somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অসংগতি

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানুষের জীবন কত বিচিত্র হতে পারে ! মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও সে পায়না মানুষের স্বাদ । অপূর্ণ থেকে যায় তার জীবনের বড় পাওনাগুলো । এমন মানুষ জগতে অসংখ্য । কিন্তু আমরা কি কখনো মানুষ হয়ে মানুষের দুঃখ বুঝার চেষ্টা করেছি ? কখনো কি সেই দুঃখকাতর মানুষগুলোকে স্নেহের বন্ধনে বেঁধেছি ?...না, বাঁধিনি । কারণ, আমরা মানুষ জাতি স্বার্থপর । এই সমাজ স্বার্থপর । স্বার্থপরতার জন্য মা-বাবা তার সন্তানকে দূরে ঠেলে দেয়, এক সহোদর আর এক সহোদরকে অস্বীকার করে ।
জীবনের এমন কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন আমি স্তব্দ হয়ে গিয়েছিলাম । যে বাস্তবতার কথা আগে কখনো কল্পনাতেও আসেনি । সেদিন আমার সমস্ত স্বত্তা শুধু একই ধ্বনি উচ্চারণ করেছিল, “বিধাতা, এ তোমার কেমন খেলা ?”
আমি তখন মাত্র এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ করেছি । পড়াশুনা থেকে ক্ষণকালের মুক্তির স্বাদ উপভোগ করার জন্য, আমার মেজু ভাইয়ের কর্মস্থল ঢাকায় তার বাসাতে চলে এসেছি । মেজু ভাই তখন অবিবাহিত ছিল । তাই তার বাসাটা ছিল পুরোপুরি খালি । তার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির তরফ থেকে ৫০% ভাড়া পরিশোধ করা ফ্ল্যাটটি ছিল চমৎকার । ঢাকার মত জনাকীর্ণ শহরে এমন নিরিবিলি বাসা পাওয়াটা সত্যি দুষ্প্রাপ্য । কিন্তু গ্রামের মুক্ত পরিবেশ রেখে এখানে এসে আমার দম দুই দিনেই প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল । প্রতিদিন সকালে উঠেই মেজুভাই অফিসে ছুটে । ফিরে আসে রাত দশটা নাগাদ । মাঝখানের এই সময়টা আমার কাটে শুধু বাসায় বসে বসে হলিউড-বলিউডের ছবি দেখে । মেজু ভাইয়ের নির্দেশে বাসার বাইরে বের হওয়াটাও আমার জন্য নিষেদ । সকালে বুয়া এসে রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায়, দুপুরে তাই খাই । আর রাতে মেজু ভাই ফেরার পথে রেডি-ফুড কিনে বাসায় ফিরে ।
একদিন মেজুভাই অফিস থেকে ফোন করে জানাল যে, সে অফিসের কি একটা কাজে ঢাকার বাইরে গেছে, আজ রাতে বাসায় ফিরবেনা । তাই তার অফিসের এক পিয়নকে খাবার দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছে । পিয়নটি নাকি আজ রাতে বাসায় থাকবে ।
আমি বসে বসে টিভি দেখছিলাম । রাত ন’টা নাগাদ বাসার কলিংবেল বেজে উঠল । আমি দরজা খুলে প্রথমে একটু আশ্চর্য হলাম । কেননা আমি ভেবেছিলাম পিয়নটি নিশ্চয় কোন গুফওয়ালা, কর্কশ মুখশ্রীর লোক হবে । কিন্তু আমার পূর্ব-ধারনাকে মিথ্যা প্রমানিত করে অল্প বয়সের, কোমলকণ্ঠের তরুন পিয়নটি সালাম জানাল । আমি সালাম নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । পিয়নটি প্রবেশের অনুমতির অপেক্ষা না করেই রুমের ভিতরে ঢুকে টেবিলের উপর খাবার রেখে গড়গড় করে বলে চলল- আমার নাম রহমত । বাড়ি সিরাজগঞ্জ । আপনার ভাই যে অফিসে চাকরি করে, সেই অফিসেই পিয়নের চাকরি করি । আপনার ভাই, মানে আমার বস খুব দয়ালু লোক । কয়েকবার করে আমার চাকরি প্রায় চলে গিয়েছিল । বসের দয়ায় এখনো টিকে আছি ।
আমার আকস্মিকতা যখন কাটল ততক্ষণে তরুনটির প্রতি আমার কেন যেন একটা মায়া পরে গেছে । কিন্তু আমার একটু অস্বস্থি লাগছে এজন্যই যে, তার আচার-আচরণ, হাটার ধরন কেমন যেন অনেকটা মেয়ে মানুষের মত এবং শুরু থেকেই সে আমাকে আপনি করে সম্ভোধন করছে । আমাকে আমার সমবয়সী বা বড় কেউ আপনি করে ডাকলে খুব অস্বস্থি বোধ হয় ।
আমি বললাম, রহমত ভাই, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন । কারণ আমি আপনার বয়সে ছোট ।
রহমত ভাই প্রতিউত্তরে বলল, না- তা কেমন করে হয়? আপনি হলেন আমার বসের ছোট ভাই । আমি কি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি ?
