১৯৯৭: ঢাকার বাড্ডা এলাকার লিলিয়ানের সাথে বন্ধুত্ব হলো উত্তরার বায়িং হাউজে কর্মরত মাহমুদ সাজ্জাদের। ছুটির দিনে লিলি আসে সাজ্জাদের সাথে দেখা করতে। একেকদিন একেক রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেয় আর বাবার টাকায় বিল মেটায়। লিলি স্মার্ট মেয়ে, বেশ প্রগতিশীল। আর সাজ্জাদ সদ্য খুলনা থেকে আসা বড্ড লাজুক ও রক্ষণশীল। তবে এই দুই অসম মানসিকতার তরুণ-তরুণীর মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে একটুও সময় লাগেনি।
২০০০: লন্ডন প্রবাসী সিরাজুল মাওলার সাথে বিয়ের সম্নন্ধ এলো লিলির। সাজ্জাদের কাছে ছুটে আসে লিলি। "চল বিয়ে করে ফেলি"। লিলির প্রস্তাবে স্তব্ধ হয়ে যায় সাজ্জাদ। "বিয়ে! ফাজলামি করছিস নাকি? তুই আমার দারুণ একটা বন্ধু। বিয়ের কথা আসে কি ভাবে?" সাজ্জাদের কন্ঠস্বরে বিস্ময় আর বেদনার মাখামাখি। স্মার্ট লিলি মুহূর্তে সামলে নেয় পরিস্থিতি। তুমুল হাসিতে ভেঙে পড়ে বলল,'তুই পাশ করলি। আমি আসলে তোর বন্ধুত্ব পরখ করে দেখলাম'। সাজ্জাদও হেসে ফেলে। বিয়ের পর লিলি স্বামীর সাথে লন্ডন চলে যায়। যাওয়ার আগে স্বমীর সাথে সাজ্জাদের পরিচয় করিয়ে দিতে ভুললোনা।
২০০৬: ওর নাম বাবুয়া। সাজ্জাদ আদর করে ডাকে "বাবু"। বেসরকারী কলেজের প্রভাষক, পাশাপাশি এম.ফিল করছে। লিলির সাথে তিন বছর মিশে যে বোধ জন্মায়নি, বাবুয়াকে দেখার কয়েকমিনিটের মধ্যে সে বোধ টের পায় সাজ্জাদ। ব্যক্তিগত জীবনে ভীষন আদুরে, আবার কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও ব্যক্তিত্বময়। সাজ্জাদ ততদিনে চাকরী ছেড়ে ব্যবসা শুরু করে এবং ব্যবসায় ধরা খেয়ে বেকার জীবন কাটাচ্ছে। সাজ্জাদের ভেতর বাবুয়া খুজেঁ পায় এক বিশাল বৃক্ষকে, যে বৃক্ষের ছায়ায় নিচে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করা যায়। খুব অণ্প সময়ের মধ্যে গভীর প্রেমে ডুবে যায় দুজন। সাজ্জাদ বাবুয়াকে লিলির গল্প শোনায়। বলে,"বাবু, তুমি আমার প্রথম প্রেম। জীবনে কোনদিন এমন করে ভালোবাসিনি। লিলি ছিল আমার বন্ধু, কখোনো বোন।"
২০০৭: সাজ্জাদের সাথে লিলির যোগাযোগ রয়ে গেছে। বাবুয়াকে কিছুই লুকায়না সাজ্জাদ। প্রথমদিকে বাবুয়া কিছু মনে করতোনা। কিন্তু ধিরি ধিরে তার ভেতর আশঙ্কা জন্ম নেয়। সাজ্জাদ লাজুক আর বোকা ধরনের মানুষ। বাবুয়া মনে হতে থাকে তাদের দুইজনের মাঝে লিলি সমস্যা হয়ে দাড়াঁচ্ছে। এদিকে সাজ্জাদ বলল,"লিলি কাল ফোনে বলছিল, তুই আমাকে চিনিস নাই, তুই যদি আমাকে চিনতি তবে আমি এখন লন্ডন থাকতামনা, দেশে থাকতাম"। বাবুয়া আচমকা চিৎকার করে ওঠে, স্টপ ইট! প্লিজ, তোমাদের এই বন্ধু-বন্ধু খেলা থামাও। যে মেয়ে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, স্বামীর সংসারে থেকে তোমাকে ইতং বিতং সংলাপ শোনায়, সে কেমন বন্ধু? বলো, উওর দাও?
