somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুলখানী-ওরশ : ইবাদাত নাকি অন্য কিছু?

২১ শে জুন, ২০১৩ সকাল ৮:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের চট্টগ্রামের (চট্টগ্রামে ব্যাপক হলেও সারা দেশেই কম-বেশী আছে) একটি সাধারণ সামাজিক রেওয়াজ হচ্ছে - কোন মানুষ মারা যাওয়ার পর তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য কুলখানি বা মেজবানীর আয়োজন করা। লোকটি সাধারণ হয়ে থাকলে তার আত্মার মাগফেরাতের আশায় প্রতি বছরই বড় বা ছোট আকারে তা করা হয়। আর সে মৃত ব্যক্তিটি যদি অসাধারণ(!) পীর, ফকির, বাউল বা সে টাইপের কেউ হয়ে থাকেন তাহলে তার জন্য যে আয়োজন করা হয় সেটির নাম হয় ওরশ, আর উদ্দেশ্য থাকে সেই মৃত ব্যক্তির নিকট থেকে ফয়েজ বা বরকত হাসিল করা। এটি এমন একটি জটিল রেওয়াজে পরিনত হয়েছে যে, যারা মেজবানী দিতে অক্ষম তারাও প্রয়োজনে চাঁদা তুলে এবং অন্যান্য আত্মীয়দের নিটক থেকে ধার-কর্য, এমন কি সাহায্য নিয়ে হলেও এটি করে থাকেন।

মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার পর পাড়া বা মহল্লা কমিটির নেত্রীবৃন্দের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়, মেজবানী বা কুলখানী কখন করা হবে, কি ভাবে করা হবে, কয়টা গরু-মহিষ ক্রয় করা হবে, সমাজের প্রতি ঘর থেকে কয়জন করে দাওয়াত দেয়া হবে, টাকা আছে কিনা এবং না থাকলে কী ভাবে সংগ্রহ করা হবে ইত্যাদি নিয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধীকারীর সাথে বৈঠক করা।

মজার ব্যাপর হচ্ছে, যে মানুষটি হয়ত অসুস্থ হয়ে অর্থাভাবে সু-চিকিৎসা না পেয়ে ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করেছেন তার চিকিৎসার কোন খোঁজ-খবর যারা নেননি তারাও কিন্তু মেজবানী বা কুলখানীর জন্য অর্থদানে দরাজ দিল হয়ে যান। এমন জঘন্য তামাশা দেখার যথেষ্ট দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার।

কুলখানি-ওরশ কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী হলেও কিছু স্ব-ঘোষিত আলেম নিজেদের পেট আর পকেট ভরানোর জন্য কয়েকটি খোড়া যুক্তি; যেমন :- যে সমস্ত গরীব লোক গোস্ত কিনে খেতে পারে না তারা গোস্ত খেয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলে মৃত ব্যক্তির কল্যাণ হবে, কিছু গরীবের অন্তত এক বেলা ফ্রি খাবার জুটবে আর ওরশের খানাকে তাবাররুক নাম দিয়ে তা খেলে পরে রোগ ‍মুক্তি, আশা পূরণ, বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়া থেকে শুরু করে বেহেশ্ত নসিব হওয়া পর্যন্ত অসংখ্য ফজিলতের বর্ণনা দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করে চলেছেন। তাদের আবিস্কৃত এই বিষয়টি গ্রাম মহল্লার মসজিদের স্বল্প শিক্ষিত মুয়াজ্জিন এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার উদ্দেশ্যে নিয়োগকৃত সহকারী মুয়াজ্জিনদের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন।

বিষয়টি আমাদের সমাজে এমনভাবে শিকড় গেড়েছে যে, এটি যেন এখন ফরজের চেয়েও বড় ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি এর বিরোধীতা করেছেন তো ওয়াহাবী তকমা সেঁটে দেয়া হবে আপনার ললাটে আর সন্দেহ পোষণ করা হবে আপনার মুসলমানিত্ব নিয়েও।

পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সম্ভবতঃ ওয়াহাবী টেগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেক সঠিক আকীদার লোককেও ওরস, কুলখানী ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়।

একবার এক আত্মীয়ের কুলখানি অনুষ্ঠানে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছিল আমার চার বছর বয়সী ছোট ছেলেটিকে নিয়ে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে যখনই ফিরতে যাবো , তখন সে বায়না ধরে বসলো বউ না দেখে সে বাসায় যাবে না। ‘এটি কুলখানী অনুষ্টান, এখানে বউ আসে না’- বলে তাকে যতই বুঝানোর চেষ্টা করা হয় সে তত বেশীই কান্নকাটি আর জেদ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আইসক্রীম এবং পছন্দের খেলনা কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোন রকমে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেছিলাম।

