somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীল খাম চিঠি

১০ ই জুলাই, ২০০৯ রাত ৮:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


***
পঁচিশের টগবগে যুবক পরাগ, উনিশে পা দেয়া, লাজনম্র রেণু'র প্রতি তার দূর্দমনীয় বোধটুকু চেপে রাখতে পারছেনা কিছুতেই। যদিও পর পর চারবার সামনা-সামনি মনের কথা বলতে গিয়ে ঢোঁক গেলা ছাড়া তেমন ফলপ্রসু কিছু হয়নি তার দ্বারা। পঞ্চমবারে একদম অব্যর্থ পরিকল্পনা- সারারাত জেগে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভালবাসার প্রকাশ করতে বিশাল এক চিঠি! বাকি রাতটুকু ছটফট করতে করতে কোনমতে ঘুম দিয়ে ভোর বেলা নিজের চিঠিখানা পড়ে নিজেই লজ্জা পেলো পরাগ। গোলাপ ফুলের জলছাপ দেয়া লাইন টানা প্যাডটা টেনে নিল আবার। গুটিগুটি অক্ষরে লিখল-

রেণু,
তোমায় বলব বলে সঞ্চিত শব্দগুলো
মুখোমুখি হলে,
কথারই ছলে,
অনেক ভণিতার ভিড়ে,
হয়ে যায় এলোমেলো,
বারেবারে।
তাই ভূমিকাটুকু এড়িয়েই বলি,
তোমাকে ভাল লাগে-
এটুকু বুঝেছি বহু আগে!
ভাললাগার মাত্রা এখন ভীষণ প্রবল-
আমি আমার মনের কোণে কোনঠাসা হয়ে আছি!
অপ্রকাশিত অনুভূতি,
দু'দণ্ড দেয়না স্বস্তি!
আমি আমাতে বড় অসহায়,বড় দূর্বল!
অগত্যা কাগজ-কলমের দ্বারস্থ হয়েছি,
কোন রমনীকে লেখা এ আমার প্রথম চিঠি!

আজ আর না বললেই নয়;
না লিখলেই নয়-
ভাললাগে...তাই ভালবাসি।

অর্ঘ করো গ্রহণ, নতুবা উপেক্ষা-
যদিওবা এখানে অহর্নিশি প্রতীক্ষা।
অদ্যাবধি জানি এবং মানি,
ধন্য হবে প্রাণ
যদি করো চিরঋণী।

ইতি,
পরাগ


***

অতঃপর 'গীতাঞ্জলি' -কে আশ্রয় করে হৃদয়-বার্তা কাঁপাকাঁপা হাতে তুলে দেয়া হলো রেণু'র হাতে। পরাগের ঘুম উবে গেল একদম। মিটিং -এ তার ভিন্ন চাঞ্চল্য, মিছিলের স্লোগানে তার কণ্ঠে সে এক অন্য অস্থিরতা, পোস্টার লেখনিকালে হাত যেন কেঁপে ওঠে! একদিন... দু'দিন... তিনদিন... পরাগের চুল উস্কোখুস্কো! চতুর্থ দিন রেণু'র দেখা মিলল । হাতে সেই 'গীতাঞ্জলি'। পরাগ দুরু দুরু বুকে বইখানা ফেরৎ নিতেই রেণু এক ছুটে পালিয়ে গেল! দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টে-পাল্টে দেখে পরাগ। ভেতরে একটা নীলখাম, তার ভেতর চিঠির মত ভাঁজ করা কাগজ; খুলতেই ছড়িয়ে পড়ল টকটকে লাল গোলাপের কতক পাপড়ি; রেণুদের বাগানের গোলাপ!

***

লুকোচুরি আর চোরাচোখের প্রেমকে রেখে-ঢেকে রাখা গেলনা কিছুতেই! একজন-দু'জন বন্ধু-বান্ধব জানতে জানতেই মুরুব্বীদের কানেও খবর পৌঁছে গেল বাতাসের বেগে! রেণু’র বাসায় তার প্রতি কড়া নজরদারি; আর পরাগের বাসায় তার অভিভাবকেরা ভাবলেন এবার ছেলের বিয়ের পাঠ চুকিয়ে দেয়াটাই সমীচিন হবে।

রেণু আর পরাগদের পরিবার প্রতিবেশী। দু'পরিবারের জানাশোনা ছিল বলেই পরাগদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসতে দেরী হয়না। দেশের অস্থিতিশীল অবস্থায় সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে অভিভাবকেরা সব সময়ই উৎকণ্ঠায়। পরাগ চেনা-জানা, ভাল ছেলে; তাই লোক মুখে কোন কান-কথা ছড়ানোর আগেই রেণুদের পরিবার সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেননা। বিয়ের দিন-তারিখ ধার্য হয় খুবই দ্রুত। কোন রকম আড়ম্বরতা ছাড়াই ওরা দু'টিতে নতুন জীবনের মন্ত্রপাঠ করে।

***
ঘরে পায়চারী করছিল পরাগ। ধীর, ভীরু পায়ে রেণু'র প্রবেশ। আজ ওদের প্রথম রাত। পরাগ এতো দ্রুত দরজার খিল আটকে দেয় যে রেণু খানিকটা ভড়কে যায়। পরাগ তা বুঝতে পারে। রেণু'র সামনে এসে দাঁড়ায়; দু'হাতে রেণুর মুখটা আলতো করে তুলে ধরে গভীরভাবে ওর চোখের দিকে তাকায় পরাগ। রেণু ভয় পেল খানিকটা। এ ভয় কেবল প্রথম স্পর্শের নয়! রেণু বুঝতে পারে পরাগের চোখ আরো কিছু বলছে। আলতো করে রেণু'র কপালে দীর্ঘ চুমু খায় পরাগ। রেণু'র ভয় আরো প্রবল হয়। তার মনে হয় এ আদরের ভিন্ন কোন অর্থ আছে!

