somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অতঃপর যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের নীতিমালা

২২ শে মে, ২০০৯ রাত ৮:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ কয়েক বছর ধরে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে ঘটে যাচ্ছিল যৌন হয়রানির ঘটনা। শিক্ষার্থীরা, নারীরা প্রতি মুহুর্তে মুখোমুখি হচ্ছিলেন বিব্রতকর অবস্থার। না যাচ্ছিল সহ্য করা, না যাচ্ছিল কোনো প্রতিকার করা। ১৪ মে যৌন হয়রানি রোধে কয়েকটি দিকনির্দেশনা উল্লেখ করে একটি নীতিমালা করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। সংসদে আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত এটি মেনে চলা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে নারী ও শিশুর যৌন হয়রানি প্রতিরোধের দিকনির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে তিনি এ মামলাটি করেন, যা এখন সফলতার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। যৌন হয়রানিবিষয়ক এই নীতিমালার নানা দিক নিয়ে নারীমঞ্চের মুখোমুখি হয়েছেন রিট আবেদনকারী বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী।

প্রশ্ন: মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে এই রিট আবেদন কেন করেছিলেন?
সালমা আলী: দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখে আসছি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীরা বিভিন্নভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নানা সময়ে তাঁরা আমাদের কাছে আসতেন। হয়রানি ও ভোগান্তির অনুভুতি ভাগাভাগি করতেন। শিক্ষার্থী ছাড়াও চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ কর্মক্ষেত্রের নারীরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন। অভিযোগ নিয়ে তাঁরা আমাদের কাছে আসেন, কিন্তু আদালত পর্যন্ত যেতে না চাওয়ায় আমরা বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও কিছুই করতে পারছিলাম না। বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীরা এর প্রতিবাদ করছেন, মুখে কালো কাপড় বেঁধে, মানববন্ধন করে প্রতিবাদ করছেন। তার মানে কেউ আর এখন নীরব নয়। ১৯৯৮ সালে প্রথম যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ৩২৭১/১৯৯৮ মামলাটি করি, কিন্তু অভিযোগকারী ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে না চাওয়ায় এবং প্রত্যক্ষ ভিকটিম না হওয়ার কারণে প্রাথমিক শুনানির পর মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। বর্তমানে সবাই যেহেতু প্রতিবাদমুখর, তাই সমিতির পক্ষ থেকে রিট আবেদন করা হয়েছিল এবং আমরা সফল।

প্রশ্ন: হাইকোর্টের দিকনির্দেশনা উল্লেখ করে নীতিমালার এই রায় সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন?
সালমা আলী: জনস্বার্থে মামলার যে রায়টি আমরা পেলাম, এর ফলে কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি, আধা সরকারি অফিস এবং সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের প্রতিকারের কিছু দিকনির্দেশনা আমরা পেলাম। ফলে সব ক্ষেত্রে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণে এবং নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় এটি মাইলফলক বিবেচিত হবে। অন্যদিকে এ রায় প্রমাণ করে যে যৌন হয়রানি ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকার এবং সংবিধান পরিপন্থী। সুতরাং আমি বলব, হাইকোর্ট যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন।

প্রশ্ন: নতুন আইন হওয়ার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কী হবে?
সালমা আলী: আমরা দেখছি যৌন নিপীড়নবিষয়ক ভারতের ‘বিশাখা বনাম রাজস্থান’ মামলায় এ ধরনের একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় এবং এখন পর্যন্ত ভারতবর্ষ এ দিকনির্দেশনা মেনে চলছে।

আরও উল্লেখ্য, জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি নিয়োগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিজস্ব জেন্ডার পলিসি অনুযায়ী নিয়োজিত ব্যক্তিদের যৌন হয়রানি এবং নিরাপত্তা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে কোড অব কন্ডাক্ট, আদর্শগত মূল্য সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং তা মেনে চলতে বাধ্য করে। আমরা মনে করি, যুগান্তকারী এ রায়ের পর সব প্রতিষ্ঠান এই দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নেবে।

