somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিনের জন্মদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আজ ৩ রা ডিসেম্বর। মহান ভাষা-সংগ্রামী আব্দুল মতিনের জন্মদিবস। আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিলেন আব্দুল মতিন। ভাষা আন্দোলন ছাড়াও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ছিল অসামান্য অবদান। জন্মদিবস উপলক্ষে তাঁর প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি। আজ তুলে ধরছি তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী।


১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রাণশক্তি আব্দুল মতিন , যার ব্যাপক তৎপরতা, যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নানামুখী কার্যক্রম থেকে শুরু করে ছাত্রদেরকে উজ্জীবিত করা , ১৪৪ ধারা ভঙ্গসহ সাহসী ও বিচক্ষণ কর্মসূচীর মাধ্যমে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বাঙ্গালীর জাতিসত্তার লড়াই। এই প্রবাদপ্রতিম পুরুষ আব্দুল মতিন জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালি উপজেলার ধুবুলিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আব্দুল জলিল, মাতার নাম আমেনা খাতুন। ধুবুলিয়া গ্রামটি ছিল যমুনা নদীবেষ্টিত। ১৯৩০ সালে প্রমত্তা যমুনার সর্বগ্রাসী ভাঙ্গনে গ্রামটি বিলীন হয়ে যায়। তারপর আব্দুল জলিল তাঁর পরিবার সহ নাবালক সন্তানদের নিয়ে যমুনার বুকে জেগে ওঠা একটি চরের শৈলজনা নামক গ্রামে বসতভিটা গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে তিনি ভাগ্যান্বেষণে হিমালয়ের পাহাড়ি গাছগাছালীর শহর দার্জিলিঙে আসেন। এখানে ১৯৩০ এর দশকে জলা পাহাড়ের ক্যান্টনমেন্টে একটি চাকরি খুঁজে পান এবং ১৯৩২ সালে তিনি তাঁর পরিবারকে দার্জিলিঙে নিয়ে আসেন।
১৯৩২ সালে ছয় বছর বয়সে দার্জিলিঙের মহারাণী গার্লস হাইস্কুল নামের একটি বাংলা মাধ্যম স্কুলের শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে তিনি দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৩ সালে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক) পাস করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন এবং ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ব্যাচেলর অব আর্টসে ভর্তি হন এবং ফজলুল হক হলে সিট পান। ১৯৪৮ সালের ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার ভাষণে ‘উর্দু , কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ উচ্চারণ করলে আব্দুল মতিন দাঁড়িয়ে তীব্রভাবে তার প্রতিবাদ করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে দ্রুত পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের এক প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সচিবালয়ের কাছ থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে এবং দুই মাসের আটকাদেশ দিয়ে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করে। তবে জেলে যাওয়ার আগে তিনি কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য সরকার জেলারের মাধ্যমে শর্ত সাপেক্ষে আব্দুল মতিনকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেয়। শর্ত হল ভবিষ্যতে তিনি কখনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন না এই মুচলেকায় স্বাক্ষর দিতে হবে। আব্দুল মতিন সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তার দুমাস পর কারাগার থেকে মুক্তি পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আব্দুল মতিনকে তার কক্ষে দেকে পাঠান এবং একই ধরনের আরেকটি মুচলেকায় স্বাক্ষর করতে বলেন। এবারো আব্দুল মতিন তাতে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩ বছরের জন্য বহিষ্কার করে ।
১৯৫০ সালে রাষ্ট্রভাষা দিবসের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে ১১ মার্চ ক্যাম্পাসে আয়োজিত ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সমাবেশে আন্দোলনকে সংগঠিত এবং পরিচালনার জন্য আব্দুল মতিনকে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করলে উপস্থিত সাধারণ ছাত্রদের সিদ্ধান্তে তাঁকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আন্দোলনের কর্মসূচীর খরচ মেটানোর জন্য জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে ১৯৫১ সালের ৫ এপ্রিল পতাকা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী দিবসটি উদযাপনে তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে এবং এই কর্মসূচীর মধ্যমে তারা আশাতীত অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
১৯৫০-৫২ সালের মধ্যে আব্দুল মতিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচীকে জনপ্রিয় ও সফল করার লক্ষ্যে সারাদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটে বেড়িয়েছেন। ২৭ শে জানুয়ারি ১৯৫২ তে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় মুসলিম লীগের এক সভায় জিন্নাহর কথার প্রতিধ্বনি তুলে আবারো ঘোষণা করলেন – “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” নাজিমুদ্দিনের এই বক্তব্যের প্রতিবাদে তার পরেরদিন আব্দুল মতিন ও তাঁর সহযোগী ছাত্রবৃন্দ এক বিশাল প্রতিবাদ বিক্ষোভের আয়োজন করেন। ৩০ শে জানুয়ারি প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হয়। এটা মানুষকে বেশ প্রভাবিত করে।
