উচাটন
তারিক আল আজিজ
আজকাল কিছুই ভাল লাগে না রতনের। পড়তে গেলে দু’মিনিট বাদেই অন্য কোন চিন্তা এসে ওকে ভাসিয়ে নেয়। ও ঠিক ভেসে যায়। কিন্তু সেটাও অল্প সময়ের জন্য। আরেকটা চিন্তা ঠিক ফাঁক বুঝে ঢুকে পড়ে। সেখান থেকে আরেকটায়। আরেকটা থেকে আরেকটায়। বানের পানির মতন চিন্তারা আসতে থাকে। নির্দিষ্ট কোন এক চিন্তায় ও স্থির হতে পারছে না।
ভোরে হঠাৎই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কেন? কারণ খুঁজতে গিয়েও পেল না। রাতে তো দেরি করেই শুয়েছিল। তার ওপর ক্লান্ত ছিল। একটানা কয়েক ঘন্টা ঘুমানোর কথা। কিন্তু ঘুমটা কেন ভেঙ্গে গেল? ঘুম ভাঙ্গা থেকেই মাথায় আসলো রোগটার নাম। ‘ইনসোমনিয়া’। ‘ইনসোমনিয়া’ নামেই তো নোলান একটা ছবি বানিয়েছিল। এল পাচিনো, রবিন উইলিয়ামস আর হিলারি সোয়াঙ্ক ছিল। রবিন উইলিয়ামসের কথা মনে হতেই চিন্তাটা আরেকদিকে চলে গেল। এই লোক আত্মহত্যা করবে কেন? যেই লোক ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ করেন, সেই লোক কেন আত্মহত্যা করবেন?
আরেকটা কী যেন ছবির কথা মাথায় এসেও আসছে না। কী ছবিটা? রতন বিছানায় বসেই মাথা ঝাঁকালো, ঘরের এধার-ওধার হাঁটলো। নাহ, কিছুতেই মনে পড়ছে না। কতগুলো শুধু আবছা মুখ।
মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। ভার্সিটি লাইফে সবাই ওকে ‘আইএমডিবি’ ডাকতো। অথচ ওর কিনা এই দশা!
একটা কাজ করা যায়, জমিয়ে একটা ছবি দেখা যায়। যেই ভাবা সেই কাজ। চট করে ল্যাপটপটা অন করল। পাশে বউ না থাকায় এই এক সুবিধা। ল্যাপটপটা বিছানায় নিয়েই ঘুমানো যায়। মিতুর আবার নানান ঝামেলা। বিছানা এক্কেবারে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। শোয়ার সময় বিছানায় কোন কিছু থাকা চলবে না। পড়তে পড়তে একটু ঝিমোলেই দেখবে ওর হাতের বই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। চোখ মেলেই দেখবে বইটা সেলফে শোভা পাচ্ছে। আচ্ছা, মিতুকে কি আদৌ কোন বই ও পড়তে দেখেছে? না না, চিন্তাটা অন্যদিকে সরে যাচ্ছে। সরতে দেয়া যাবে না। এখন একটা ছবি দেখতে হবে।
রতন ওয়াইফাইটা কানেক্ট করে এফটিপি সার্ভারে ঢুকল। এ বাবা! নেট এতো স্লো কেন? এখন কী হবে? আগে ওর কালেকশন ছিল। নানান ভাবে সংগ্রহ করা সিনেমাগুলো ডিভিডি করে রাখতো। এখন তো আর তেমন প্রয়োজন পড়ে না। সার্ভারে ঢু মারলেই হয়। কিন্তু নেট স্লো, এখন কী করবে?
ল্যাপটপের প্রতিটা ড্রাইভেই ওর মুভি নামে একটা করে ফোল্ডার আছে। সবগুলোতেই ঢু মারলো। কিন্তু দেখার মত পছন্দসই কিছু পেল না। তাহলে উপায়?
রতন ভাবতে থাকল। আজকাল সিনেমা দেখতেও তেমন ভাল লাগে না। কেন লাগে না? কোন উত্তর নেই। একটা সময় দিনে চারটা-পাঁচটা ছবিও দেখেছে ও। সেই ও কী করে এমন হয়ে গেল! বইয়ের পাতায়ও মন বসে না। একটু আধটু যা, ইউটিউবে ঢুকেই ছোট ছোট ক্লিপ দেখা। দিনেদিনে কি ওর অস্থিরতা বাড়ছে? কে জানে!
