somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : প্রতিধ্বনি

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ডাইনিং টেবিলটার কোনা ধরে বিশাল ফ্রিজটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বকুল। বেড রুম থেকে চিৎকার দিল এশা, “আম্মু, পরাগ চিলি সস চায় ... ঐ যে টক-মিষ্টি সসটা। নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি ...।”

বকুল কোন উত্তর দিল না। পরাগ চার মাস আগে মারা গিয়েছে।

“আম্মু?” আবার এশার চিৎকার।

বকুল ডাইনিং রুমটার চারিদিকে তাকালো। মনে করার চেষ্টা করলো কেন এ রুমে ও এসেছিল। বিষয়টা এখন আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নাই। মৃত্যু কী এটা বুঝার জন্য এশা যথেষ্ট বড়। তার বুঝা উচিৎ পরাগ মারা গেছে, এবং সে সস চাচ্ছে না। বেড রুমে তো দূরের কথা এই দুনিয়াতেই সে নাই। এশার বয়স সাত, পরাগ বেঁচে থাকলে এ মাসে পাঁচে পড়তো।

একাধারে উদ্বিগ্ন ও নার্ভাস বোধ করছে বকুল। ঘুরে বেডরুমের দিকে যেতেই পিঠের তীব্র ব্যথায় জমে গেল। এ্যাকসিডেন্টের পর ডাক্তার বলেছিলেন এটা সারবে না, সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তার এখন একত্রিশ চলছে। যদি আর কোন এ্যাকসিডেন্ট না হয় এবং পরিণত বয়স পর্যন্ত বাঁচে তাহলেও দীর্ঘসময় এ ব্যথা সহ্য করে থাকতে হবে।

বেডরুম টা অন্ধকার। সকালে বার কয়েক চেষ্টা করেছে ভারী পর্দা সরিয়ে জানালাগুলো খুলে দিতে। এশার জন্য পারেনি। মেয়েটা দিনে দিনে অদ্ভুত হয়ে উঠছে। বাইরের উজ্জলতা এবং অন্য ছেলেমেয়েদের থেকে অন্ধকার রুম আর মৃত ভাইয়ের সঙ্গ তার বেশি পছন্দ।
পিছনে বড় বালিশটা দিয়ে আরাম করে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে টিভি দেখছে এশা। বকুল উজ্জল চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। মুখে কাটাকুটির দাগগুলো নেই, ভাঙ্গা হাড়গুলোও জোড়া লেগে গেছে। কে বলবে সেও ঐ ভয়াবহ এ্যাকসিডেন্টে ছিল! বিছানার পাশের ছোট টেবিলটায় প্লেটের উপর একটা স্যান্ডউইচ রাখা।

“তুমি এটা খাওনি মা?” স্যান্ডউইচটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো ওকে।

জবাবে ভারী আদুরে একটা ভঙ্গি করলো এশা, “না আম্মু আমি ওটা পরাগের জন্য রেখে দিয়েছি। কিন্তু ওতো সস ছাড়া খেতে চাচ্ছে না!”

না শোনার ভান করে বকুল জিজ্ঞেস করলো এশাকে, “কী দেখছ?”

“টম এন্ড জেরী ... পরাগ দেখতে ...।”

“আর কিছু দেখাচ্ছে না?”

“কি জানি দেখাচ্ছে কিনা। তুমিই তো এটা ছেড়ে দিয়ে গেলে! তাছাড়া পরাগ বললো ...।”

“ঠিক আছে, এবার বন্ধ করো। আমার মাথা ব্যাথা করছে।”

“আম্মু তুমি এরকম করছো কেন?”

“কী রকম?”

“যখনি পরাগের কথা বলি তুমি অন্য কথা শুরু করে দাও!”

“দুপুরে কী খেতে চাও মা?”

“আম্মু ...?” ফিসফিসে কান্না ভেজা স্বরে ডাক দিল এশা।

প্রায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে সামলে নিল নিজেকে বকুল। এশার পাশে আরেকটা বালিশ রাখা। নিজের অজান্তেই ওখানে তাকালো, পরাগকে যদি দেখা যায়! পরমুহূর্তে মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটা দূর করে দিল।

“আম্মু?”

মনের উপর জোর খাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো ও। এখন যদি এশার সাথে কথা বলে তাহলে তার বানানো দৃশ্যে ঢুকতে হবে। সেটা ঠিক হবে না। এমনিতেই গত রাতে শফিকের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল, হঠাৎ করে বেডরুমে ঢুকে দেখে তারা দুজন পরাগের সাথে কথা বলছে। খুব রাগ করেছে ... বলেছে এভাবে ভান করা কারো জন্যই ভাল নয়।

বকুল আবার বিছানার দিকে তাকালো। তাকালো তার একমাত্র মেয়ের দিকে, “এর পর যখন দোকানে যাব তখন তুমিও সাথে যাবে। সস শেষ হয়ে গেছে, ফ্রিজও প্রায় খালি, ঠিক আছে?” এশা বিছানার পাশে স্যান্ডউইচটার দিকে তাকালো।

আহা সত্যি যদি হতো, একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ভাবলো বকুল।

অনেক পরে যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যা। শফিক এক কাপ কফি বানিয়ে ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসলো। জিজ্ঞেস করলো বকুলকে, “কী করলে সারাদিন?”

“এইতো ... ।”

হাসপাতালের ডাক্তার শফিকের ঘাড়ে যে ধাতব বন্ধনীটা লাগিয়ে দিয়েছিলেন ওটা সে খুলে রেখেছে। কিন্তু তার শরীরের অবস্থা ভাল না। ডাক্তার তাকে পূর্ণ সময় কাজ না করে রেস্টে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

বেডরুমে জোরে টিভি চলছে। বকুল জানে এশা প্রায় সারাদিন ওটার সামনে নিথর হয়ে পড়ে আছে। শফিকের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি বকুল থেকে বেডরুমের দিকে ঘুরে গেল।

“বকুল, টিভি চলছে কেন?” উচ্চস্বরের হাসি ভেসে এল টিভি থেকে। শব্দ শুনে মনে হল এখন মিঃ বিন দেখাচ্ছে কার্টুন চ্যানেলটায়।

“প্লিজ কিছু বল না ওকে ... একটু টিভিই তো দেখছে।” অন্যদিকে তাকিয়ে বললো সে।
শফিক উঠে দাঁড়ালো। তারপর ডান পা টা একটু টেনে টেনে হেঁটে বেডরুমের দিকে গেল। একটু পর টিভির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।

“তোমাকে তো বলেছি আমি এসব পছন্দ করি না”, ডাইনিং রুমে ফিরে এসে চিৎকার করলো, “আমি চাই না তুমি খালি রুমে এসব উল্টাপাল্টা খেলা খেল ... রুমে কেউ নাই অথচ ... যত্তোসব।”

তীব্র কান্নার দমকে ডাইনিং টেবিলের উপর মাথা নামালো বকুল। কিছুক্ষণ পর সামলে নিয়ে বলতে চাইলো আজ সকালে কী কথা হয়েছে এশার সাথে। কিন্তু প্রতিদিন, হ্যাঁ প্রতিদিন ... যতবারই ও শুরু করে শফিক কথা ঘুরিয়ে দেয় ... জিজ্ঞেস করে রাতের খাবারের মেনু কী কিংবা পাশের বাসার মিসেস হোসেন এসেছিলেন কিনা।

বার কয়েক চেষ্টার পর হতাশ হয়ে ওড়নাটা টেনে নিয়ে বের হয়ে গেল বকুল বড় রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে সস আনতে। বেশ দূর, হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু তারপরও গাড়ি নেয় না ও। এখনও গাড়িতে চড়তে তীব্র ভয় ওর।

শফিক রয়ে গেল একা বাসায়। দ্বিতীয় কাপ কফি বানাতে বানাতে ভাবলো, আহা সত্যি যদি হতো।

--------------------
লরেন্স সি কনোলি'র ছোট গল্প "ইকোস্" এর ছায়া অবলম্বনে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:৫৮
৩২টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×