ম হা স মা বে শ শে ষে র গ ল্প
তারিক আল আজিজ
ডিএমপির বেঁধে দেওয়া সময় সাড়ে পাঁচটা। আমি যখন বাসা থেকে বের হলাম তখন পাঁচটা পয়তাল্লিশ।
১.
বের হবার আগে খানিকটা সময় নেটে বসে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। সাধারণত বাংলানিউজ আর বার্তা২৪ দেখি। বার্তা খুলতেই চোখ গেলো- ‘টিভি চ্যানেল থেকে মহাসমাবেশ আউট’। টিভির সামনে বসলাম। আমাদের টিভিতে চার-এ বাংলাভিশন আর বিশ-এ একুশে। মিলিয়ে নিলাম। চ্যানেল দুটি সত্যিই উধাও। চার আর বিশ চাপলে নীল ঘেষা রংটা টিভি পর্দায় স্থির থাকে। চ্যানেল ঘুরাতে গিয়ে একটা বিষয় নজরে এলো। কেরানীগঞ্জ থেকে সদরঘাটে আসার নৌকাও বন্ধ। বৈঠাগুলো কেড়ে নিয়েছে পুলিশ। একটা লোক বলছে- আওয়ামীলীগ নৌকা দিয়ে ক্ষমতায় এসে এখন নৌকা বন্ধ করছে।
২.
আমার বাসা আরামবাগে। বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা হেটে দৈনিক বাংলা থেকে ফকিরেরপুল যাওয়ার রাস্তায় উঠলাম। লোকজনের আলোজনায় বুঝলাম ২৯ মার্চ সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। ওখান থেকেই ফিরতি পথ ধরলাম। সমাবেশ শেষ করে অনেকেই ফিরছিলো। একদল উঠতি ছেলে ‘হরতাল-হরতাল’ শ্লোগান দিতে দিতে ফিরছিলো। হঠাৎ তারা থেমে গিয়ে গোল হয়ে নাচছিলো। খানিকটা থেমে ওদেরকে দেখলাম। আমার মনে হলো, একটা শ্রেণী আছে যারা হরতালকে খুব আনন্দের সাথে গ্রহণ করে।
৩.
আমি এবার যাব সায়দাবাদ। হেটে হেটে মতিঝিল পর্যন্ত এলাম। মাঝের কালভার্ট রোড ধরেই এলাম। বাফুফে ভবনের পাশ দিয়ে পরের গলি ধরলাম। বাফুফে ভবন পেরিয়ে একটু সামনের দিকে একটা মাজার আছে। মাজারের অবশ্য কখনোই কোন রদবদল হয়না। কোন সরকার, রাজনীতি এদের ওপর প্রভাব ফেলেনা। মাজারের ওপরে লাল, সবুজ রংয়ের মরিচ বাতিগুলো জ্বলছিলো। মরিচ বাতি মাজারের একপাশে চাঁদতারা তৈরি করে জ্বলছে। আমি আওয়ামী চোখ নিয়ে তাকালে ঠিকই এখানে ‘পাকিস্তান কানেকশন’ খুঁজে পেতাম।
৪.
গলিপথ থেকে মতিঝিলগামী বড় সড়কে উঠলাম। যাকে বলে রাজপথ। এখানে কয়েকটা দোকান বসতো। আমি এই পথে এলে এক ডিম বিক্রেতার কাছে ডিম খাই। আজ কোন দোকান বসেনি। লোকজন কম মনে হলো। রাস্তাঘাট ফাঁকা। একটা আট নাম্বার বাস যেতে দেখলাম। অল্পের জন্য মিস করলাম। একটু এগুতেই একজনকে দেখলাম সবজি নিয়ে বসেছে। এখনই যে দোকান খুললো তা বোঝাই যাচ্ছে। দু’একজন হাটাচলা করছিলো। কয়েকটা ছেলে গল্প করতে করতে আসছিলো। তারা উঁচু গলায় কথা বলছিলো। একটা কথা কানে এলো। ‘সরকারী দলের হরতাল’। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম।
৫.
মতিঝিল হেটে এসে দেখি যে আট নাম্বার বাস অল্পের জন্য মিস করছি ওটা দাঁড়িয়ে আছে। আবার মিস করতে চাই না। একটু দৌড়ে ওটা ধরলাম। বাসের ছেলে দু’টা প্যাসেঞ্জার ডেকেই চলছে। ছাড়ার নামগন্ধ নেই। দু’একজন তাগাদা দিলো। অমিও ওদের সাথে গলাম মেলালাম। ‘মামা টানো’। বাসের ছেলে দু’টার মেজাজ তিরিক্ষি মনে হলো। ওরা একটু কঠিন গলায় আমাকে উত্তর দিলো। ‘চিল্লায়েন না, তিনদিন পর বাস নিয়া নামছি’। আমি আর চিল্লাইনি। ভাড়া চাইতে এলেও তাড়াতাড়ি বের করে দিলাম। দেরি করলে যদি আবার মেজাজ দেখায়।
৬.