রতন চিন্তা ছেড়ে এবারে এমএস ওয়ার্ড ওপেন করে। কী ব্যাপার? এমন লাগছে কেন? এ যে ১৩ ভার্সন। নাহ! প্রোগ্রামে গিয়ে এমএস অফিস আনইন্সটল করে ৭ ইন্সটল করে আবারো ওয়ার্ডে ঢুকে। বিজয়টা সেটাপ দেয়াই আছে। চেক করে নেয় বাংলা লেখা যাবে কিনা। তারপরই লিখতে বসে।
লিখতে বসে আবারো তালগোল পাকায় ও। কত কিছুই তো লেখার বাকি। নাটকের স্ক্রিপ্টটা সেই কবে লিখে দেয়ার কথা, দুটো গান চেয়েছিল আরমান। একটার ‘মুখ’ লেখা হয়েছে। আর তো কিছুই লেখেনি। ওহ হো, স্বাধীন কী একটা লেখা পাঠিয়েছিল। একটু দেখে দিতে বলেছে। কিন্তু মেইলটাই তো চেক করা হয়নি।
আজকাল কেন এত ভুলোমনা ও! সব কেমন বেমালুম ভুলে যায়। ‘ডায়রি মেন্টেন করতে হবে।’ কথাটা মনে হতেই হাসে ও। কতজনকে বলেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজের মাঝে একটা হলো ডায়রি মেন্টেন করা। কতজনকে বুঝিয়েছে, ‘দ্যাখ, সময় ধরে, ঘড়িঘন্টা ধরে চলে আর যাই হোক, দুনিয়া উদ্ধার হয় না। ডায়রি মেন্টেন করতে করতে একদিন দেখবি কি জানিস, রাস্তায় কোন একটা ইন্সিডেন্ট ঘটলো, কোন লোকের তোর সাহায্য দরকার, কিন্তু তুই এভয়েড করছিস। ওই যে, তোর ডায়রিতে লেখা আছে, এখন তোকে অমুক কাজের জন্য চিতার গতি নিয়ে অমুক পথে ধাবিত হতে হবে।’
ওর সব যুক্তির জন্য বন্ধুদের কত তিরস্কার শুনেছে। রতন কখনোই এসব গায়ে মাখেনি। ওর নিজের রাস্তা নিজের মত করেই বেছে নিয়েছে। এক আলসেমির পেছনেই যে কত যুক্তি দাঁড় করিয়েছে! কেউ কিছু বললেই বলতো, ‘আমি হইলাম স্লো, বাট স্টেডি’। কিন্তু এখন কী হবে? নানান জনের কাজ যে ও আটকে রেখেছে। লেখাগুলো ঠিকমত না দিলে তো ঝামেলা বাধবে। সবাই ওকে...। যাহ! আসিফের গানটা মনে পড়ে গেল। ‘কথা দিয়ে তুমি কথা রাখনি।’
রতনের ভাবনা আরো গড়ায়। একটা মিজারমেন্ট স্কেল দরকার, যেটা দিয়ে মানুষের চিন্তার পরিধি মাপা যাবে। বিজ্ঞান কি এরকম কিছু আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছে? রতন জানে না। বিজ্ঞানের ওপরও ওর খুব একটা ভরসা নেই। ওর কেন যেন মনে হয় জ্ঞানের একটা শাখা হিসেবে বিজ্ঞান এখন পড়তির দিকে। অন্য কোন শাখা হয়তো শিগগিরই সামনে এসে আসন পেতে বসবে।
আবার কথা রাখা না রাখার চিন্তায় পড়ে রতন। মিতুকেও কথা দিয়ে রাখেনি ও। ঘটনা খুব ছোট। অন্তত ওর দৃষ্টিতে। সেই থেকে রাগ করে মিতু বাবার বাড়ি। রতন ভেবে পায়না কেন মিতু চলে গেল। ও নিজ থেকেও মিতুকে ফোন করছে না। আবার মিতুও করছে না। মিতুর বাবা ফোন করেছিলেন। কিন্তু শশুর মশায়ের ফোন ও ধরে নি। কেন ধরবে? ঝামেলা হয়েছে মিতুর সাথে। দরকার হলে মিতুই ফোন করবে। ওর বাবা কেন?
