দুনিয়ার মানুষেরা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, দলে দলে, দেশে দেশে এবং জাতিতে জাতিতে নানাবিধ দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতে লিপ্ত। এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূলে রয়েছে সঠিক শিক্ষার অভাব এবং চরমপন্থার লালন।
আমার হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক সাহাবুদ্দিন স্যার একবার একটি গল্প বলেছিলে, যার মধ্যে উক্ত দু'টি বিষয়ের সমন্বয় পাওয়া যায়। গল্পটি হলো- এক ভদ্রলোক পত্রিকায় একটি ধর্ষণের ঘটনা পড়ার সময় তার স্কুল পড়ুয়া মেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, "আব্বু, ধর্ষণ কি?" ভদ্র লোক লজ্জা বশতঃ ধর্ষণের সঠিক অর্থের কাছাকাছিও কোন ধারণা না দিয়ে বলে দিলেন, "ধর্ষণ মানে বকা দেয়া"।
এর কিছুদিন পর মেয়েটি স্কুলে কি একটা দুষ্টুমি করতে গিয়ে দফতরির বকা খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসে বললো, অমুক দফতরি আমাকে ধর্ষণ করেছে। তার ছোট মেয়েটির সাথে এমন অপকর্ম? মেয়েটির পিতা চরম উত্তেজিত হয়ে তার পিস্তল নিয়ে সরাসারি স্কুলে গিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরিকে গুলি করে হত্যা করে তার মেয়েকে ধর্ষণের(?) প্রতিশোধ নিয়ে নেন। অতঃপর সঠিক বিষয়টি জানা জানি হওয়ার পর যা হবার তাই হলো।
আমি আজকের প্রবন্ধে আমাদের মুসলিম সমাজের সেই অংশের কতিপয় এক্সট্রিমিজম নিয়ে আলোকপাত করতে চাই, এই চরম পন্থার বাহকরা যাঁরা নিজেরা দ্বীনদার, দ্বীনের সঠিক সীমারেখার ভিতরে থাকার গর্ব করেন। কিন্তু নামাজের কতিপয় সুন্নাত নিয়ে তাঁদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং মাযহাব না মানার অযুহাতে নিজেরাই নতুন একটি মাযহাব সৃষ্টি করে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাঁদের একটি অংশ এমন আছেন, যাঁরা ইসলামের রাজনীতি (ভোটের মাধ্যমে গণরায় নিয়ে) হারাম মনে করেন এবং তদস্থলে শক্তি প্রয়োগ করে ইসলামী শাসন চাপিয়ে দেয়াকে জায়েয মনে করেন। তাঁদের এই অংশটিই আফগানিস্থানে তালেবানদের উপর সওয়ার হয়েছিলেন এবং হেকমতের অভাব ও অদূরদর্শীতার কারণে শুধু আফগানিস্থানকে তছনছই নয়, সমগ্র মুসলিম জাহানের উপর এক্সট্রিমিজমের কলংক লেপন করে ছেড়েছেন।
সুন্নাত নিয়ে ব্যাপক বাড়াবাড়ি : মুসলমানদের ইবাদত সমূহকে মূলত তিনটি ভাকে ভাগ করা যায়। যথা : ফরজ (ফরজে আইন ও কেফায়া) , ওয়াজিব এবং সুন্নাত (সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ও সুন্নাতে যায়দা )। ইবাদাতের এই তিনটি স্তরের কোনটিকেই খাটো করে দেখার সূযোগ না থাকলেও সুন্নাতকে অবজ্ঞা না করে, ফরজ ওয়াজিব এবং হারাম হালালের সীমারেখা মেনে চললেই একজন ব্যক্তি মুসলিম হিসাবে পরিচিত হতে পারেন। অনেক সময় ফরজ আদায় করতে গিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুন্নাতও আদায় হয়ে যায়। যেমন: এক ব্যক্তি ফরজ গোসলের নিয়ম মেনে যখন গোসল করলেন তখন তার আর নতুন করে অযু করতে হয়না। অযুর সুন্নাত ইত্যাদি গোসলের মাধ্যমে আদায় হয়ে গেল। তারপরও নিষ্ঠাবান মুসলমানেরা ইবাদাতের উক্ত তিনটি স্তরকে মানার চেষ্ট করে থাকেন।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান এবং পর্যবক্ষণে যা দেখেছি, নামাজের সুন্নাত সমূহের সামান্য এদিক সেদিক হওয়াকে কেন্দ্র করে মুসলমান আলেম সমাজ এবং সাধারণ মুসল্লিগণ ব্যাপক দ্বিধা বিভক্ত হয়ে আছেন। শুধু দ্বিধা বিভক্তি নয়, পারস্পরিক গোমরাহ, বেদায়াতী এমনকি কাফের বলতেও বাকী রাখেন না।
