somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তা রা শ ঙ্ক রে র ‘ক বি’

১৩ ই জুলাই, ২০১১ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তা রা শ ঙ্ক রে র ‘ক বি’

তা রি ক আ ল আ জি জ

সাহিত্যিকদের বলা হয় total man। একজন বিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষণ ও দার্শনিকের চিন্তা উভয় গুনই সাহিত্যিকের মাঝে বিরাজমান। একজন ঐতিহাসিকের বর্ণনার চেয়ে সাহিত্যিকের উপন্যাস জীবন ও সমাজ চিত্র আমাদের সামনে আরো ভাল ভাবে তুলে ধরে। তারাশঙ্করের ‘কবি’ তেমনিভাবেই আমাদের সাথে তার সমকালীন এক শ্রেণীর মানুষের যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়। এখানে আমি উপন্যাসটির শেষ বাক্য ‘জীবন এত ছোট কেনে’ কে মূল সুর ধরে অনুসন্ধানের প্রয়াস পেয়েছি। সত্যিই কি জীবন ছোট? জীবনে এত এত যোগাযোগ, যোগাযোগের সমষ্টিতে বেড়ে ওঠা নানান ঘটনা; এরপরও কি জীবন ছোট?
‘গ্রামের ভদ্রজনেরা সত্যিই বলিল, এ এক বিষ্ময়! রীতিমত!
অশিক্ষিত হরিজনরা বলিল- নেতাইচরণ তাক লাগিয়ে দিলে রে বাবা!’
নিতাইচরণ। ডাকবার নাম নেতাই। সমাজের পতিততম স্তর ডোম বংশের হয়েও সে চোর, ডাকাত বা ঠ্যাঙ্গারে হয়নি। হয়েছে কবিয়াল। জাত রোগে আক্রান্ত তারাশঙ্কর যুগীয় হিন্দু সমাজের কাছে সত্যিই এ এক রীতিমত বিষ্ময়।
কবি হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ আকস্মিক। মাঘী পূর্ণিমার জমজমাট মেলায়। যে মেলায় জমজমাট কবি গানের পালা হয়। সে কালে কবি গান সমাজের অশিক্ষিত সম্প্রদায়ের পরম উপাদেয় ছিল। খিস্তি-খেউড়ে ভরা পালার মাধ্যমে তারা আদি রস আস্বাদনের প্রয়াস পেতো। দু পক্ষের কবিয়ালের মধ্যে বিতর্কের ন্যায় এই পালা চলতে থাকতো। মুখে মুখে গান বেঁধে একে ওপরকে বধ করার চেষ্টা করতো। মেলায় দুই কবিয়াল নোটন ও মহাদেবের গান বরাবরের ন্যায় সে বারও বাঁধা ছিল। সমস্যাটা হয় নোটনের অনুপস্থিতি নিয়ে। টাকা না পেয়ে নোটন অন্য জায়গায় গাওনা করতে যায়। শেষতক মহাদেব আর তার প্রধান দোয়ারকে দিয়ে গুরু-শিষ্যের যুদ্ধ বাঁধানোর সিদ্ধান্ত হয়। নিতাই আগে বিভিন্ন জায়গায় কবি গানে দোয়ারদের সাথে মিশে কাঁসি বাজাতো, বেগার খেটে যেতো। গুরু-শিষ্যের যুদ্ধে সে সুযোগটা নিল। মহাদেবও তাকে দোয়ারকি করতে দিয়ে কৃতার্থ হলো। নিতাই দোয়ারকি করতে গিয়ে ভালই ফোড়ন কাটলো, নিজের মত করে গানও গাইলো।