তবে রতন আগ্রহ নিয়েই অপেক্ষা করছিল মিতুর ফোনের। মিতু ফোন করলে সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ শুনিয়ে দিত। মিতু চলে যাওয়ার পর থেকে এই একটা কবিতা শোনাবে বলে কণ্ঠটা ঠিক রাখার কত চেষ্টা করেছে। লবন-পানি দিয়ে গড়গড়া করা, হামিং করা, প্রাণায়াম করা; কিন্তু মিতু নিজ থেকে ফোন করেনি।
মিতু একটা ফোন করলেই পারতো। কেন করল না?
রতন নিজেকে নিয়ে ভাবে। সংসার করতে গিয়ে ও ছেলেমানুষি করছে কি? ভেবে অন্ত পায় না। মিতু তো ওকে এমনটা জেনেই বিয়ে করেছিল। কিন্তু সংসারে এসে মিতু ওকে নানানভাবে বাঁধবার চেষ্টা করেছে। ভাবা যায়, ওকে নিয়ম করে ওয়েটটাও মাপতে হতো। কী ঝামেলারে বাবা!
মিতুকে রতন বোঝাতো। ‘দেখো মিতু, বিএমআই ইনডেক্স সব রাবিশ। একটা মানুষের শুধু হাইট ধরে কেন ওয়েট মিজার করা হবে। উইথটা কি কিছুই নয়?’ মিতু ওর কথা শুনে হাসতো। বলতো, ‘চ্যাপ্টামো ছাড়ো’। এই ‘চ্যাপ্টামো’ বিষয়টা মিতু কখনোই ভাল করে ব্যাখ্যা করেনি। নানান ক্ষেত্রে মিতুর এই শব্দের প্রয়োগ বেশ বিরক্ত করে। আসলে মিতু যে কী বোঝাতে চায় ও নিজেই জানে কিনা সন্দেহ। ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ আসার শব্দ হয়। আরমান! ‘ভাই লেখাটা, আপনাকে অনলাইনে দেখে নক করলাম।’
রতন লিখলো, ‘আয় আরমান, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করি। শালা এই ভোরে...।’ আরমানকে সেন্ড করল না অবশ্য। লেখা শেষে নিজে কয়েকবার পড়ে ডিলেট করে দিল। নিজে নিজে হাসল খানিকক্ষণ।
জানালার পর্দাটা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। সকালের আলো ফুটছে কি? ক’দিন আগে একটা ছবি দেখেছে। ‘আসা যাওয়ার মাঝে।’ আহ, মধু! সাইলেন্ট ছবিটা কী শক্তিশালি!
সকালের আলো ফুটেছে কিনা তা দেখতেই পর্দাটা সরিয়েছে রতন। কিন্তু তা না দেখে আরেক ভাবনায় হারিয়ে গেল। কী যেন একটা গান আছে, ‘সকালের আলো মেখে..’। হাঁ, ছাদে যাওয়া যায়। একটু মেখেই আসা যাক সকালের আলো।
ঘর ছাড়ে ও। দরোজা খুলে বাইরে বেরোতেই দেখে সিঁড়ি অন্ধকার। আবার ভেতরে ঢুকে। মোবাইলটা সাথে নেয়। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে ছাদের দিকে হাঁটতে থাকে। কত সিঁড়ি ওর মাথায় আসে। ‘আমরা সিঁড়ি, তোমরা আমাদের মাড়িয়ে...’, ব্যাটেলশিপ পটেমকিনের সিঁড়ি, সিঁড়ি নামে কারা যেন একটা ম্যাগাজিন বের করতো। আপন মনে হাসে ও। ছাদের গেটে এসে খুশি হয়। যাক, তালা মারা নেই।
ছাদে উঠে এবারে ঠিক খেয়াল করে সকাল। আঁধারটা কাটছে, আলোটা ফুটছে। লম্বা ছাদটার ঠিক মাথায় গিয়ে দাঁড়ায়। রাস্তাটা ওখান থেকে পরিস্কার দেখা যায়। যথারীতি ল্যাম্পপোষ্টের ধারেই একটি কুকুরকে দেখতে পায়। কোন পাগল দেখতে পায় না অবশ্য। এ এলাকায় তেমন পাগল কোনদিন দেখেছে বলেও মনে পড়ে না। তবে, ক’দিন আগে অবাক করা একটা স্বপ্ন দেখেছিল। একটা ছেঁড়া লুঙ্গি ও ছেঁড়া সেন্ডো গেঞ্জি পড়ে ও পাগল হয়ে ল্যাম্পপোষ্টটার গা ঘেষে বসে আছে। কুকুরটা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে মুখটা উঁচু করে তুলে ধরে ‘উ’ চিৎকার করছে। রতনও কুকুরটাকে অনুসরণ করে চিৎকার করছে। একটু পর কুকুরটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। অবিকল মানুষের মতন হাসি।
এরপরই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়।
স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্ন কি সত্যি হয়? রতন ভাবে, স্বপ্ন পড়ালেখা করা যায়। টপিক হিসেবে খারাপ না। স্বপ্নের তাবির করতে পারলে খারাপ কিছু হয় না। ‘মানুষ যা চিন্তা করে, তার প্রতিফলন হিসেবেই স্বপ্ন দেখে’, এই এতটুকু জ্ঞান দিয়ে কি স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করা যায়!
সকালটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে। রতনের চিন্তাগুলো হচ্ছে না। সে চিন্তার মাঝে তড়পাতে থাকে। একটা ছেদ পড়ে কুকুরের ডাকে। কুকুরটা ঠিক ডাকতে শুরু করেছে, ‘উ’। রতন কুকুরটার দিকে তাকায়। একটা ছেঁড়া লুঙ্গি পড়ে কি কুকুরটার পাশে গিয়ে বসবে ও?
মোবাইলটা বেজে ওঠে। ভাবনায় আরেক দফা ছেদ পড়ে। সকাল মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে রিমাইন্ডার দেয়া। ওরে আল্লাহ! আজ একটা গল্প দেয়ার কথা।
কী করবে রতন? কুকুরটা ঠিক আপন মনে ডেকে চলেছে। এমন করে এক মনে যদি লেখা যেতো! এখন কী করবে ও?
আবারো মিতুর মুখটা ভেসে ওঠে ওর মনে। একেবারে সিনেমার ‘ফেডইন’ হবার মতন। রতনের বুক তড়পায়। দেবে কি মিতুকে একটা ফোন? মিতু ও মিতু! অভিমানের বেড়াটা ডিঙ্গিয়ে যায় রতন। মোবাইলের কন্টাক্ট থেকে মিতুর নম্বরটা বের করে। ছোট্ট একটা নাম- মিতু। ওর মোবাইলে আরো ছোট করে সেভ করা- মি।
- হ্যালো?
মিতুর ঘুমকাতর কণ্ঠটা শোনা যায়।
- মি?
রতনের মনে হয় ও মিতুর পাশে বসে কথা বলছে।
- উ।
মিতু ছোট্ট করেই উত্তর দেয়। ১০ সেকেন্ডের একটা নীরবতা উভয় পাশ থেকে। কুকুরটাও ডাক বন্ধ করে দিয়েছে। রতন কী বলবে ভেবে পায় না। মিতুই আবার কথা বলে।
- জানো, এই প্রথম তুমি আগে আমায় ফোন করলে।
মিতু কি কাঁদছে? হাঁ কাঁদছে। নিশ্চয়ই কাঁদছে। একটা বাতাস বয়ে যায়। সকালের বাতাস। মিতু আবারো কথা বলে।
- আমি আসব। ১০টা নাগাদই চলে আসব।
- হু।
রতন আর কিছু বলতে পারে না।
ছাদ থেকে নেমে আসে ও। সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। আর কোন সিঁড়ির কথা মনে পড়েনা ওর। কবিতাটা মনে পড়ে। ‘প্রেম আসে, বুকের পাথর সরে যায়।’ যায় কি? কোত্থেকে যেন বেজে উঠে- ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’। একটা কাজ করলে কেমন হয়, মিতু আসার আগেই ওর বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া যায়। তারপর ওকে নিয়ে সোজা কোথাও ঘুরতে যাওয়া। হয় তো, হতেই পারে, আলবৎ হতে পারে।
চিতার গতি ভর করে রতনের পায়ে। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে ঘরে ঢোকে। অগোছালো ক’টা জামা-কাপড় দোলা পাকিয়েই ব্যাগে চালান দেয়। তারপর ব্যাগটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়ে।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪৯