প্রসারিত জমি জুড়ে, ইটসুরকি এবং রাস্তার আলোর মাঝামাঝি জায়গায়, তবে গ্রামাঞ্চলের খোলা বিস্তৃতির আগে, একটি একাকী একতলা বাস একটি রাস্তা ধরে ভ্রমণ করছিল। সারাদিন বাসটি তার নির্দিষ্ট যাত্রাপথ দিয়েই অগ্রসর হয়েছে এবং এই সমস্ত সময়ে, বাসটি কখনই তার পূর্ণ ধারণক্ষমতা মুড়িরটিনের মত একবারও ছিল না। এমন নয় যে এখানে প্রতিটা মানুষের নিজস্ব গাড়িঘোড়াপরিবহন আছে। কিন্তু আজকাল ভ্রমণে মানুষের আগ্রহ কম। শিল্পে আরেকটি জাল বিপ্লব জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারখানা এবং শিল্প এলাকায় যাতায়াতের দিন শেষ। এখন সবাই তাদের সঙ্কুচিত অজুহাতের জন্য ঘরের আরাম থেকে কাজ করে। তবু বাস চলে। তারপরও বাস কোম্পানিগুলো টেবিল থেকে বর্জিতাংশ নিয়ে জামিন পেতে থাকে। আংশিকভাবে জনসাধারণের অনুভূতির বাইরে, বেশিরভাগই একজন মন্ত্রীর নিষ্ঠুর রসিকতার কারণে, যে কিনা কয়েক দশক ধরে বাসে ভ্রমণ করেননি, তবুও বাসভ্রমণের ধারণাটা উপভোগ করেছেন বরাবর। এটা ছিল মন্ত্রীর নিজস্ব উপায়ে মানুষকে তাদের জায়গায় রাখা। তৃতীয় প্রজন্মের ধাতব বাক্সের মধ্যে লোকেদের আবদ্ধ রাখা, যাতে মন্ত্রী তার চালক চালিত বিশাল লিমোগাড়িতে তাদের অতিক্রম করে যেতে পারেন। কিন্তু রাস্তার জায়গা ভাগাভাগি করে নেওয়ার মত আর কোনও কিছু ছিল না, ছিল না অন্য কোনও গাড়ি বা মোটরসাইকেল। শেষবারের মত পরিসীমা আবর্তনকারী শুধু একটি বাস। বাইরের চারপাশে আলো নিভে যাওয়ায় এই বাস ছাড়া রাস্তায় এখন আর কিছুই নেই। নম্বর '৭৮৬'। এটি সাধারণত ৬৬৬ নম্বর ছিল, কিন্তু "নয়-ছয়" যোগ করা হয়েছে, ন্যূনতম খরচে, দেখাতে যে বাসটির তিনটি এলাকা বা বলয়ে চলাচলের অনুমতি রয়েছে। বাসটি যারা যাতায়াত করতে দেখেছে এমন কেউ তো দূরের কথা, কিছু লোকের যাদের বাসটার কাছে জিম্মি-যাত্রী হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না, তারাও কেউ প্রশ্ন করেননি কেন বাসটার নম্বর বদলালো তার আসল কারণ। বেশিরভাগই শুধুমাত্র অভিহিত মূল্যে গৃহীত, অঞ্চলগুলির মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে সক্ষম হওয়াটাকেই বড় করে দেখলো। আসল কারণটা ছিল আরও অন্ধকার। "নম্বরগুলি" অভিজাত শয়তানী সংগঠনের ছাড়পত্র হিসাবে যোগ করা যা সফলভাবে এতদিনে দেশটা দখল করে ফেলেছে। যদিও দেশের নিম্নবিত্ত, সাধারণ মানুষ সংবাদপত্রে পড়া অপরাধের দ্বারা বিভ্রান্ত, যশস্বী ব্যক্তিদের দ্বারা তারা তাদের দেখার-পর্দায় চমকে ওঠে এবং প্রবর্তিত ও অন্যায়ভাবে বৃদ্ধি করা কর তাদের পঙ্গু করে দেয়। "নম্বর" আসলে কী প্রতিনিধিত্ব করে তা নিয়ে প্রশ্ন বা বিশ্লেষণ করার সময় ছিল না। এটা কি ভিনদেশী চাল? ব্যক্তিগত রসিকতা? কোনো ব্যাপার না! টাকা-জীবিকা, অপরাধ, টেলিভিশনে সুন্দর মানুষ। অপরাধ, টেলিভিশনে সুন্দর মানুষ, টাকা-জীবিকা। টেলিভিশন, টাকা-জীবিকা এবং অপরাধ সুন্দর মানুষ। ওহ এবং ভ্রমণ। (মানে, কারো কারো জন্য) সেখানে ভ্রমণও ছিল। এই মুহূর্তে মনোনীত গণযানবাহন "৭৮৬"-এ, দিনের শেষ যাত্রা শেষের দিকে, গাড়ির ভিতরে মাত্র চারজন। স্বাভাবিকভাবেই, বাসের একজন চালক আছে। রাস্তার অন্য সব কিছুই দীর্ঘদিন ধরে স্বয়ংক্রিয়, কিন্তু শ্রমিক ইউনিয়নের বিরোধ, ক্ষোভ এবং জীবিকা নিয়ে অভিযোগের পরে, কয়েক হাজার বাস চালকের চাকরি রক্ষা করা হয়। এই খাতে অর্থপ্রদান করতে তেমন কেউই আপত্তি করেননি কারণ এটি "টাকা-জীবিকা, অপরাধ এবং টেলিভিশনে সুন্দর লোকদের" খাদ্যচক্রের উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। বাসচালকরা তাদের চাকরি রাখতে পেরেছে এই শর্তে যে, পরিদর্শকরা তাদের অনেক বেশি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। এবং বাসটি প্রায় খালি থাকা সত্ত্বেও, বাসটি যাত্রার প্রায় শেষের দিকে থাকা সত্ত্বেও, "৭৮৬" এর ড্রাইভারকে গত কয়েক ঘন্টা ধরে একজন পরিদর্শক একটানা দেখে যাচ্ছে। এছাড়াও বাসে দুজন আন্তঃসংযোগহীন যাত্রী ছিল। একজন মার্জিত পোশাক পরা, এবং মুখে একটি বড় হাসি নিয়ে সেখানে বসা। যেন বাইরের অন্ধকার এবং বাসের আলো এবং বাসের বাইরে ঢালাই রাস্তার উপর আলোর প্রতিফলনের প্রশংসা করছে। বাস ইন্সপেক্টর বা পরিদর্শকের এতসমস্ত যাচাই-বাছাইয়ের পরেও, কেউ মনে করতে পারছে না যে এই যাত্রী কোথা থেকে বাসে উঠেছিল এবং কতক্ষণ ধরে ভ্রমণ করেছে। অন্য যাত্রীটার পোশাক দেখে কম বুদ্ধিমত্তার মনে হয়, ঠিক পুরনো বা অর্ধেক নষ্ট অথবা ময়লা পোশাক নয়, তবে পিছনের দিকে তীক্ষ্ণ জ্বালাময়ী পোশাক পরা যাত্রীটার ধারেকাছেরও না। অন্য যাত্রী একটা সংবাদপত্রে নিমগ্ন এবং বাসটি প্রায় উল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়ে বিপথে চলা শুরু করলেও সেটা থেকে চোখ সরিয়ে নেয়নি। যতই পাতা উল্টাচ্ছে ততই তার চোখ বিস্ময়ে ভরা, যেন এই প্রথম সে কোনো খবরের কাগজ পড়লো। তথ্য হিসাবে সংবাদপত্র যা কিছুকেই ছাড়পত্র দিচ্ছে সেসবের সবকিছুর উপরেই তার সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস যেন। অন্য সকলের উপাসনা সেই তিনটি বিষয়চক্রের আনুষঙ্গিক অংশসমূহকে সম্পূর্ণ করার জন্য সংবাদপত্রের শুধুমাত্র 'টাকা-জীবিকা' সংক্রান্ত খবরগুলিই অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন ছিল। তিনি আবার পৃষ্ঠা উল্টালেন এবং তার চোখ প্রশস্ত হয়ে গেল একটি গল্পের উপর যা আসলে এই কাগজে প্রকাশিত সর্বোচ্চ সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি কিছুএকটা। বাসের সামনের দিকটায়, স্টিয়ারিং-এ দুই হাত রেখে, বাসের চালক সামনের দিকে দেখছিল। তার একাগ্রতার কৃপণতা