বাস ছাড়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই সায়দাবাদ পৌছে যাই। বাসে থাকা অবস্থায় ফোন দেই হাসান ভাইকে। ওনার সাথে দেখা করার কথা ছিল। দেখা হবে না। বাবা অসুস্থ। হাসান বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের পথে ছুটছেন। ফোন করলাম সাজ্জাদ ভাইকে। উনি এক টেলিভিশন ছেড়ে আরেক টেলিভিশনে যোগ দেয়ার কথা জানালেন। নতুন যোগ দেয়া টিভি অফিসে যাচ্ছেন বলেই জানালেন। এই এক চাকরি। যে চাকরির কোন ‘শীত-গ্রীষ্ম’ নেই।
৭.
নামলাম জনপথ মোড়ে। ওখান থেকে খানিকটা হেটে ব্রীজটার কাছে এসে বাম পাশের রাস্তায় ঢুকলাম। আমার বন্ধু রানাকে ফোন দিলাম। ওর বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ও বের হলো। ও এখন চেহারা সুরতে পুরো হুজুর। সাদা পাঞ্জাবির সাথে সাদা টুপি। মুখে লম্বা দাড়ি। দু’বছর আগের রানা আর এখনকার রানায় অনেক তফাত। ওকে ডেকে নিয়ে এসে আলম হোটেলে বসলাম। অনেকক্ষণ আড্ডা মারলাম। কথার ফাঁকে ও জানালো ওকে আজ অফিসে যেতে নিষেধ করেছেন বস। বলেছেন, রানা আপনার কাল অফিসে আসার প্রয়োজন নেই। ঘর থেকেও বের হবেন না। রানা ঠিক তাই করেছে। বের হয়নি। আমিই এসে ওকে টেনে বের করলাম।
৮.
আমি এখানের এক সেলুনে চুল দাড়ি কাটাই। সেলুনের মালিকের নামও রানা। মালিক কাম নাপিত। ওর সাথে আমার ভালো খাতির। গল্প করে আর চুল কাটে। কথা প্রসঙ্গে আজকের সমাবেশের কথা উঠলো। ও রেগে গেলো। ‘কোন শালায় ভালো না। জনগনের লাইগা কেউ না। জানেন আইজকা আমি সোনারগা বাড়িতে গেছি। বারবার চেক করতাছে। এমন দুখ পাইছি। শেষে পুলিশরে চেইতা কইলাম- পাইছেনটা কি? মানুষ দেখলেও তো বুঝা যায়, ভালো না খারাপ। আমি কাউরে ভোট দেইনা দিমুওনা’।
৯.
আবার এলাম আলম হোটেলে। হাসান ভাই এসেছেন। একসাথে চা খেলাম। দু’জনই মোটামুটি ক্লান্ত। ঘড়িতে এগারোটার ওপরে বাজে। বেশি গল্প করার সময় নেই। চা’ এ কেমিকেল জাতীয় কিছু দেয় বোধ হয়। আমি ‘চেইন চা-খোর হওয়ায় কোন সমস্যা হলো না। হাসান বলছিলেন, পেটে ব্যথা করছে। বের হবার আগে আইডি কার্ডটা গলায় ঝুলালাম। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো নয়। আমি সাংবাদিকতায় নিয়মিত নই। তবুও একটা আইডি কার্ড আছে। এ ধরণের বিপদের দিনে এই কার্ডটা মূল্যবান হয়ে উঠে।
১০.
আবারো আট নাম্বার বাসে করে ফিরে এলাম। খুব একটা সময় লাগলো না। এগারোটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। টিভি দেখতে বসলাম। বারোটার পরে নিশ্চয়ই জমজমাট ‘টক শো’ হবে। তবুও টিভি দেখতে মন চাইছে না। টিভি বন্ধ করলাম। সদ্য টেলিভিশনে চাকরি পাওয়া তানভিরের ফোন এলো। ওকে বললাম মাত্র বাসায় ফিরলাম। ও বললো- এই সময় বের হয়েছেন, আপনার সাহস তো কম না। সাহস বা ভয় আমার মাঝে তেমন একটা কাজ করে না। কাজ করে ‘ক্যালাসনেস’। এটা কাজের নয়। জানি বলেই সচেতন থাকতে চেষ্টা করি। হয়তো পারি, হয়তো পারি না।
শেষের আগে
গত নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বিজয়ের পরদিন সকাল। আমি বাড়িতে। দিনাজপুরে। খাইরুল ভাই’র সাথে দেখা। বললেন, আওয়ামীলীগ তো জিতে গেলো। এই হবে ঘুরেফিরে। একবার বিএনপি একবার আওয়ামীলীগ। ক্ষমতাটা হলো একটা ডোবা। সবাই সাদা কাপড় নিয়ে নামে। কালো হয়ে উঠে। যার কারণে আর ভোট পায় না।
ক্ষমতা’টা কি সত্যিই ডোবা? এই ডোবায় নামতে সবাই এতো তৎপর কেন?
[email protected]