বাসায় এসে চিন্তাভাবনা করে বরে করলাম তার ‘কুলখানিতে বেউ’ দেখার আগ্রহের রহস্যটি। অনুষ্ঠানটি ছিল একটি ক্লাবে। ইতোপূর্বে এ ক্লাবটিতে আমাদের সাথে বেশ কয়েকবারই বিয়ে আর গায়ে হলুদ অনুষ্টানে গিয়েছে সে। ওসব অনুষ্ঠানে সু-স্বাধু খাবার ছিল; আজকের অনুষ্ঠানেও আছে, ওসব অনুষ্ঠানে তার মা-আন্টি-আপুদের যে সাজুগুজু ছিল; তা আজকের অনুষ্ঠানেও আছে, তাদের বাহারী পোষাক এবং সর্বাঙ্গ জুড়ে স্বর্ণের প্রদর্শনী আগে যেমন দেখেছে আজকেও তা দেখছে। আগে যেমন তাদেরকে হাসী-খুশী আর হায়-হ্যালো করতে দেখেছে আজকেও তাই দেখছে। শুধু মুখ থুবড়ে অবহেলায় পড়ে আছে বউ বসার আসনটি। সুতরাং ওর সঙ্গত দাবী ছিল; সবইতো আছে, বউ থাকবে না কেন? তার ছোট্ট মস্তিস্ক ধরে নিয়েছে, বউও আসবে হয়ত একটু পরে। তাই বউ দেখার বায়না ছিল তার।

যাদেরকে গোস্ত খাইয়ে মরহুমের জন্য সওয়াব প্রেরণের উদ্দেশ্যে এসব মেজবানী বা কুলখানি, সেই তাদের (গরীব-মিসকীন) কিন্তু এসব অনুষ্ঠানের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, ভুল বশতঃ ফকির মিসকীনদের কেউ প্রবেশ করলে তাদেরকে পিটিয়ে বের করে দেয়ার জন্য লাঠি হাতে পাহারাদার নিযুক্ত করা হয় রীতিমতো। মেজবানী/ কুলখানির পক্ষে খোঁড়া যুক্তি দাতা আলেম নামধারীদের ফতোয়া এখানে চরম মার খেলেও এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সহাসের সাথে কথা বলার মতো যেন কেউই নেই আজ।

আমাদের মহল্লা মসজিদের ইমাম সাহেবেও গরীবকে গোস্ত খাইয়ে মুর্দারের জন্য সওয়াব অর্জনের পক্ষের লোক। গত কয়দিন আগে তার সাথে আলাপ প্রসঙ্গে এসব অনুষ্ঠানে যে গরীব-মিসকীনরা সম্পূর্ণ অবহেলিত তা তুলে ধরে এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, এ বিষয়ে আরেকটু লেখাপড়া করে জুময়ার খুতবায় কিছু বয়ান করবেন।

জুময়ার নামাজের পূর্বে ওয়াজ বা মূল খুতবার বাংলা তরজমায় ‘মেজবানী-কুলখানী’র উপর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের সার সংক্ষেপ হলো-

১. মানুষ মারা যাওয়ার পর মেজবানী করা ফরজ-ওয়াজিব বা সুন্নাত নয়, শুধু মাত্র গরীব মিসকীনদেরকে খানা খাইয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফেরাত কামনা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য।

২. তবে মেজবানী দেবার আগে সেই মৃত ব্যক্তির কোন কর্জ থাকলে প্রথমে তা পরিশোধ করতে হবে, তাঁর রেখে যাওয়া সম্পদ ওয়ারিশদের মধ্যে শরী’য়া অনুযায়ী বন্টন করতে হবে।

৩. বর্তমানে মেজবানী অনুষ্টানে যেভাবে গরীব মিসকীনদেরকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয় তা না করে উক্ত খাবারে গরীব-মিসকীনদেরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৪. এসব শর্ত মানতে পারলে মেজবানী করুন, আর না হয় তা থেকে বিরত থাকুন।

সম্মানীত পাঠক বন্ধুগণ! আমাদের দেশে এমন ছোট-খাটো অনেক রেওয়াজ/অনুষ্ঠান রয়েছে, যেসবের শর’য়ী কোন মূল্য নেই, অথচ বছরকে বছর এসব নিয়েই মাতামাতি এবং দন্ধ-সংঘাত জিইয়ে রয়েছে। ওয়াজ নসিহতের অনুষ্ঠানে হেদায়েতের বদলে এসব টুকি-টাকি নিয়েই সময় পার করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কুলখানী/ওরশের পক্ষের সম্মানিত আলেম স্বীকার করলেন এটি কোন ফরজ-ওয়াজিব-সুন্নাত ইবাদাত নয়, কিন্তু এটা নিয়েই সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে চরম বিভক্তি, যা উপরে উল্লেখ করেছি।

আমাদের সচেতন নাগরীক এবং আলেম সমাজ যদি আরো সচেতন ভূমিকা রাখতেন তাহলে আমরা বিভক্তি কমিয়ে আরো সুন্দর করতে পারতাম আমাদের সমাজ জীবন।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×