নিতাইয়ের কবি হিসেবে উত্থান ঘটলো। সকলেই অবাক হলো। উপন্যাসের শুরু এভাবেই। মেলা-কবি গানের মধ্য দিয়ে গণ যোগাযোগের এ আসরে নিতাইও ভাল পরিচিতি লাভ করলো। এবারে কিছুটা নিতাইয়ের অতীত বর্ণনা শুরু হয়, যা আসলেই উল্লেখযোগ্য। বাবা সিঁদেল চোর ও পিতামহ ঠ্যাঙ্গারে হওয়ায় নিতাই এ ধরণের কিছু হবে এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নিতাই তা হলো না। তা না হওয়ার কারণ হলো তার বিদ্যালয় গমনের পথ ধরে কিছুটা শিক্ষা লাভ এবং জ্ঞান অšে¦ষণে অনুরাগ তৈরি। জ্ঞান লাভের দরুণ তার দৃষ্টি প্রসারিত হয়েছিল। সে নিজেকে বুঝতে শিখেছিলো। আন্তঃযোগাযোগের ভিত্তিতে মানুষ হওয়ার পথে সে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলো। সমকালীন কবিয়ালদের থেকেও সে একটু রুচিসম্পন্ন হবার প্রয়াস পেয়েছিল। তাইতো উল্লেখিত কবি গানের আসরে গালিগালাজের উত্তরে সে ছড়া কেটেছিল-
ওস্তাদ তুমি বাপের সমান তোমাকে করি মান্য।
তুমি আমাকে দিচ্ছ গাল, ধন্য হে তুমি ধন্য।
তোমার হয়েছে ভীমরতি-আমার কিন্তু আছে মতি তোমার চরণে।
ডঙ্কা মেরেই জবাব দিব-কোনই ভয় করি না মনে।
নিতাইয়ের মনুষ্য যোগাযোগের বিস্তৃতি খুব একটা বড় ছিল না। বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন নিতাই থাকতো রেল ষ্টেশনের কামরায়। ষ্টেশনের পয়েন্টসম্যান রাজার সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে এখানে থাকার সুযোগ পেয়েছিল। কুলিগিরি করতো। রাজার সাথে তার গাঢ় বন্ধুত্বই ছিল। স্ত্রী আর এক পুত্র নিয়েই ছিল তার সংসার। রাজার স্ত্রী-পুত্র ছাড়াও নিতাইয়ের পরিচয় ছিল ঠাকুরঝির সাথে। বন্ধুর ঠাকুরঝিকে সেও একইভাবে ঠাকুরঝি ডাকতো। এছাড়াও চলতে ফিরতে বিপ্রপদ, বেনে মামা ছাড়াও কিছু নাম।
চণ্ডীমায়ের মেলাতে সত্যিকারের কবিয়াল হওয়া নিতাইয়ের জীবনে পরিবর্তন এলো। অনেকের প্রশংসা আর মুগ্ধতা তাকে যেন ভাবের ঘরে ঠেলে দেয়। সে নিজেকে একজন কবি ভাবতে শুরু করলো। নিজের কাছে তার মর্যাদাও বেড়ে গেলো। সে মোট বহন করা ছেড়ে দিল। এ পর্যায়ে নিতাইয়ের প্রেম পর্বও শুরু হয়। বিবাহিত ছিপছিপে গড়নের ঠাকুরঝিই তার কাছে সৌন্দর্য রানী হয়ে উঠে। মাথায় বয়ে বেড়ানো পিতলের কলসকে দূর থেকে স্বর্ণবিন্দু দেখতে দেখতে কালো বর্ণের ঠাকুরঝিকে সে সুন্দর থেকে আরো সুন্দর দেখতে পায়। বলা চলে ঠাকুরঝি তার কাছে রবী ঠাকুরের কৃষ্ণকলি হয়ে ওঠে। ঠাকুরঝি কলসে করে দুধ বয়ে নিয়ে বিক্রি করতো। রাজা ঠাকুরঝিকে গায়ের রং নিয়ে খোঁটা দিয়ে রাগালে রাগ ভাঙ্গাতে নিতাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। গান বাঁধে-
কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে।
ঠাকুরঝির সাথে তার একান্তে কিছু যোগাযোগও হয়। দ্বি পক্ষীয়, একটু আড়ালের যোগাযোগ। মানুষের স্বভাবজাত আকাঙ্খিত এ যোগাযোগগুলো তাদের ঘনিষ্টতা বাড়িয়ে দেয়। নিতাই দ্বিতীয় কলিও রচনা করে।
কালো কেশে রাঙ্গা কুসুম হেরেছ কি নয়নে।
