somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিশ্‌কুল

২৭ শে মে, ২০১১ দুপুর ১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাঁকা শিঙওলা, ভূষভূষে কালো রঙের বিরাট এক মোষের পাশে বসে আমার স্কুলের প্রথম দিনটা শুরু হয়েছিল । এখনকার বাচ্চারা কি সুন্দর কার্টুন আঁকা ব্যাগ, বারবি পানির বোতল নিয়ে টুক টুক করে ঝাঁ চকচকে স্কুলে পড়তে যায় । আমাদের সময়ে এত কিছু ছিলনা । বাবার ছিল বদলির চাকরি, তাতে আবার ওপরঅলাদের তৈল সিঞ্চনে অপারগ । অবধারিত ভাবেই কিছুদিন পর পর ট্রাকের পেছনে মাল সামান নিয়ে এ শহর ও শহর করতাম আমরা । সেবার গেলাম পলাশবাড়ী নামে একটা ছোট্ট শহরে । গিয়েই মা বললেন এইবার বড়টাকে স্কুলে দিতেই হবে ।

খুব বেশিদিন আগের কথা না হলেও তখন বাচ্চাদের স্কুলে দেয়াটা এখনকার মতো দুঃস্বপ্নের ছিলনা । নিয়ম কানুন ভারী সহজ । আর স্কুলও তো বাড়ির উঠোনেই বলতে গেলে । ঝোপ ঝাড়ে ভরা ফাঁকা একটা মাঠের মাঝ খানে আমাদের হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি, তার ওপাশে একটা পুকুর, পুকুরের পাশেই বাঁশের চাটাই ঘেরা চার পাঁচটা ঘর নিয়ে স্কুল । আমার ধারনা হল যেহেতু ভাই স্কুল যেতে পাচ্ছে, নিশ্চয় সেটা ভালো জিনিষ হবে । কাজেই মা যেদিন ভাইকে নিয়ে গেলেন, বায়না ধরলাম, আমিও যাব । হেড মাস্টার সায়েব খুব গম্ভীর চোখে আমার আপাদমস্তক মেপে নিয়ে বললেন, অসুবিধা কি, ওকেও দিয়ে দিন । ব্যাস, হয়ে গেল ।

ভর্তি তো হলাম কিন্তু ক্লাস রুমে ঢুকতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেতে হল । ঘর ভর্তি এক পাল বাচ্চাকাচ্চা ইচ্ছেমত হাউকাউ করছে আর এক দিকে পাজামা পাঞ্জাবি পরা একজন লোক বেত হাতে কি যেন বলে চলেছেন, কেউ কারো কথা শুনছেনা । আমাকে দেখে সবাই জুলজুল করে চেয়ে রইল কিন্তু কেউই বসতে দেয়না । শেষটায় বসতে পেলাম শেষের ভাঙ্গা বেঞ্চ টায় । বসেই দেখি এত্তবড় ওই মহিষটা আগেই পাশে বসে আছে । কী আপদ । ভয়ে উঠেও যেতে পারিনা । আমাকে দেখে মোষটার বোধ হয় সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স হল, হটাত গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আমার পায়ের কাছে থ্যাচ থপাত থ্যাচ থপাত করে একগাদা লাদা ফেলে দিয়ে হেলে দুলে সামনে এগিয়ে গেল । মাস্টার মশায়, এহ্‌ হে, হেট্‌ হেট্‌ করে ছাত্র পেটানো বেত দিয়ে মোষ পেটাতে লাগলেন আর ওই ফাঁকে আমার সহপাঠীরা এসে আমাকে মেরে খিমচে পুরো গায়ে লাল করে দিল । এরকম করে বিদ্যার্জন করার দিন সাতেক পরে মা 'যথেষ্ট হয়েছে' বলে স্কুল ছাড়িয়ে দিলেন ।

এরপর থেকে স্কুলে যেতে পেতাম না কিন্তু খুব আগ্রহ নিয়ে সামনের পুকুরের পাড়ে বসে থাকতাম । স্কুলের ছেলেগুলো দল বেঁধে ছুটে এসেই ঝপাং ঝপাং করে পানিতে ঝাঁপাত । ঝাঁপ দিয়ে উঠেই পাড়ের বালির ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে পুরো গায়ে বালি মেখে আবার ঝপাং করে ঝাঁপ । এক দুনিয়া সুখ বোধ হয় ওদের মুঠোয় ভরা থাকত ।