আমি আর কথা বাড়ালাম না । শুধু ভাবতে লাগলাম একটা সামান্য পিয়ন এত সুন্দর করে, শুদ্ধ করে কথা বলতে পারে !!! নিশ্চয় সে কোন ভদ্র ঘরের সন্তান । ভাগ্যচক্রে আজ এখানে পিয়নের চাকরি করতে হচ্ছে ।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রহমত ভাই আর আমি একসাথে বসে টিভি দেখতে বসলাম । এতদিন একা একা খুব বোরিং লাগছিল । আজ আমার প্রায় সমবয়সী একজনকে পেয়ে জমিয়ে আড্ডা দিলাম । আমিও খুব আড্ডাবাজ ছেলে আর রহমত ভাইকেও মনে হল খুব রসিক এবং মজার লোক । অনেকক্ষণ আড্ডা মেরে আমি রুমে শুতে গেলাম । আর রহমত ভাইও গেস্ট রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল । শুবার পরপরি আমি একেবারে ঘুমের স্বর্গরাজ্যে চলে গেলাম ।
হঠাৎ ঘুমের মাঝখানে আমার দেহে হালকা কোমল হাতের স্পর্শ পেলাম । প্রথমে মনে হল যে, এটা স্বপ্নের কোন ব্যাপার । কিন্তু ঘন ঘন হাতের ছোঁয়ায় পরক্ষনেই বুঝতে পারলাম, এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব । ভয়ে হকচকিয়ে উঠে আমি টেবিল ল্যাম্প জ্বালালাম । লাইট জ্বালিয়েই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম । আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা । মনে মনে আমি স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করছিলাম । আমি দেখি যে, রহমত ভাই আমার বিছানায় আমারই পাশে আধাশুয়া অবস্থায় চরম উত্তেজনায় কাঁপছে । এই অবস্থা দেখে আমার ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল ।
আমি ভিতকন্ঠে জিজ্ঞাস করলাম, রহমত ভাই, আপনি আমার বিছানায় কেন ?
রহমত ভাই অপ্রকৃতস্থভাবে কিছুক্ষণ নীরব থেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । আমি কিছুই বুঝতে পারলামনা । শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । কিন্তু এইটুকু উপলব্ধি করতে পারলাম যে, এই কান্না এক অর্থবহ দুঃখের কান্না ।
রহমত ভাই আদ্রচোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমকে মাফ করে দিন । আমি আসলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলামনা । আমার এই দেহটার কারনে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে ।
আমি বললাম, কেন ? আপনি এমন করছেন কেন ?