ঘনিষ্টতা বাড়ার সাথে সাথে নিতাইকে আরেক দুশ্চিন্তা পেয়ে বসলো। ঠাকুরঝির জাত ভিন্ন। তদুপরি সে বিবাহিত। পাপ চিন্তায় নিতাই চিন্তিত হয়ে পড়লো। নিজের মনের সাথে বুঝাপড়ায় সে ঠাকুরঝিকে এড়িয়ে চলবার সিদ্ধান্ত নিল। সে কথা ঠাকুরঝিকে জানিয়েও মনকে সে স্থির রাখতে পারলো না। কবি মনের অবস্থা প্রকাশ পাচ্ছিল তার গানের মাধ্যমে।

এক ঝুমুর দলের আগমনে কাহিনীতে যোগ হয় নতুন মাত্রা। তৎকালিন সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের চিত্ত বিনোদিত হতো ঝুমুর দলের নাচ-গানে। বেশ্যা গায়িকা এবং কয়েকজন যন্ত্রী নিয়ে ছিল ঝুমুরের দল। অশ্লীল নাচ-গানে তারা আসর মাত করতো। রাতের আড়ালে দলের মেয়েদের দিয়ে চলতো দেহ ব্যবসা। একটা মস্ত আসর জমানোর চিন্তায় ঝুমুর দলটিকে এক প্রকারে জোর করে ট্রেন থেকে নামিয়েছিল রাজা। ঝুমুর দলেরই মেয়ে বসন্ত। এই বসন্ত চরিত্রের আগমনেই উপন্যাসের কাহিনী নতুন মাত্রা পায়। নিতাইকে অবলম্বন করে পুরো কাহিনী বিস্তৃত হলেও প্রাণ পায় বসন্তে এসে। বসন্তের ডাকবার নাম বসন। ধারালো বুদ্ধি সম্পন্ন মেয়েটির স্বভাবে কোন রাখ ঢাক ছিল না। বসন্তের শুধু মুখ নয় সর্বাঙ্গ ভরা হাসি নিতাইকে মোহিত করলো। এক রাতের আসর আর পূর্ব-পরের খুনসুটিতে মেয়েটি নিতাইয়ের মনে জায়গা করে নিল। তারপরও ঝুমুর দলের প্রধান মাসী যখন তাকে প্রস্তাব করলো ঠাকুরঝির মুখ স্মরণে এলে সে জোরের সাথে ’না’ বলে দিল। অঘটনটা ঘটলো সরলমনা ঠাকুরঝি নিতাইয়ের ঘরে বসন্তকে দেখায়। পরের দিন ঝুমুর দল চলে গেলো। এক-দুই-তিন দিন চলে গেলেও ঠাকুরঝি এলো না। চতুর্থ দিন নিতাই রাজার কাছে তার সংবাদ পেলো। দুঃসংবাদ বটে।
লক্ষী মেয়ে ঠাকুরঝি বাড়ির সকলের সাথে ঝগড়া করছে। গত রাত থেকে সে মূর্ছা যেতে শুরু করেছে। নিতাইয়ের কাছে সবটাই পরিস্কার হয়ে উঠলো। উদ্বিগ্ন মনে এক সময় রাজার কাছে এতদিন গোপন রাখা মনের মানুষের কথা ফাঁস করে দিল। ততক্ষণে রাজার বউও খবর নিয়ে এসে স্বভাবমত গালি গালাজ শুরু করে। ওঝার ঝাটায় সন্ত্রস্ত ঠাকুরঝি নিতাইকে তার রোগের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছে। অন্য দিনের মত রাজা তার স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরতে পারলো না। নিতাই কূল হারালো। এই অবস্থায় পরদিন ঝুমুর দলের বেহালাদার কাকতালীয়ভাবে তার কাছে বসনের আমন্ত্রণ নিয়ে এলো। বায়না পেয়ে নিতাই মনস্থির করে ফেললো। কিছুটা বিদ্যমান পরিস্থিতি, কিছুটা সর্বাঙ্গ ভরা হাসির বসন্তের টানে সে এতদিনের আবাসকে বিদায় জানালো। বন্ধু রাজার অনুরোধও তাকে আর ফিরাতে পারলো না।