এর কদিন পরে আমরা চলে গেলাম রংপুরে । ওখানে কি একটা মিশনারি স্কুলে ভর্তি হলাম । প্রথম দিন এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে আছি, হটাত বাতাস বেয়ে কোথা থেকে এক রাশ ফুঁও ফুঁও সাদা শিমুলতুলো উড়ে এল । কী সুন্দর কী সুন্দর ! শিমুল তুলোর রূপে মুগ্ধ হয়ে আমরা কজন দৌড়াদৌড়ি করে তুলো কুড়োতে লাগলাম । একটু পরেই অবশ্য রোদের মধ্যে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে টের পেলাম প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হওয়াটা মোটেই কাজের কথা নয় । সেই আমার প্রথম নিয়ম ভেঙ্গে 'শাস্তি' পাওয়া । সেদিন অবশ্য ঠিকমত বুঝিনি কেন শাস্তি পাচ্ছি ।

এর পর দিনাজপুরে । এতদিন স্কুল স্কুল খেলা খেললেও মা এবার সিরিয়াস । শুরু হল পড়াশুনো । গেলাম আরেকটা নামকরা মিশনারি স্কুলে । কিন্তু অভাগা যায় বঙ্গে, অভাব যায় সঙ্গে । প্রথম দিন গিয়েই শুনলাম সেখানে সব বাচ্চাকে টিকা দেয়া হচ্ছে । অম্নি ক্লাশের বড় জানালা টপকে যত ছেলেমেয়ে সব ভোঁ ভাঁ । আমার প্রসেসর মনে হয় ভীষণ স্লো , জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করবার আগেই ধরা পড়ে গেলাম । আমার মতো আরও কটা বেকুবও ধরা পড়ল । সবাই কেঁদে চিল্লিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করছে আর আমি গম্ভীর মুখে নিজেকে সান্তনা দিচ্ছি যে, টিকা দিলে কি হবে, সাথে তো চোখ পরীক্ষাও করছে, এইবার একটা চশমা পাব ! একটা চশমার আমার খুব শখ । তাই টীকার ব্যাথা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম । কিন্তু চোখের ডাক্তার দেখে বললেন, সব ঠিক আছে , যাও । কি মুশকিল, চশমাটা কি পাবো না !? মরিয়া হয়ে বলেই ফেললাম, কই ঠিক আছে ? আমি তো দেখতেই পাইনা । ডাক্তারটাও যেন কেমনধারা, হাসি চেপে বললেন, সে কী ! তুমি দেখতে পাওনা ? এই যে এটা কি লেটার, বলতো ? চেনোনা ? আমি বললাম, এটা পি, আমি জানি, কিন্তু সেটা তো আমি দেখতে পাচ্ছিনা !!

আজ এত বছর পরেও আমার চোখে চশমা ওঠেনি কিন্তু কোন কোন অলস দুপুরে ডাক্তারের সেই হাসির আওয়াজ এখনও শুনতে পাই । সময় বুঝি সত্যিই উড়ে চলে । এখন ধানমণ্ডির ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়াদের গাড়ির বহরে আটকা পড়ে কপালে ভাঁজ ফেলি রোজ । খুব বিরক্ত হয়ে উঠতে উঠতে কক্সবাজারের সৈকতে দেখা নীল সাদা ইউনিফরম পড়া একদল উচ্ছল ছেলেমেয়ের কথা হুট করে মনে পড়ে যায় । রোজ বিকেলে ওদের দেখতাম ছুটির পর সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাতে ভেজাতে সৈকত ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে । আজকাল প্রায়ই বাড়ি ফেরার সময় গ্রিডলক জ্যাম নামের অদ্ভুত এক যান্ত্রিক যন্ত্রণায় পড়ে ঘামতে ঘামতে হটাৎ হটাৎ ওই ছেলেমেয়ে গুলোর কথা মনে পড়ে, আর কেন যেন ভীষণ হিংসে হতে থাকে ।
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×