ও সেটা থেকে উদ্ভব হওয়া উদ্বেগ বাস পরিদর্শকের প্রতি তার নিছক অবজ্ঞার উপরে মুখোশ হয়ে থাকলো। তাকে একজন মহিলাই কেন হতে হবে! আর উপরন্তু, তাকে অপমানিত করার জন্য তারচেয়েও ১৭ বছরের ছোট এক নারীকেই কেন হতে হবে! বাসটার যৌলুসপূর্ণ দিন চলে যাওয়া সত্ত্বেও বাসের অবস্থা এখনও রাস্তাটার মত এত বেহাল দশা না। এটি এখনও আরো একবার পরিদর্শনের মেয়াদ পর্যন্ত অনুমোদিত। এবং কয়েক দশক ধরে রাস্তাঘাট-সড়কগুলি সবচে কম ব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও গভীর রাতেই বাস চালকদের পরিদর্শন করাটা অতিগুরুত্বপূর্ণ। চিরকালই যেসময়টাতে যাত্রী কম। এগুলোই করদাতাদের টাকা খরচের খাত। যখন সম্পদ জমা হচ্ছে না শয়তানীভরা অভিজাতদের দ্বারা, যাদের কখনই এইসব সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্নের মত ধ্বংসাবশেষ-বাসে মৃতপ্রায় ভ্রমণ করতে দেখা যাবে না। পরিদর্শক মহিলা চালকের দিকে কী একটা অভিপ্রায়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। 'বাসের টিকিট ছাপার যন্ত্রটাতে কাগজ ভরতে গড়পড়তায় যা প্রয়োজন হয় তারচেয়ে বেশি সময় নেওয়ার জন্য' ইতিমধ্যেই বাসচালককে সে একবার জরিমানা করেছে। এবং তারপর 'কাগজ পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তাটাই বা কেন হবে' এই কারণেও আরেকবার তাকে জরিমানা করলো। কারণ তার ক্ষমতা। তার লালচে ছোট করে ছাটা চুলের নীচে থাকা মুখটা অস্ফুটভাবে ঠান্ডা। সে দেখতে পাচ্ছে যে তার হস্তক্ষেপ চালককে বিরক্ত করছে, কিন্তু তারপরও চালকের মাথা গরম না করা এবং একইসাথে পরীক্ষাটাকে আরও অপমানজনক করে তোলার সমন্বিত পেশাদারিত্বে সে অবাক । সে সংক্ষিপ্তভাবে চালকের দলিলনথিকাগজপত্র ঘেঁটে দেখলো। পঞ্চাশোর্ধ এক ফর্সা পুরুষ। বিবাহবিচ্ছেদ, এবং তার পিছনে একটি চিত্তাকর্ষক কর্মজীবন, বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে। একজন ভাস্কর, যিনি একটি স্বনামধন্য চারুকলা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন, তারপর কয়েক বছর বিদেশে সাংবাদিকতা কাজ, একটি নিজস্ব দোকান চালান এক বছর, তারপর একজন চিত্রশিল্পী এবং ডেকোরেটর, এসবই বাস ড্রাইভার হিসাবে কাজ করার আগের কথা। বাসপরিদর্শক অন্তত তার বহুমুখিতা দেখে মুগ্ধ হয়, কিন্তু এটাও জানে যে তার সমস্ত কীর্তিকলাপ ব্যর্থতায় এসে শেষ হয়েছে। পরিদর্শক বুঝতে পারছে যে, এই সিদ্ধান্তমূলক মতামতটা সহজেই তার নিজের জন্যও প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভেবেই একটা ঠাণ্ডা, ফাঁপা অনুভূতি তার শরীর দিয়ে বয়ে গেল। সে যা কিছু অধ্যয়ন করেছে তা কি মিথ্যা? সে কি কয়েক দশক পরের নিজের দিকেই তাকিয়ে আছে? মালিক কর্তৃপক্ষ যখন অন্যকারো জন্য তাকে বাদ দেবে? সমস্ত অনুপ্রাণিত