নিতাই ঝুমুর দলের একজন হয়ে গেলো। বসন্তেরও আপন হলো। এখানে এসে সে অনেক নতুন কিছু দেখতে পেলো। রাতের আড়ালে ঝুমুর দলের মেয়েদের ঘরে খদ্দের আসে। নিতাইর মন ঘৃণায় ভরে যায়। পরের দিনই আবার এইসব মেয়েদের ভক্তি ভরে পুজা করতে দেখে অবাক হয়। রাতে দেহের বেসাতি ছড়ানো মেয়েরাও ভক্তিসহ পূজা করে’ জীবনের এই রূপ তার জানা ছিল না। গানের আসর শুরু হলে নিতাইয়ের গানে কারো মন ভরলো না। তার রুচির সাথে শ্রোতাদের পরিচয় নাই। যে শ্রেণীর মানুষেরা গানের শ্রোতা তাদের কাছে খিস্তি-খেউড়ই উপাদেয়। মদ গ্রহণের সাথে সাথে নিতাইও তাই খিস্তির পথ ধরলো। দলের প্রধান মাসি বললো, যে রোগের যে ঔষধ। ঝুমুর দলের সাথে নিতাইও নিয়মিত গানে পাল্লা দিতে থাকলো। অশিক্ষিত শ্রেণীর মানুষেরা এই মেলা-পালা গানের আসরের এই গণ যোগাযোগের মাধ্যমে মুখ্যত শুধু বিনোদিতই হতে চাইতো।
এখানে উল্লেখ্য ঝুমুর দলের জীবনাচরণ। ঝুমুর ভ্রাম্যমান নাচ-গানের দল। ঝুমুর দলের মেয়েদের প্রত্যেকের একজন করে নিজের মানুষ থাকে। খদ্দেরশূন্য রাতে তারা একসাথে থাকে। খদ্দের এলে পুরুষরা ঘরের বাইরে রাত কাটায়। প্রত্যেক দলের একজন প্রধান থাকে। তাকে সবাই মেনে চলে। একটি নির্দিষ্ট নিয়মে আয়ের অর্থ ভাগ হয়। প্রত্যেকে একসাথে থাকলেও মনের দিক দিয়ে খুব একটা গাঁটছড়া বাঁধে না। তাদের নিজেদের একের সাথে অপরের বা সমষ্টিগত যোগাযোগও তাই প্রাণহীন। ব্যতিক্রম নিতাই আর বসন। তাদের দু জনের মনের মিল ছিল। তাদের যোগাযোগও তাই অর্থবহ হয়ে তাদেরকে নিজেদের আরো কাছে নিয়ে আসে। নিতাই আরো জানলো তার বসন্ত মরণ রোগ বহন করে চলছে। ঝুমুর দলের অন্য দুই মেয়ে নির্মলা-ললিতা নিতাইয়ের নাম দিল বসন্তের কোকিল। এর মাঝেও তার মনে কিছু সময় ঠাকুরজির মুখ ভেসে উঠে। নিতাই গান রচনা করে।
নিতাই কোকিল হিসেবেই পরিচিতি পেতে থাকে। আসরের রাতে বসন্ত তাকে মদ খাওয়ায়। মদ খেয়ে শান্ত নিতাই অন্য মানুষ হয়। এই অন্য মানুষ বসন্তেরও আরাধ্য। এ সময় নিতাই বসন্তকে মাথার উপরে নিয়ে নাচে। বসন্ত নির্জিব হলে তবে ছাড়ে। ঠাকুরঝির কথা-নিজের জীবনের পূর্ব কথা মনে করে আবার বর্তমান অবস্থা চিন্তায় নিতাই একদিন গান লিখলো-
এই খেদ আমার মনে মনে
ভালবেসে মিটলো না আশ- কুলাল না এ জীবনে
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?
নিতাই-বসন্তের সম্পর্কে বসন্তের অবস্থা ভাল হয়েছে। অনেকটা তাকে সুস্থ দেখায়। রোগ নিয়ন্ত্রনে রাখতে সে নিয়মিত দূর্বা ঘাস খায়। শুধু একটা সময়ই সে অশান্ত হয়। দেহের বেসাতির সময়। সন্ধ্যার অন্ধাকারে মেয়েরা সেজে বসে থাকে। নিজেরা নিজেদের মাঝে অশ্লীল ইঙ্গিতে কথা বলে। কিছু দিন কেটে যায়। এরই মাঝে বসন্ত অসুস্থ হয়ে পরে। দলের অন্য পুরুষেরা এ সময় মালামাল সরিয়ে নিজেরা সরে পরলেও নিতাই একমনে বসন্তের সেবা করে। এক মাস বাদে বসন্ত সুস্থ হলেও আবারো অসুস্থ হয়। নিতাইয়ের গাওয়া ‘জীবন এত ছোট কেনে’র আক্ষেপ নিয়ে অবশেষে দেহ ত্যাগ করে। বসন্তের মৃত্যু নিতাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সে আবৃত্তি করলো-
সে বিনে প্রাণে বাঁচিনে- ভুবনে রহি কেমনে?