***
পরাগ চলে গেল সে রাতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে।

বাকরুদ্ধ রেণু পেছন থেকে শার্ট টেনে ধরেছিল পরাগের। পরাগ থামেনি। রেণু'র হাতে একটা নীল খাম তুলে দিয়ে সন্তর্পণে বেড়িয়ে গেল বাড়ি থেকে। কাঁপা হাতে চিঠির ভাঁজ খোলে রেণু। ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে লাল গোলাপের কিছু পাপড়ি। সেই গুটি গুটি অক্ষরে লেখা এক ছোট্ট চিঠি-

রেণু,
সাতই মার্চের ভাষণ হয়ে গেছে। এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই হাতে একদমই। আমাকেও যুদ্ধে নামতে হবে- আমার জন্য, তোমার জন্য, আমাদের নিটোল ভবিষ্যতের জন্য।

আজ চলে যাওয়ার সাহস করি কেবল তুমি পাশে আছো জেনে। আজ চলে যাচ্ছি কেবল তোমার খুব কাছে ফিরব বলে।

ইতি,
পরাগ


***
কেউ কেউ লুকিয়ে-চুরিয়ে পরিবারের সাথে দেখা করতে আসে কিনবা সংবাদ পাঠায়। অথচ পরাগের কোন খোঁজ নেই! রেণু সে রাতের পর থেকে স্তব্ধ, তাকে কাঁদতেও দেখা যায়নি!

পরিস্থিতি দ্রুত থেকে দ্রুততর বদলে যেতে লাগল। এলাকায় পাক-বাহিনীর আসন্ন টহল এড়াতে ঘর ছাড়তে শুরু করল অনেক পরিবার। রেণু'কে নিয়ে তার বাবা-মা আর শশুর-শাশুড়ীও চলে আসল গ্রামে। সেখানেও খুব বেশীদিন থাকা গেলনা। ভাসমান জীবন হয়ে গেল যেন ওদের।

***
দূর্দান্ত মনের জোরে বাঙালি হটিয়ে দিল পাক-সেনাদের বাংলার মাটি থেকে।

এরপর কথামত পরাগ ফিরেছিল সত্যি সত্যিই! দেহটা সনাক্তকরণে অনেকেরই অসুবিধা হচ্ছিল । মুখটা ফুলে গেছে, বেয়োনেটের খোঁচায় রক্তাক্ত শরীর। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ শার্টে; যেন গোলাপের মলিন পাপড়ি ছড়িয়ে আছে সারা বুক জুড়ে! কেবল বুক-পকেটে রাখা একটা নীল খাম চিঠি রেণু'কে দাঁড় করালো সদা চঞ্চল পরাগের নিথর দেহটার সামনে। এই প্রথম রেণু ডুকরে কেঁদে উঠল। জড়িয়ে ধরল পরাগের প্রাণহীণ দেহটাকে।

চিঠির কথা এবারও সংক্ষিপ্ত ছিল;

রেণু,
তোমাকে দেখিনা অনেকদিন, তবু তোমার মুখ প্রতিদিন স্বপ্নে দেখতে ভুল করিনা। তোমার চোখ আমার চাহনিকে তীক্ষ্ণ করে রোজ। তোমার মায়াময় মুখ আমাকে ক্ষীপ্র করে। আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি শক্রদের উপর তোমার কাছে সত্বর ফিরব বলে।

আমাদের বিজয় অতি সন্নিকটে।

আমি ফিরে আসছি তোমার কাছে...শীঘ্রই...

ইতি
পরাগ


***
রেণু'র চুলে এখন পাক ধরেছে, চোখে চশমা।

সে খুব একলাই থাকে। তাকে কোন সেমিনারে যায় না। কোন পদক বিতরণী অনুষ্ঠানে শহীদ স্ত্রী হিসেবে অশ্রুসজল চোখে তার কষ্টের কিংবা গর্বের দু'টো কথা ব্যক্ত করেনা। কেবল মাঝে মাঝে 'গীতাঞ্জলি'টা নাড়াচাড়া করে। 'গীতাঞ্জলি'র পাতায় পাতায় শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ পাপড়ি; আর কিছু নীল খাম চিঠি!

শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছোপ ছোপ দাগের মলিন নীল খাম জুড়ে পরাগ-রেণু'র ভাললাগা; পুরনো চিঠির ভাঁজ খুললেই ঝরে পড়ে এক বুক ভালবাসা...।

***

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৩১
৪৯টি মন্তব্য ৪৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×