১৯৫২ সালের ৩১ শে জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে দেশের অবিসাংবাদিত নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আহূত রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রনেতৃবৃন্দের সমাবেশে আলোচনা সভায় কাজি গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আব্দুল মতিন পরিষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক হিসেবে আব্দুল মতিন ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এক সমাবেশ আহ্বান করেন। সে সমাবেশ থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের ঘোষণাসহ একুশ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আব্দুল মতিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী এক কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এই কর্মসূচীর মধ্যে ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এসেম্বলি অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের কাছ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে স্বাক্ষর গ্রহণ করা। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিল না।
ছাত্রদের আন্দোলন কর্মসূচীকে প্রতিহত করতে সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করে। আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রকর্মীরা সরকারের ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে তাদের নির্ধারিত কর্মসূচী নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ২১ শে ফেব্রুয়ারির ঠিক আগে ২০ শে ফেব্রুয়ারি রাতে দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ ছাত্র নেতারা শহরের নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয়ে এক সভায় মিলিত হন। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মুসলিম লীগের অবিভক্ত বাংলার প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম। আব্দুল মতিন সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে দীর্ঘ বক্তব্য দেন এবং নানা যুক্তি হাজির করেন। সভায় উপস্থিত অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ ছিলেন নানা শঙ্কায় শঙ্কিত। ভাষার দাবি নিয়ে সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে দ্বিধা ছিল। সেসময় তাঁদের কাছে মাতৃভাষার মর্যাদার চেয়ে বড় চিন্তার বিষয় ছিল আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, আর এ কারণে তারা সরকারকে ঘাঁটাতে চাননি।
শেষপর্যন্ত বহু পাল্টা- পালটি তর্কবিতর্কের পর ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য সভায় ভোটাভুটি হয়। উপস্থিত ১৫ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন ভোট দেন ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের পক্ষে, বিপক্ষে ১১ জন। এধরনের সিদ্ধান্তের পর আব্দুল মতিন আবারো জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন এবং সভার সভাপতি রাজনীতিক আবুল হাশিমকে বোঝাতে সক্ষম হন যে আজকের সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় কোনও বিবৃতি দেয়া ঠিক হবে না বরং এটাকে দুটি মতামত হিসেবে গ্রহণ করা উচিৎ হবে। পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সমবেত সাধারণ ছাত্রদের উপর মতামত দুটির ভাগ্য নির্ধারণের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে শেষ রাতের দিকে সভার সমাপ্তি হয়।
পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ছাত্র সমাবেশে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত করার জন্য আব্দুল মতিন এবং তাঁর সহযোগীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। আগের সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ক্যাম্পাসে জড়ো হওয়া বিশাল ছাত্র সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার এবং আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে তাদের বক্তব্য ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। মতামত দুটি শোনার পর উপস্থিত ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে রায় দেয় এবং যে কোনও মূল্যে তা কার্যকর করার পক্ষে স্লোগান দিতে থাকে। আব্দুল মতিন পুরো ব্যাপারটীকে টেনে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সামনে নিয়ে এসে তাদের পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হওয়ায় তিনিসহ আন্দোলনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তে ১০জন করে ছাত্রদের কয়েকটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলা গেট থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। এসময় পুলিশ ছাত্রদের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং পরিশেষে গুলিবর্ষণ করে। শহীদ হন আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন, আব্দুল জব্বার সহ নাম না জানা আরও কেউ কেউ এবং অনেক মানুষ আহত হয়। গ্রেফতার হয় অসংখ্য ছাত্র।
সরকারের সকল নিষেধাজ্ঞা ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আব্দুল মতিন এবং তাঁর সহযোগীরা পুলিশের গুলিতে নিহতদের স্মরণে পরদিন এক গায়েবানা জানাযার আয়োজন করেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের তীব্র বিরোধিতা ও আপত্তি সত্ত্বেও গায়েবানা জানাযার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আব্দুল মতিনের স্বাক্ষরিত এক প্রচারপত্র বিলি করা হয়।
২২ শে ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাযা কর্মসূচী ঘোষণার ফলে সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরা কাজে যোগ না দিয়ে সেখান থেকে হাজারে হাজারে মিছিল করে সকাল ১০ টার মধ্যে আগের দিনের গুলির ঘটনাস্থল মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে জানাযায় সমবেত হন। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এই জানাযায় শরীক হন। একদিন আগে ২১ শে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ঐতিহাসিক জমায়েতে কেবল ছিল ছাত্র আর ২২ শে ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে নিহতদের গায়েবানা জানাযায় শরীক হওয়া অধিকাংশ মানুষ ছিলেন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীবৃন্দ। এই যথাযথ ও সময়োচিত কর্মসূচীর কারণে একদিন আগের ছাত্রদের বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন সারা বাংলার মানুষের ভাষার আন্দোলনে পরিণত হওয়ার পথ পেয়েছিলো।
২১ শে ফেব্রুয়ারি সম্ভব হয়েছিলো ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তের কারণে আর ২২ শে ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিলো গায়েবানা জানাজার সিদ্ধান্তের কারণে। আর এদুটো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির, যার নেতা ছিলেন আব্দুল মতিন।
জানাজা শেষে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ছাত্র জনতার বিশাল মিছিল বের হয়। মিছিলটি কার্জন হল পার হয়ে হাইকোর্টের মোড়ে পৌঁছলে পুলিশ আবারো গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু জনমানুষের প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে এবং বেলা ১২ টার দিকে পুরনো ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় এবং প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত এই বিক্ষোভ চলে। সেই পর্যায়ে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে এবং বিভিন্ন ঘটনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটতে থাকে। শহরে ১৪৪ ধারা জারি থাকার পরও কেউ যেমন তা মানছিল না তেমনি কোনও ভয়েও ভীত ছিল না। ধর্মঘট, বিক্ষোভ এবং মিছিল সব স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়ে চলছিলো। পরিস্থিতি রীতিমতো এক গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছাত্রজনতার উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এই ২২ শে ফেব্রুয়ারি আব্দুস সালাম, শফিউর রহমান, আব্দুল আউয়াল (রিক্সা চালক) এবং অহিউল্লাহ (কিশোর) শহীদ হন। আহত হন অসংখ্য। ২২ শে ফেব্রুয়ারি সরকার একসাথে ১০ জনের নামে হুলিয়া জারি করে। এঁদের মধ্যে আব্দুল মতিন ছাড়াও ছিলেন মওলানা ভাসানী, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, মোহাম্মাদ তোয়াহা , শামসুল হক, খালেক নেওয়াজ, খান, সৈয়দ নুরুল আলম, আজিজ আহম্মদ এবং আব্দুল আউয়াল। হুলিয়া ঘোষিত হলেও আব্দুল মতিন একটুও দমেননি। আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি সারা দেশে আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ইশতেহার প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।
২৩ শে ফেব্রুয়ারি কারফিউ থাকা সত্বেও সারা রাত ধরে মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। শহীদ মিনারটীর নকশা অঙ্কন করেছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র আরেক ভাষা সংগ্রামী সাঈদ হায়দার। উল্লেখ করা যেতে পারে যে মেডিক্যাল কলেজে তখন একটা নির্মাণ কাজ চলছিলো। ছাত্রদের অনুরোধে ভাষা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল দুজন কন্ট্রাক্টর ইট, সিমেন্ট, রড ও শ্রমিক দিতে সম্মত হন।
১০ / ১২ জন রাজমিস্ত্রি ছাত্রদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় রাতের মধ্যে শহীদ মিনার তৈরি করে ফেলেন। ২৪ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়। ২২ শে ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ থেকে ইস্তফা দেয়া দৈনিক আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। এই স্মৃতিসৌধের নীচে একটি চাদর পেতে দেয়া হয়েছিলো – সেটাতে মানুষ টাকা-পয়সা দিয়েছিলো, মহিলারা তাদের গায়ের গহনা পর্যন্ত খুলে দিয়েছিলো। এই শহীদ মিনার নির্মাণসহ পুরো প্রক্রিয়ার সাথে আব্দুল মতিন সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, এমনকি নিজে ইট- বালি বহনও করেছিলেন। পাকিস্তানীরা এই শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিতে মোটেও দেরী করেনি। এর কিছুদিনের মধ্যেই আব্দুল মতিনসহ আরও কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হন।
গ্রেফতার হয়ে জেলে যাবার পর আব্দুল মতিন জেলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সংস্পর্শে আসেন এবং তিনি মার্ক্সবাদী আদর্শ ও রাজনীতির সাথে পরিচিত হন। জেল থেকে বেরিয়ে ১৯৫৩ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেন এবং সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য, ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৫২ সালে গঠিত হয়। আব্দুল মতিন কৃষক সংগঠনে কাজ করতে চেয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নে সভাপতির দায়িত্ব পালনের কোনও ইচ্ছা তাঁর না থাকলেও পার্টির সিদ্ধান্তের কারণে তিনি ঐ দায়িত্ব নেন। ১৯৫৩ সালে ২৯শে ডিসেম্বর করাচীতে ‘অল পাকিস্তান স্টুডেন্টস কনফারেন্স’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল মতিন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন এবং বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনে তাঁর বক্তৃতায় তিনি প্রধানত তিনটি