২০০৮: বেকার সাজ্জাদকে মেনে নিতে পারেনা বাবুয়ার পরিবার। তাই কাজী অফিসে গিয়ে দুজনে বিয়ে করল। বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় লিলির মেসেজকে কেন্দ্র করে তুমুল ঝগড়া হয় ওদের। সাজ্জাদ রাগ করে সিম ভেঙ্গে ফেলে। একমাস পর লিলি ফোন করলে সাজ্জাদ ওর বিয়ের খবরটা দিয়ে বলে, "শোন্, বাবু আমাকে প্রচন্ড রকমে ভালবাসে। ওর ধারণা তোর সাথে যোগাযোগ থাকলে আমাদের দাম্পত্যজীবনে সমস্যা হবে।" একনিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে স্বস্তিবোধ করে সাজ্জাদ। লিলি তার কাছে কেবলই একজন বন্ধু, তার পক্ষে সরাসরি ফোন করতে মানা করা কঠিন।
২০০৯: দেশে আসে লিলি। ফোন করে সাজ্জাদকে। সাজ্জাদ কিছুটা বিব্রত, কিছুটা বিরক্ত। বাবুয়া মুখটা মনে পড়ে। বউটাকে একটুও সুখ দিতে পারেনি। অথচ তার খিটখিটে মেজাজ, অল্প আয়, সময় দিতে না পারা ইত্যাদি মানিয়ে নিয়ে বেশ সুখী বাবুয়া। লিলি বার-বার ফোন করে, সাজ্জাদের সাথে দেখা করতে চায়। সাজ্জাদ একবারও কলব্যাক করেনা। মনে মনে প্রার্থনা করে, হে আল্লাহ, এই মেয়েটাকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে নাও।
২০১০: বাবুয়া খুব খুশী। সে মা হবে। দুই মাস চলছে। সাজ্জাদ আজকাল তাড়াতাড়ি বাসায় আসে। বাবুয়ার পেটে হাত রেখে বাচ্চাকে "হ্যালো" বলে। এরমধ্যে লিলি ফোন করে সাজ্জাদকে তার বাচ্চা হওয়ার খবর দেয়। আর বাবুয়াতা জেনে যায়। উন্মাদ হয়ে যায় বাবুয়া। চিৎকার, কান্না আর হাত-পা ছোড়াঁছোড়ি শুরু করে দেয়। সাজ্জাদ বউকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে। "কেন, কেন, কেন তাকে মানা করে দাওনা। কেন সে বার বার ফোন করে?" ক্ষেপে ওঠে সাজ্জাদ। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, শালা মেয়ে মানুষ জাতটাই হারামি। ঐ মেয়েকে আমি ইঙ্গিতে বুঝিয়েছি, তবু যদি সে ফোন করে তবে সেটা তার সমস্যা। খুব তো মেয়েদের পক্ষে কথা বলো, গল্প লেখো, এখন তোমার কষ্টের কারন কিন্তু একটা মেয়ে।"
কিছুদিন পরে: চাকা চাকা রক্তের প্লাবনে বাবুয়ার বাচ্চাটা বিলীন হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন, প্রচন্ডরকম মানসিক চাপে এই গর্ভপাতের কারন।
পরিশিষ্ট: বাবুয়া কাদঁছে। বাবুয়ার আকুল করা কান্নায় সাজ্জাদের বুক ভেঙ্গে যায়। নিজেকে অপরাধী লাগে।
অন্যদিকে, ঠিক একই সময়ে লন্ডনের একটি বাসা তখন শিশুর কান্নায় মুখরিত। শিশুটি জন্মগতভাবে উরুতে সমস্যা নিয়ে এসেছে। শিশুর পিতা সিরাজ সাহেব ব্যথিত চোখে বাচ্চাকে দেখছে আর মাতা লিলিয়া বাচ্চার কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। যার কারনে বাংলাদেশে একজন কাঁদছে, সেই লিলি লন্ডনে আরেকজনের কান্না থামাচ্ছে। প্রকৃতির কী বিচিত্র খেয়াল!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