রহমত ভাই নির্লিপ্তভাবে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, আমি হিজড়া ।
কথাটা শোনামাত্রই আমার কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করছিল । রহমত ভাইকে নিজের স্বজাতি মনে হচ্ছিলনা । মনে হচ্ছিল অচেনা ভিনগ্রহের কোন প্রানি । কথাটা যে আগে কখনো শুনিনি তা নয় । কিন্তু আমার সামনে হিজড়া শব্দটা আজ যেন তার দৈহিক কাঠামো নিয়ে জীবন্ত আস্ফালন করছে । আমি বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম ।
আমি রহমত ভাইয়ের দিকে তাকাতে পারছিলামনা । বুঝতে পারছিলাম তার বুকের ভিতরটা অনুশোচনায় পুড়ছে । আমি শুধু কষ্ট করে বললাম, তাহলে আপনি এই অফিসে কি করে চাকরি করেন ?
আমার কথার পর বেশ কিছুক্ষন নিরবতা । রহমত ভাই নিজের কষ্টের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে তার কান্নার সব বাঁধ ভেঙ্গে গেছে । তাই নিজেকে সামলাতে পারছেনা । তাপরও নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, আমি কোন খারাপ ছেলে না ভাই । আমার পরিবার উচ্চবংশ । এস এস সি পর্যন্ত পড়ালেখার পরেই আমার দৈহিক-মানসিক ত্রুটির কথা সমাজের লোকেরা জেনে যায় । সমাজের ভয়ে আমার পরিবার, আপনজন আমাকে পরিত্যাগ করে । আমাকে সংসার থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেয় । আমি বাঁচার তাগিদে এই ঢাকাতে চলে আসি । কোনভাবে একটা পিয়নের চাকরি যোগার করি । আমি অন্য দশটা হিজড়া থেকে ভিন্নভাবে বাঁচার জন্য প্রতিমুহূর্তে জীবনের সাথে লড়াই করে যাচ্ছি । হয়তোবা অফিসেও একদিন সবাই জেনে যাবে । তারপর আমার স্থান হবে রাস্তায় । লোকে আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করবে, আমাকে কুপ্রস্তাব দিবে কিংবা বাধ্য হয়ে আমাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে ।
রহমত ভাই আমার সামনে আর দাঁড়াতে পারলনা । চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় ।
আমি শুধু তার প্রস্থানের দিকে চেয়ে রইলাম । কোন কিছু ভাবতে পারছিলামনা । প্রকৃতির এতবড় একটা অসংগতি বাস্তবে আমার সামনে উন্মোচিত হওয়ায় আমার সমস্ত অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে গিয়েছিল । রহমতের মত সহস্র মানুষ স্রষ্টার অজানা খেয়ালে ত্রুটিপূর্ণ মনো-দৈহিক কাঠামো নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করার পর পরিবারের স্নেহ-মায়া-মমতা থেকে হচ্ছে বঞ্চিত । সমাজ থেকে হচ্ছে নিগৃহীত । কেউ কি তাদের দুঃখের কথা ভাবে ? আমিও হয়তোবা কিছুদিন পর ভূলে যাব । রহমতের মত কোন সন্তান আমার ঘরে জন্ম নিলে হয়তোবা তাকে আঁতুড় ঘরেই বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব নতুবা অস্বীকার করব । কিন্তু এই মানুষগুলোর কি মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকার নেই ? জীবনের স্বাদরঙ কি তাদের জন্য নিষিদ্ধ ? পিতামাতার স্নেহ থেকে তারা কি সবসময় বঞ্চিত হবে ? তাদের দৈহিক তৃপ্তিটা কি সারাজীবন অপূরণীয় থেকে যাবে ? না- আমি আর ভাবতে পারছিনা । সেই রাত আমার নির্ঘুম কেটেছিল ।
কিন্তু এখনো অনেক রাতে রহমতের মত হাজারটা হাতের স্পর্শে আমার মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যায় । তখন আমার মনে একটা আর্তনাদই প্রতিধ্বনিত হয়- হে সৃষ্টিকর্তা, এ তোমার কেমন সৃষ্টি ? হে মানুষ, তোমরা কি পারনা, রহমতের মত মানুষদেরকে একটু সহানুভূতি দি....।।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×