প্রশ্ন: নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্র এখন কীভাবে কাজ করবে?
সালমা আলী: রিটের রায় অনুযায়ী এখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মস্থলে অভিযোগকেন্দ্র থাকবে। এ অভিযোগ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য ন্যুনতম পাঁচ সদস্যের কমিটি থাকবে। কমিটির প্রধান হবেন একজন নারী। এছাড়া কমিটিতে একাধিক নারী সদস্যও থাকবেন। কমিটি কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে পুলিশের কাছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠাবেন। এরপর দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী বিচার বিভাগ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। নির্যাতন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং পুলিশের কাছে অভিযুক্তকে সোপর্দ করার আগে নির্যাতিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনো পরিচয় প্রকাশ করা হবে না। এ ক্ষেত্রে নারীদের সংকোচ, দ্বিধা, ভীতি দুর করতে হবে।
প্রশ্ন: আচ্ছা, যৌন হয়রানি বলতে আমরা কি শুধু শারীরিক নির্যাতনকেই বুঝব? মোদ্দা কথা, যৌন হয়রানির সংজ্ঞাটা কী?

সালমা আলী: না, না, শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়। যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় আদালত বলেন, শারীরিক ও মানসিক যেকোনো ধরনের নির্যাতন যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। ই-মেইল, মুঠোফোন, এসএমএস, পর্নোগ্রাফি, যেকোনো ধরনের চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। শুধু কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই হয়রানির ঘটনা নয়। রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অশালীন উক্তি, কারও দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো−এগুলো যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে।

প্রশ্ন: টেলিফোনে বিড়ম্বনা, খুদে বার্তা এগুলোর কথা যেহেতু এল−একটা জিনিস জানতে চাইব, আজকাল মুঠোফোনে তরুণী কিংবা নারীদের খুব উত্ত্যক্ত করা হয়। এ থেকে কীভাবে নারীরা রেহাই পেতে পারেন?

সালমা আলী: যখনই এ রকম ঘটনা ঘটে, আমি বলব ভুক্তভোগীকে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করতে। মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এ ব্যাপারে তৎপর হয়, তাদের একটি নির্দিষ্ট নীতি থাকে এ সমস্যা প্রতিকারের, তবে আইনের সহায়তায় তারা অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারবে। তখন বন্ধ হবে এ অপরাধ তৎপরতা।
প্রশ্ন: রাস্তাঘাট, যানবাহনে প্রতি মুহুর্তে নারীরা যে বিড়ম্বনার শিকার হন, এর জন্য কি এ নীতিমালা কোনো সহায়তা করতে পারবে?

সালমা আলী: সব ক্ষেত্রেই এ নীতিমালা কার্যকর হবে। এ আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা হবে। তবে আইনের চেয়ে, দিকনির্দেশনার চেয়ে সাধারণ জনগণের সচেতনতা রাস্তাঘাটের যানবাহনের বিড়ম্বনা কমিয়ে দিতে পারে। যানবাহনে যদি পাশের সচেতন যাত্রী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, রাস্তায় যদি সচেতন মানুষ এগিয়ে আসেন, তবে সমস্যা কিছুটা মিটবে। এটি মানুষের নৈতিকতার বিষয়।

প্রশ্ন: শিক্ষাক্ষেত্রে ভালো ফল, কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির জন্য অনেকে অভিযোগ করে নিজের ক্ষতি করতে চান না। আবার এ আইন কার্যকর হলে এর অপপ্রয়োগও তো করতে পারেন কেউ কেউ?

সালমা আলী: এখানে আমি বলব, আইন হবে, এর প্রয়োগও থাকবে। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকতে হবে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, চারিত্রিক নৈতিকতা। কেউ যেন সুযোগসন্ধানী না হয়, আবার আইনের অপব্যবহার না করে, সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি তা আশা করবে।

প্রশ্ন: তাহলে বলা কি যায় যে নারীরা আগের চেয়ে একটু নিরাপদ বোধ করবেন?
সালমা আলী: এটা আশা করা যায়। তরুণী, নারীরা এখন অনেকখানি স্বস্তিতে কাজ করতে পারবেন। চলাচল করতে পারবেন। শেষ পর্যায়ে আমি বলব, আমার সহকর্মী, আইনজীবী ফৌজিয়া করিমসহ সবার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এ রায় আমরা পেয়েছি। এ রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী যত দিন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে এ সম্পর্কিত একটি যথাযথ আইন পাস না হয়, তত দিন পর্যন্ত সব প্রতিষ্ঠান এই দিকনির্দেশনা মেনে চলবে। আর অনুরোধ রইল, গণমাধ্যমগুলো যেন গুরুত্ব প্রদান করে, যাতে এ রায়ের কোনো অপব্যাখ্যা না হয়। প্রত্যাশা করছি, অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে এই দিকনির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।

লেখিকা: জোহরা শিউলী
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×