শিক্ষাগুলি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে এতক্ষণে। সে তার ইলেকট্রনিক নোটবইটা মেঝেতে ফেলে দিল। স্ক্রিনটা ভেঙে গেল, এবং ভাঙাটা আরো নিশ্চিত করার জন্য সে তার জুতা দিয়ে বারবার যন্ত্রটা পদদলিত করলো। এই কর্মকান্ডটা বাসের সকলেরই নজর কেড়েছে। চালক বাসের গতি কমিয়ে পরিদর্শকের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। আর বাসের সামনের যাত্রী তাকালো তার খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে, সতর্ক দৃষ্টিতে । এবং বাসের পিছনের সুসজ্জিত যাত্রী জানালার প্রতিফলনে নিজেকে দেখার আত্মপ্রেম থামিয়ে, মহিলাটির দিকে প্রথমবারের মতো পুরো মনোযোগ দিল। চালকের সহ্যসীমা আর নিতে না পেরে রাস্তার একপাশে গাড়িটিকে থামিয়ে দেয়। সবাই চুপচাপ, একমাত্র শব্দ ছিল বাসটার ইঞ্জিন-মোটরের। চালকের জানা ছিল যে এমন কারণে বাস থামানো একটি অপরাধ। কিন্তু মুহূর্তটি যথাযথ বলে মনে হচ্ছে। পরিদর্শকের হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালকের চোখ থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। যদি বিদ্রোহের সেই কাজটি আঁকড়ে ধরা এবং প্রসারিত করা না হয়, তবে সবকিছুই নিষ্ফল। "এ তো আমি নই!" বাসচালক ভাবলো, বারবার, যতক্ষণ না মুখ থেকে শব্দগুলো বেরিয়ে এলো। আর সে আদলেই এক বিশাল সত্য। জীবনের কঠিন বাস্তবতাভারাক্রান্ত, আবার সমান্তরালে পড়াশোনা-শয়তানী-ভরা-দুরন্ত, দিনগুলোতে তো এমন পরিকল্পনা করা হয় নি। গৃহহীন হওয়ার ভয়ে সে তার উপর চাপিয়ে দেয়া ভারপ্রাপ্ত আপোস মেনে নিতে প্রস্তুত না আর। আর এখন তার সঞ্চিত প্রতিটি ক্ষুদ্র জিনিস ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এরপর বাসটি এগিয়ে চললো, তবে নির্ধারিত যাত্রাপথের থেকে ভিন্নদিকে। বাসটি প্রায় উল্টে যাওয়ার উপক্রম কারণ এখন এক উত্তেজিত জনতা-যাত্রী চালকের আসনে, যে কিনা একই সাথে একটা সংবাদপত্র পড়া এবং চালানোর অভিজ্ঞতাহীন একটি বাহনের দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত করে। তার পাশে, আসল চালক তাকে নির্দেশনা দিচ্ছে, তাকে বলে দিচ্ছে কিভাবে ঠিককরে স্টিয়ারিং ধরতে এবং গতি বদলাতে হয়। এবং বাসের পিছনে, মার্জিত-সুসজ্জিত জামাকাপড় এবং পরিদর্শকের উর্দি আসনে অযত্নে ঢেকে রাখা হয়েছিল, কারণ পরিদর্শক আর পূর্বে বর্ণিত ছিমছাম পোশাক পরা যাত্রী একে অপরের প্রতি তীব্র এবং হিংস্র কী একটা অভিপ্রায় যেন প্রকাশ করছে। বাসটি এলাকার এখতিয়ার বা অভিজাত ব্যক্তিদের, যারা এইসব চাপিয়ে দিয়েছে, তাদের প্রতি কোন সম্মান না দেখেয়েই এগিয়ে চললো। জীবনের জন্য আর পালানো নয়, স্বপ্নে পৌঁছাতে এগিয়ে যাওয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২২ সকাল ৮:৫২