দাবি উত্থাপন করেন – ১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হোক, ২. পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেয়া হোক এবং ৩. উপরোক্ত দুটো দাবি বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম লীগ শাসনের পরিবর্তন করে একটি গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা হোক। বলা বাহুল্য, এতে সম্মেলনে বিরাট হট্টগোল সৃষ্টি হয় যার ফলে সম্মেলনের সভাপতি সভা মুলতবী ঘোষণা করেন। এভাবে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন একেবারে ছাত্রজীবন থেকেই দেশ ও মানুষের স্বার্থের ব্যাপারে স্পর্ধিত চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়ে এসেছেন। ছাত্র ইউনিয়নে এক বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি কৃষক সংগঠনে কাজ শুরু করেন।
আব্দুল মতিন ১৯৫৩ সালে নভেম্বর মাসে প্রার্থীসভা এবং ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি পাবনা জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন। ঐ বছরই তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে পড়ে। মনি সিংহ – খোকা রায়ের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী এবং সুখেন্দু দস্তিদার , মোহাম্মদ তোয়াহা ও আব্দুল হক এর নেতৃত্বে পিকিংপন্থী অর্থাৎ চীনপন্থী ধারায় বিভক্ত হয়। আব্দুল মতিন পিকিংপন্থী ধারার সাথে সম্পর্কযুক্ত হন।
১৯৬৩ সালে ঢাকার ঢাকার রায়পুরায় পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, হাতেম আলী খান সাধারণ সম্পাদক এবং আব্দুল মতিন সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে অক্টোবরে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ( এম – এল ) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। এই পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমেদ, দেবেন শিকদার ও আবুল বাশার। ১৯৬৯ সালে পার্টির সাধারণ সম্পাদক দেবেন শিকদার গ্রেফতার হওয়ার পর আব্দুল মতিন পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৭১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত পার্টির সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্বে ছিলেন। ’৭১ এর ১৬ জুলাই পাবনার শাহপুরে পার্টি প্লেনামে চারু মজুমদারের লাইন গৃহীত হলে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন এবং পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দেন।
১৯৭১ সালে আব্দুল মতিন ও আলাউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে কৃষক- শ্রমিক ও ছাত্রজনতাকে সংগঠিত করে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি দেশের অভ্যন্তর থেকে জনগনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। আগে থেকেই তাঁদের প্রস্তুতি ছিল। লালটুপি সম্মেলনের সমসাময়িক আব্দুল মতিন ও আলাউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়েছিলো। এই বাহিনী দিয়ে তাঁরা পাবনা – সিরাজগঞ্জ এলাকায় সহস্রাধিক গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়ে গণফৌজ গঠন করেন। ২৫ শে মার্চ পাকিস্তান আর্মির ক্র্যাকডাউনের দুদিন পর ২৭ শে মার্চ গণফৌজের সদস্যরা পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালায়। সে হামলায় ২৯ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। পরে গণফৌজের নেতৃত্বে জনসাধারণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাবনা শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন যুদ্ধে প্রায় দুইশ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে কমরেড আব্দুল মতিন পার্টিতে যে মতামত দেন তা হলো – যারা কৃষক ও খেতমজুরদের সন্তান তাদের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরী। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে সহজে দেশকে শত্রুমুক্ত করা সম্ভব হবে। অনেক কৃষক ও খেতমজুর গণফৌজে যোগ দিয়েছিলো। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পাবনার বেড়ার ডাববাগান নামক স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে গণফৌজের আরেকটি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ৫-৭ জন ই পি আর গণফৌজের সাথে যোগ দেয় এবং বেশ কিছু পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়। ১৮০ টি গ্রাম ছিল গণ ফৌজের মুক্ত এলাকা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণফৌজের নীতি ছিল সেন্ট্রাল গেরিলা স্কট ও স্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গেরিলা স্কট গঠন করা।
একাত্তরে আব্দুল মতিনের বীরত্বপূর্ণ ভুমিকার কারণে রাজাকার ও পাকিস্তানী বাহিনী তাঁর পরিবারের উপর নির্মম নির্যাতন করে। হামলা চালিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি তারা পুড়িয়ে দেয়া হয়। ’৭১ এর সেপ্টেম্বরে তাঁর পিতা পাবনার নগরবাড়িতে রাজাকার ও পাকবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন। তাঁর এক ভাই গোলাম হোসেন মনু পাক সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে আহত হন, পরে তাঁকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর অপর এক ভাই সিরাজগঞ্জ কলেজের ছাত্র আব্দুল গাফফার স্বাধীনতা পরবর্তীতে রক্ষীবাহিনীর হাতে নিহত হন।