মজার বিষয় হচ্ছে- শুধুমাত্র নামাজে যেসব সুন্নাত প্রকাশ হয়ে পড়ে শুধু তা নিয়েই কথা বলা হয়। অথচ একজন মুসলমানের বিস্তির্ণ জীবনে ফরজ ওয়াজিব তরক করা ছাড়াও হারাম হালালের বাছ বিচার না করার মত অগনিত বিষয় অহরহ ঘটে যাচ্ছে, ওসব নিয়ে যেন কোন কথাই নেই। শুধুমাত্র নামাজ শেষে হাত তুলে দোয়া করলাম নাকি হাত না তুলে, নামাজে রা'ফে ইয়াদাইন করলাম কি করলামনা, হাত নাভির উপরে রাখলাম নাকি সিনার উপর, ইমাম সাহেব সূরা ফাতিহা পড়ার পর আমীন চিল্লাইয়া বললাম নাকি মনে মনে বললাম, নামাজের জামায়াতের দুই মুসল্লির পায়ের কনিষ্ট আংগুলি দিয়ে পরস্পর চেপে ধরলাম নাকি আলতো করে রাখলাম, বিতর নামাজে কুনুত হাত তুলে পড়লাম নাকি হাত না তুলে, নামাজের বৈঠকে শাহাদাত আঙ্গুলি অনবরত নাড়তে থাকলাম নাকি শুধু একবার উত্থিত করলাম, ছালাতু তারাবীহ আট রাকয়াত পড়লাম নাকি বিশ রাকআয়ত এই বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক গবেষণা এবং পারস্পরিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে আছে।
উপরোক্ত বিষয় সমূহের উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার আগে আমাদেরকে বুঝতে হবে সুন্নাত কি? সুন্নাত হচ্ছে নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নবুওত প্রাপ্তির পর যেসব কাজ করেছেন, কথা বলেছেন এবং কথা ও কাজের অনুমোদন দিয়েছেন তাকেই সুন্নাত বলা হয়। যেহেতু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শরীয়ত প্রনয়নের এক্তিয়ার প্রাপ্ত হয়েছেন সেহেতু শরীয়তের মৌলিক বিষয় সমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যা তাঁর মাধ্যমে সু্প্রতিষ্ঠিত হয়েই আছে। যেমন : নামাজ, হজ্জ, যাকাত সহ সবগুলো ইবাদাতের মৌলিক নির্দেশ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসার পর নবী (সা এর সুন্নাহর মাধ্যমে আমরা বিস্তারিত অবগত হয়েছি এবং এসবের মধ্যে ব্যাপক কোন হের ফের নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, তারপরও কেন কিছু কিছু বিষয়ে সামান্য মত পার্থক্য রয়ে গেল? যেমন আমরা উপরে নামাজের সুন্নাতে যে কয়টি সামান্য পার্থক্য দেখলাম ঠিক তেমনিভাবে আরো বেশ কিছু বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে দ্বিমত পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি, পবিত্র কুরআনের কিছু কিছু আয়াত এবং সূরা নাজিলের সময়ের ব্যপারে সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীত মূখী বক্তব্য পাওয়া যায়। কোন একটি নির্দিষ্ট সূরা অথবা আয়াতাংশের ব্যপারে কেউ কেউ বলেছেন মক্কী আবার কেউ কেউ বলেছেন মাদানী। এভাবে আরো অনেক বিষয়ে এমনতরো মতভেদ রয়েছে যেমনটি আমরা লক্ষ্য করে এসেছি নামাজে। তাহলে কি উক্ত সাহাবীগণ মিথ্যাবাদী ছিলেন? (নাউযু বিল্লাহ)। তাহলে কেন এমন হলো? এই বিষয়গুলি যদিও ঈমান ও কুফরীর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, তারপরও বিষয়টি আমাদের নিকট পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) সাহাবাগণ রাসূল (সাঃ)কে যখন যেভাবে দেখেছেন ঠিক সেভাবেই উপস্থাপন করতে গিয়েই এমনটি হয়েছে বলা যায়। যেমন যেসব সাহাবী কোন সূরা বা আয়াত রাসূলের (সাঃ) মক্কী জীবনে শুনেছেন তারা এটাকে নিরংকুশ মক্কী বলেছেন। আবার সেই একই সূরা বা আয়াত অন্যকোন সাহাবী যারা নতুন করে রাসূলের (সাঃ) মাদানী যুগে শুনেছেন তারা এসবকে মাদানী হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ঠিক তেমনি ভাবে নামাজ আদায় করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)কে যারা তারাবীহ নামায আট রাকায়াত আদায় করতে দেখেছেন তারা সেভাবে বর্ণনা করেছেন, যারা পরবর্তীতে প্রথম খলিফা কতৃক বিশ রাকআত পড়ার নিয়ম দেখেছেন তারা সেভাবে বর্ণনা করেছেন। যাঁরা দেখেছেন রাসূল (সাঃ) সিনায় হাত বেঁধেছেন তারা সেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন আর যাঁরা নাভির উপরে হাত বাঁধতে দেখেছেন তারা সেভাবে বর্ণনা করেছেন।
যে সামান্য মতভেদগুলো মুসলমানদেরকে কুফরীর দিকে নিয়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, যাতে ফরজ ত্বরক হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, সেই বিষয়গুলো সামনে এনে পারস্পরিক কাদা ছোড়া ছুড়ি, গোমরাহ ইত্যাদি বলে বেড়ানো এবং ওদের নামাজ আদায় হচ্ছেনা আমাদেরটা হচ্ছে ইত্যাদি বলে বেড়ানো মোটেই উচিৎ নয়। সামান্য বিষয় নিয়ে এমন প্রলয় ঘটাতে গিয়ে সাধারণ মুসলমানরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন চরম ভাবে।
আমার মতে বিষয়টি এভাবেই নেয়া উচিৎ যে উপরোক্ত দু'রকম পদ্বতিই সুন্নাত সম্মত। দু'রকম মতের মধ্যে তুলনামূলক অধিক গ্রহণ যোগ্য যেটি মনে হবে শিক্ষিত মুসলমানরা তা গ্রহণ করবেন। সাধারণ মসলমানদের জন্য এত কড়াকড়ি না করে বিষয়টি সাধাণ ভাবে রাখা উচিৎ। আমার পর্যবেক্ষণে দেখেছি আলেম সমাজের চেয়ে সাধারণ মুসল্লিরাই এসব নিয়ে বেশী মাথা ঘামিয়ে তালগোল পাকিয়ে বসেন। আমার পর্যবেক্ষণের স্বপক্ষে কয়েকটি ঘটনা পেশ করছি-
১. যারা তারাবীহ নামাজ আট রাকয়াত আদায় করে মসজিদ থেকে বের হয়ে যান তাদের উদ্দেশ্যে নানা রকম কটাক্ষ এমনকি অশালীন কমেন্ট করতেও শুনেছি তাদের পক্ষ থেকে, যারা বিশ রাকআত পড়ার পক্ষে। আবার আট রাকয়াত যারা পড়েন তারাও বিশ রাকয়াতকে গোমরাহ ইত্যাদি বলে কটুক্তি করে থাকেনে। একটু সুক্ষ ভাবে চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, এ বিষয়টি কটাক্ষ করা মানে হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি সুন্নাতকে কটাক্ষ করা। আচ্ছা ধরে নিলাম তাঁরা আট রাকআয়াত তারাবীহ এর হাদীসটি মানবেন না। ঠিক আছে না মানুন, আপনি বিশ রাকায়াত পড়ুন। আপনার মতে আরেকজন তারাবীহ নামাজ কম পড়লে তিনি হয়ত কম সওয়াব পাবেন, তাতে আপনার এত দুঃখ কেন? আপনি কেন সেই ব্যক্তির উপর বিশ রাকায়াত নামাজ জবরদস্তি চাপিয়ে দিতে চান? এতে আপনার স্বার্থ কি?
২. নামাজের ছফ বা কাতার সোজা রাখা জরুরী। এজন্য পায়ের সাথে পা এবং কাদের সাথে কাধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর নির্দেশ রয়েছে। কিছু লোক আছেন যারা ছফ সোজা করার ধারই ধারেননা আবার কিছু কিছু লোক এমন আছেন যারা পায়ের সাথে পা লাগানোর বিষয়টিকে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এমন বেশ কিছু মুসল্লির পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়ের সুযোগ হয়েছে আমার, যারা তাঁদের পায়ের কনিষ্ট আঙ্গুলি দিয়ে আমার কনিষ্ট আঙ্গুলিতে আনবরত ঘঁষতে থেকেছেন। নামাজ শেষে জিজ্ঞেস করলে বলেন এটি সুন্নাহ। দেখুন সুন্নাত বেশী বুঝার অবস্থা। শেষ পর্যন্ত এধরণের পরিচিত লোকদের পাশে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকতে হয়।
৩. আমার এক প্রবাসী বড় ভাইকে নাসিরুদ্বীন আলাবানি সাহেবের ছহিহ নামাজ শিক্ষা বইটি পড়তে দিয়েছিলাম। আমি নিজেও এই বইটি পড়ে ছহিহ হাদীস থেকে নামাজের বিভিন্ন সুন্নাহ অবগত হয়ে তা মানার চেষ্টা করে থাকি। বইটি পড়ে বড় ভাইটি হজম করতে পারেন নি। তাঁর দৃষ্টিতে যারা নাভির উপর হাত বেঁধে নামাজে দাঁড়ায়, জোরে আমীন বলেনা, নামাজ শেষে হাত তুলে দোয়া করে, কাতার বন্দি অবস্থায় পায়ের সাথে পায়ে চাপ দিয়ে দাঁড়ায়না তাঁদের নামাজ শুদ্ধ হয় না। তিনি দেশে গিয়ে গ্রামে গঞ্জে যেখানেই যাননা কেন তার ফতোয়াবাজী চলাতেই থাকেন। নামাজ শেষ হলে সারসরি দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেবকে লক্ষ্য করে বলে উঠেন, "এখানে একজনের নামজও আদায় হয়নি, আবার পড়তে হবে নামাজ"। এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি হতে থাকলে তিনি ছহিহ নামাজ শিক্ষা বইটি ধরিয়ে দিয়ে বলতে থাকেন এটা পড়ে দেখেন নামাজ হয়েছে কি হয় নি। তাঁর এমন কান্ড দেখে লোকেরা তাঁকে চরম ভাবে ইগনোর করা শুরু করেছেন। শেষ পর্যন্ত মসজিদ ছেড়ে তাঁর মতের ২/৩ জন জোগার করে তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন বাসা এবং অফিসে নামাজ পড়া শুরু করেছেন।
উক্ত বড় ভাইটি নামাজে খাঁটী সুন্নাতের পায়রবি করতে গিয়ে যতটা হয়রান হয়ে পড়েছেন, ফরজ ওয়াজিব এবং হারাম হালালের বাছ বিচারে তার শত ভাগের একভাগ গুরুত্ব দেয়াও জরুরী মনে করেন না। শুনুন বড় ভাইয়ের কাহিনী, যা তাঁর খোদ জবান থেকেই সংগ্রহ করা-
গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তাঁর মেঝ ছেলে সহ আমার অফিসে (প্রবাসে) এসেছেন কোন এক উদ্দেশ্যে। আমার বন্ধুর বড় ভাই হিসাবে তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করি, তিনিও আমাকে ছোট ভাইয়ের মত মনে করেন। আমার পক্ষ থেকে আপ্যায়ন চলার ফাঁকে তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে খোশ গল্পে মেতেছেন। আমাকে জানালেন তাঁর দেশে গিয়ে নামাজ আদায়ের অসুবিধার কথা। তাঁর মতে দেশের একটা মসজিদেও নামাজ শুদ্ধ হয় না। জানালেন কয়টি মসজিদে কয়জন ইমামকে ধরে বসেছেন নামাজ শুদ্ধ করে আদায় না করার কারণে। তিনি আরো জানালেন, শহরেতো কিছু লোককে কোন রকম বোঝানো যায়, গ্রামে গিয়ে একেবারে মহা বিপদে পড়তে হয়, গ্রামের লোকেরা হাসাহাসি করে, দেশের মসজিদ গুলোতে নামাজে দাঁড়িয়ে (তাঁর ভাষায়) কট্ করে পায়ের আঙ্গুলের সাথে আঙ্গুলের চাপ দিতেই লোকেরা লাফ দিয়ে উঠে, সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত শেষে আমি ছাড়া আর কেউ জোরে আমীন বলেনা, একটা লোকও সিনার উপর হাত বাঁধে না, রাফে ইয়াদাইন করেনা, মোয়াজ্জেন ইকামাতের সময় আশহাদুআন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ/ হাইআলাছ্ছালা/ হাই আলাল ফালাহ একবারের স্থলে দুইবার বলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত তাঁর সাথে একমত হয়েছেন, দীর্ঘদিন সৌদি এরাবিয়াতে ছিলেন এমন দুয়েকজন সমমনা পেয়ে গেছেন তাদেরকে নিয়ে বাসায় অথবা অফিসে জামায়াত আদায় করেন, প্রয়োজনে ২/৩ কিলো মিটার দূরে গিয়ে হলেও তাদের সাথে নামাজ আদায় করার ঘটনা জানালেন। উল্লেখ্য, আবুধাবীতে নামাজের কতিপয় সুন্নাতের প্রতি তাঁর এমন চরম পন্থা দেখে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশের আরো কিছু চরমপন্থীর সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং এসব বিষয়ে যথেষ্ট ফুয়েলিং পেতে থাকেন তাদের নিকট থেকে। অতপর কতিপয় সুন্নাতের ভিন্ন মতাবলম্বীদেরকে ভ্রান্ত, গোমরাহ ইত্যাদি আখ্যায়িত করে তাদেরকে মুসলিম ভাবতেও কৃপনতা শুরু করে দিয়েছেন।
তাঁর উক্ত কর্মপন্থার মধ্যে চরম পন্থা থাকলেও নিয়্যাতের শুদ্ধতার কারণে আল্লাহর নিকট যাজায়ে খাইর পেতেও পারেন। আমি এটাকে হিকমাতের খেলাফ চরম এক্সট্রিমিজম মনে করি। বলে রাখা ভাল, বড় ভাই এসব বিষয় আমার সাথে শেয়ার করার প্রধান কারণ হচ্ছে- তিনি আমাকেও তাঁর মতো চরম পন্থি ধরে নিয়েছেন মনে মনে। কারণ তাকে আমিই পড়তে দিয়েছিলাম 'আলবানী সাহেবের ছহীহ নামাজ শিক্ষা বইটি।
এতক্ষণ আমরা শুনলাম বড় ভাইটির কতিপয় সুন্নাত আঁকড়ে ধরার এবং প্রয়োজনে সেসবের জন্য জান কোরবাণ করার মত চরম পন্থার কতিপয় নমুনা। এখন শুনুন ফরজ ওয়াজিব এবং হারাম হালালের সীমারেখা কোনদিকে পালাচ্ছে, তার খবর আছে কি না?
