাম। বললো, তুমি এত কালো, একটু ক্রিম ট্রিম মেখে ফর্সা হও, নইলে,,,,,,
আমি বললাম, নইলে কি ? ,
নইলে তোমার সন্তান কালো হবে, বলেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল, আমি তো খ্যাত, আমি ইশারা না বুঝেই বললাম, সন্তান কালো হলেই কি, সমস্যা নাই। আলো হয়ত ভেবেছিল, আমি ওকে জিজ্ঞেস করবো, ও কনসেপ্ট কিনা, কিন্তু না, মুখ ভারি করে চলে গেল, আমিও বুঝলাম না,
কিছুদিন পর আমি ওকে নিয়ে বাইরে বের হলাম, বললাম, কোথাও বসি? প্রথম বারের মত আমি রমনা পার্কে ঢুকলাম। সিটে ওকে বসিয়ে আমি হাটু গেরে ওর সামনে বসলাম, ওই প্রথম, বাইরে কোথাও ওর দুই হাত ধরে ছিলাম অনেকক্ষণ, পরে বললাম, তোমার পেটে আমার কিউট আম্মুটা কেমন আছে? অনেকটা অবাক হয়ে বলল, তুমি কি করে জানো যে আমি প্রেগন্যান্ট ?? আমি বললাম হুম জানি, জানতে হয়,, মুচকি হাসি দিয়ে বললো, আম্মু না আব্বু হবে কি করে জানলা?? আমি বললাম, আম্মুই হবে, দেখে নিয়ো। এরপর মন ভোলানো একগাদা হাসি, চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। ওর মুখ ফুটে বলতে চাওয়া কথা গুলো চিঠির আকারে লিখে রেখেছিল টেবিলে, সেখান থেকে জানতে পারলাম ও তিন মাসের অন্তসত্বা।
মাথায় সরিষার তেল দেই বলে আজ সকালে রাগ করে ওদের বাসায় চলে গিয়েছিল। একটু আগেই কান ধরে নিয়ে আসলাম। রাত ১২ টা, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোর রাস্তা বাদ দিয়ে ওকে নিয়ে নির্জন রাস্তা দিয়ে হাটছি। রাগ ভাংগাইনি, শুধু হাতটা ধরে আছি, পাগলীটা আমার হাতকে শক্ত করে ধরে আছে,
মাঝ রাত, আকাশে চাদ মৃদু আলো দিচ্ছে, সেই আলোতে আমার আলোকে নিয়ে, আলো ছায়ার আবছায়ায় হেটে চলছি দু'জনে। সাথে আছে ঝিঝি পোকার শব্দ, আর আমাদের সাথে হেটে চলা আলো আধারের ছায়া।
।
©
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ৩:৫৫