’৭১এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিকের আশা – আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটে নি, ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হয় নি। স্বাধীনতার পর ভারতীয় আধিপত্যবাদের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় এসে দেশে ব্যাপক লুটপাট ও নির্যাতন শুরু করে। তিনি চরমপন্থা গ্রহণ করেন। কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেন এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের জুনে আত্রাই যুদ্ধে আব্দুল মতিন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি মুক্তি পান। পরে তিনি চারু মজুমদারের লাইন ভুল বুঝতে পেরে সেখান থেকে সরে এসে গণতান্ত্রিক পথে রাজনীতি করা শুরু করেন।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি আবারো পার্টির সাথে যুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) এবং বাংলাদেশের মার্ক্সবাদী – লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট লীগ গঠিত হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ চাষি সমিতি গঠিত হয়। এই চাষি সমিতির সভাপতি ছিলেন আব্দুল মতিন। ১৯৮১ সালে কৃষক সংগ্রাম সমিতি, চাষি সমিতি ও কৃষক ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে পাবনার বেড়ায় কৃষক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কৃষক সমাবেশে সারাদেশ থেকে প্রায় অর্ধলক্ষ কৃষক জনতা সমবেত হয়েছিলো। কৃষক মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে ৪টি কৃষক সংগঠন একীভূত হয়ে জাতীয় কৃষক সমিতি গঠিত হয় যার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন আব্দুল মতিন এবং ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি সভাপতি পদে ছিলেন।
১৯৮৪ সালে আব্দুল মতিন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন সফর করেন এবং ২০০২ সালে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন।
১৯৮২ সালে কমিউনিস্ট লীগ (এম-এল) এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ গঠিত হয়। পরবর্তীতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ ও সাম্যবাদী দল (বাদশা-মানিক) ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ গঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টি (অমল-নজরুল) ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ গঠিত হয়। এবং সর্বশেষ ১৯৯২ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ , ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দল (আলী আব্বাস) ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠিত হয়। ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিন ঐক্যের প্রক্রিয়ায় গঠিত পার্টি সমূহের কেন্দ্রীয় কমিটির এবং পলিটব্যুরোর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে ওপেন হার্ট সার্জারির পর থেকে শারীরিক কারণে তাঁর পক্ষে রাজনীতিতে আগের মতো সক্রিয় ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিলনা । ইতিমধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক লাইন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ২০০৯ সালে হায়দার আকবর খান রনো , অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার ও আজিজুর রহমান এর নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টির একাংশ বের হয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি পুনর্গঠিত করলে তিনি সেখানে যোগ দেন। পরে হায়দার আকবর খান রনো পুনর্গঠিত ওয়ার্কার্স পার্টি ত্যাগ করে সিপিবিতে যোগ দিয়েছেন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠিত) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ গঠন করে। ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিন এই পার্টির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। আমৃত্যু তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। শারীরিক কারণে দীর্ঘদিন তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেন নি। মনে-প্রাণে তিনি কমিউনিস্ট আদর্শ ধারন করতেন। কমিউনিস্ট রাজনীতি গ্রহণ করার পর তিনি মনে করেছিলেন যে কেবল মাত্র কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ মুক্তি পেতে পারে। সেই দর্শন ও আদর্শে অবিচল ছিলেন আজীবন।
ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন বার্ধক্য জনিত দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ২০১৪ সালের ১৮ আগস্ট মস্তিস্কের রক্তক্ষরণজনিত কারণে অসুস্থ হলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯ শে আগস্ট তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আই সি ইউ তে স্থানান্তর করা হয়। ২০ শে আগস্ট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মস্তিষ্কের জমাট রক্ত অপসারণ করা হয় এবং তারপর তিনি আই সি ইউ তেই ছিলেন। ১ অক্টোবর থেকে তাঁর শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে ও ক্রমাগত তাঁর স্বাস্থের অবনতি ঘটতে থাকে। ৩ রা অক্টোবর তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয় এবং ৮ ই অক্টোবর ৮৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর মরদেহ ৯ অক্টোবর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয় । এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
তথ্য সুত্র ঃ ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিনের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ প্রকাশিত বিশেষ বুলেটিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০৮
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×