somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথার বাঁশি-৩৩ (সকল কাঁটা ধন্য করে)

২৪ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ১০:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সে অনেক কাল আগের কথা। এসএসসি'র টেস্ট পরীক্ষা শেষ। চারিদিকে কানাঘুষা চলছে- আমি ফার্স্ট হব। রেজাল্ট দিল। দেখা গেল থার্ড হয়েছি, মাত্র ৮ নম্বরের জন্য। মন প্রচণ্ড খারাপ হল। মাথা নিচু করে ঘুরে বেড়াই, আর নানারকম সান্ত্বনা বাণী শুনি- "টেস্টে পারোনি তাতে কী হয়েছে? আসল পরীক্ষায় দেখিয়ে দেবে!!" যাই হোক, বার্ষিক পুরস্কার বিতরণের দিন সমাগত হল। একে একে সবাই পুরস্কার নিয়ে এলাম। পুরস্কার মানে বই। যার যার পুরস্কারের মোড়ক উন্মোচন করলাম। প্রত্যেককে তিনটা করে বই দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু আমাকেই দেয়া হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের দুটি বই। অন্য দু'জন হুমায়ূন আহমেদের একটি করে বই পেয়ে দারুন মর্মাহত। আমিও সুযোগ বুঝে সান্ত্বনা দিতে শুরু করলাম-"পরেরবার থার্ড হয়ো বাছা, হুমায়ূনের ডাবল বই পাবে!"

তখনও জানি না ঐ বই দুটোয় কী আছে। এমনিতে হুমায়ূন আহমেদের পাড় ভক্ত আমি। উনি যা বলেন, যা লেখেন, নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে অমৃত মেনে হজম করি। বই দুটোর মধ্যে একটা ছিল বেশ মোটা আর একটা বেশ চিকন। বাঙ্গালীর চিরকালের অভ্যাস- কঠিন কাজ আগামী দিনের জন্য জমিয়ে রাখা। আমিও মোটা বইটা সযত্নে লুকিয়ে রাখলাম যাতে কেউ ওটা ছিনতাই করতে না পারে!

চিকন বইটা হাতে নিলাম। "সকল কাঁটা ধন্য করে"- শিরোনামটাই মন কাড়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কে জানত, বইয়ের ভেতরে আরও আরও ভালো লাগা অপেক্ষা করছে! অনেকগুলো ছোট ছোট লেখা'র সমাহার এই বইয়ে। ভূমিকাতে জানা গেল, লেখকের জীবনের অনেক গল্পও ঠাঁই পেয়েছে ওখানে। হুমায়ূনের গল্প বলার ক্ষমতা সম্পর্কে আগেই জানা ছিল। দেরি না করে বইয়ের ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

প্রথম লেখা'র শিরোনাম- "শিকড়"। পুরনো বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে ওঠার সময় গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রীর মানসিক অবস্থা কেমন হয়, তা নিয়েই এই লেখা। মাত্র তিন পৃষ্ঠার লেখা। কিন্তু এত আবেগ তাতে! বারবার পড়লাম-- "যেদিন বাসা বদল হবে সেদিন ছোট বাচ্চা দুটো কাঁদতে লাগল। বাবা হুঙ্কার দিলেন, খবরদার নাকি কান্না না। এর'চে হাজারগুণ ভালো বাসায় তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।" "পরিবারের কর্ত্রী তাঁর মনের কষ্ট পুরোপুরি ঢাকতে পারছেন না। বারবারই তাঁর মনে হচ্ছে, এই বাড়ি ঘিরে কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতি।" এরকম আরও অনেক লাইন আছে লেখাটিতে যা পড়তে গেলে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। আরও আছে শাশ্বত কিছু কথা-"মানুষের সাথে গাছের অনেক মিল আছে। সবচে' বড় মিল হল, গাছের মত মানুষেরও শিকড় আছে। শিকড় উপড়ে ফেললে গাছের মৃত্যু হয়, মানুষেরও এক ধরণের মৃত্যু হয়। মানুষের নিয়তি হচ্ছে তাকে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যুর ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হয় চূড়ান্ত মৃত্যুর দিকে।"


এমনি আরও আবেগঘন লেখা আছে বইটিতে। আছে মৃত্যু নিয়ে বেশ কটি লেখা-"মৃত্যু", "একদিন চলিয়া যাব", "লোভ"; দেশ নিয়ে লেখা-"ধন্য জন্মেছি এই দেশে", "এই দিনতো দিন নয়"।

এভাবে এক এক করে সব গল্পই পড়ে ফেললাম। এর মধ্যে "আমরা কোথায় চলেছি"- এই লেখাটা পড়ে হাউমাউ করে কেঁদেছি। আমাদের দেশের মানুষদের নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে লেখা। কিছু কথা এত ভালো লাগল যে, আমার সব নোট খাতার কভার পেজে লিখে রাখলাম, যাতে কথাগুলো সবার চোখে পড়ে-- "এই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ জন্মায় হৃদয়ে জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে। সেই প্রদীপ যেন সারাজীবন জ্বলতে পারে সেজন্যে বাবা-মা'রা প্রদীপে তেল ঢেলে দেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরাও এই কাজটি করেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকেরা এই দায়িত্ব পালন করেন। দেশের কবি-সাহিত্যিকরাও এই কাজটি পরোক্ষভাবে করেন। তাহলে কি ধরে নেব, প্রদীপে তেল ঢালার কাজটি আমরা করতে পারছি না? প্রদীপ যখন পূর্ণ জ্যোতিতে জ্বলার কথা, তখন তা নিভে যাচ্ছে।"

বইটির সব লেখা পড়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, এই বই পড়া না হলে জীবনবোধ কী, আবেগ কী, দেশপ্রেম কী-- এসব কিছুই জানা হত না। চিকন বই দেখে আগে পড়া শুরু করেছিলাম, কিন্তু এই বইটিই যে আমার মনের বন্ধ জানালাগুলো খুলে দেবে- কে ভেবেছিল? ভাগ্যিস, সেবার পরীক্ষায় থার্ড হয়েছিলাম!!

পুনশ্চঃ হুমায়ূন আহমেদ আজ নেই। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, আমার হৃদয়ের প্রদীপে তেল ঢালার কাজটি তিনি যথাযথভাবেই করতে পেরেছিলেন!
২২টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×