আমি যাব সেই পথে, যে পথ লাগে ভাল নয়নে।
বসন্তের বন্ধনহীন নিতাইকে ঝুমুর দল বেঁধে রাখতে পারে না। বৈরাগ্যই তার ভাল লাগলো। ঝুমুর দল এক পথে গেলে সে অন্য পথ ধরলো। কোথায় যাাবে’ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঠিক করে কাশীতে গিয়ে পৌছালো। কিন্তু এ কি! এ কোন দেশে সে এলো? কারো কথা বুঝতে পারছেনা। মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভাষার ব্যাপক বিস্তৃতি। বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষা সে না জানায় বিব্রত বোধ করলো। কারো সাথে সহজ যোগাযোগ করতে পারছে না। এমন সময় সে বাঙ্গালী সাদা থান পরিহিত মা ঠাকরোনকে পেয়ে কূল পেলো। মা তাকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলো। মা’র সাথে তার স্বল্পক্ষণের অর্থবহ যোগাযোগ হলো। নিতাই নিজেকে তুলে ধরলো তার সামনে। মা বাংলার কথা জিজ্ঞেস করলো। ‘তোমাদের গ্রামে নদী আছে বাবা? বড় দিঘী আছে? আঃ কতদিন দিঘির জলে স্নান করি নাই!’
মা তাকে দেশে ফিরে যেতে বললো। বললো, সংসারে পেট চলাই বড় কথা নয়। নিতাই একটু ক্ষুন্ন হলেও মাসখানেক কাশীতে থেকেই মা’র কথার সত্যতা টের পেলো। ট্রেনে সে বাড়ির পথ ধরলো। তার মনে অনেক ভাবনা আসছিল। সে গানের দল গড়বে। এখন তার নাম হয়েছে। সে খিস্তি-খেউড় করবে না। অন্য রস থাকলেও ভালবাসার গানকেই সে বড় করে তুলবে। বসন্তকে হারিয়ে সে বুঝতে পেরেছে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ওই একই খেদ। ছোট জীবনের পরিসরে ভালবেসে কুলায় না। ‘জীবন এত ছোট কেনে?’
নিতাই বাড়ি ফিরলে বিস্মিত জনতা তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। পাওয়া-না পাওয়ার সুখ-দুঃখে নিতাই অনেক কাঁদলো। রাজার কাছে জানলো ঠাকুরঝিও গত হয়েছে। রাজাকে সে বললো, মা’কে প্রণাম করে আসি। মায়ের দরবারে মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে- ‘জীবন এত ছোট কেনে?’

আমরা মানুষ হিসেবে উত্তরণের পথ বেয়ে বয়ে যোগাযোগকে বিভিন্ন ভাবে চিহ্নিত করেছি। নিজের সাথে নিজের যোগাযোগ, দ্বি পক্ষীয়, সামষ্টিক বা গণ যোগাযোগ ইত্যাদি। তারাশঙ্করের ‘কবি’ তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার প্রয়াস। কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে এই আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগটা অনেক বেশী হয়ে থাকে। যেমনটা দেখি নিতাইয়ের বেলায়। তার জীবন জিজ্ঞাসা-জীবনের পথে উত্তরণ এই শ্রেণীর যোগাযোগের ওপর ভর করেই। এ ছাড়া একের সাথে অন্যের উদাহরণে নিতাইয়ের তিনজনের সাথে যোগাযোগের কথা উল্লেখযোগ্য। দুইটি প্রেমের। ঠাকুরঝি আর বসন্তের সাথে তার যোগাযোগ। একান্ত আলাপগুলো। যেখানে মনের টান বড় কথা। কাশীতে মায়ের সাথে যোগাযোগে সে আন্তরিক এক পরিতৃপ্তি পেয়েছিলো। মেলা-কবিগান, চিরাচরিত নিয়মে বেনে মামার চা’র দোকানে আড্ডার মধ্য দিয়ে চলে এসেছে যোগাযোগের অনেক উপমা। এত যোগাযোগের সমষ্টি বেয়ে নিতাই’র জীবন উত্তরণের এক চমৎকার বর্ণনা এ উপন্যাসে পাওয়া যায়। পাঠক হিসেবে জীবন, জীবন বোধ, সমাজ চিত্র দর্শনে আমি স্বাভাবিক নিয়মে প্রয়াস পেয়েছি নিজের সাথে মিলিয়ে নেবার। আন্দোলিত হয়েছি, মোহিত হয়েছি।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×