তিনি বড় ছেলেকে বিয়ে করিয়েছন বছর খানেক আগে। এবার বিয়ে দিয়েছেন মেয়ে। গত মাসে মেঝ ছেলেকে আবুধাবী থেকে দেশে ছুটিতে পাঠিয়েছেন তার (ছেলের) ভাবীর বিবাহ বার্ষিকী পালন করার জন্য। ছেলে এবং মেয়ের শ্বশুর পক্ষের বিরাটত্ব, শান শওকত, মন্ত্রী এমপিদের সাথে তাদের সম্পর্ক ইত্যাদির এমন গর্বিত বর্ণনা দিচ্ছিলেন যা শুনে গাধার গায়েও ঘৃণার উদ্রেক হতে পারে। আরো একটি মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, তিনি আমার সাথে ঘন ঘন যোগাযোগ রক্ষা করেন তাঁর ছোট ভাইয়ের (আমার বন্ধু) সাথে যেন আমরা সম্পর্ক ছিন্ন করি সে অনুরোধ বা তার ভাষায় যুক্তি তুলে ধরার জন্য। ছোট ভাইয়ের সাথে তাঁর মনোমালিন্য চলছে। এই মনোমালিন্য এবং হয়ত কোন স্বার্থ হানি হওয়ার কারণে আপন সহোদর ভাইকে মা-বোন তুলে গালাগালি করে থাকেন, যা লেখনিতে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
বড় ভাইটির সমস্ত কথা শোনার পর তাঁর ছেলের সামনে বিস্তারিত ত্রুটি তুলে ধরে অপমানিত করা সঙ্গত মনে হলো না। তাই সংক্ষেপে বললাম, নামাজে সুন্নাতের সামান্য হের ফেরের কারণে মসজিদ ছেড়ে দেয়া এবং তাদের পেছনে নামাজ না পড়ার মত চরম সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। তাছাড়া নতুন একটি হাদীস বা মাসয়ালা পাওয়ার পর তা জবরদস্তি বাস্তবায়নের চেষ্টা না করে কৌশলের সাথে ক্রমান্বয়ে তা প্রয়োগের ব্যবস্থা করা উচিৎ। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহী পাওয়ার সাথে সাথে সকল মানুষকে কলেমা পড়ে মুসলমান হতে বাধ্য করেননি। তিনি কৌশল অবলম্বন করে ক্রমান্বয়ে দাওয়াতী কাজ করতে করতে আরব জাহেলিয়াতের প্রায় সকল মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের পথে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। আমরা তাঁর দাওয়াতী কাজ থেকে শিক্ষা নিলেই হয়।
নাহ! আমার কথায় তেমন কোন কাজ হয়েছে বলে মনে হলো না। কারণ ইতিমধ্যেই চরমপন্থার মহৌষধ সেবন করে বসে আছেন তিনি। বরং আলবানী সাহেবের কিতাব পড়ার পরও আমি এসব বিষয় এত সাধারণভাবে গ্রহন করছি কেন, এটিই তাঁর আফসোসের বিষয় বলে মনে হলো। আমার উল্লেখিত বড় ভাইটি একটি উদাহরণ মাত্র। এমন অসংখ্য মানুষ রয়েছে যারা অনবরত মুসলিম সমাজে ভাঙ্গনের ইন্দন যোগাচ্ছেন।
খুবই সামান্য বিষয়ে মুসলমান সমাজের অসংখ্য চরম পন্থার সামান্য নমুনা এটি। এরূপ সামান্য ছোট খাটো বিষয় নিয়ে আমরা চরম দ্বিধা বিভক্তির মধ্যে রয়েছি। মুসলমানদের মধ্যে এমনতরো বিভক্তি জিইয়ে রাখা মোটেই সঙ্গত নয়। ভাঙ্গন এবং বিভক্তি থেকে সরে এসে দল উপদলের পরিচয়ে পরিচিত না হয়ে আল্লাহর বান্দা এবং রাসূলের (সাঃ) উম্মত হিসেবে নিজেদেরকে পরিচিত করার এখনই সময়। আমরা কেউ হানাফী, কেউ মালেকী, কেউ হাম্বলী, কেউ শাফেঈ, কেউ সালাফি এবং এরো কত কি। তাহলে মুসলিম কোথায়? আসুন, আমরা মাজহাবী পরিচয় ফেলে রেখে সকলেই মুসলিম হিসেবে পরিচিত হই।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৫:৪৮