
"প্রতিটি গল্প একটি প্রশ্ন নিয়ে জন্ম নেয়।
এই গল্পের প্রশ্ন ছিল—
ভালোবাসা কি নিয়ন্ত্রণ চায়?
না কি নিয়ন্ত্রণ চাইলেই তা আর ভালোবাসা থাকে না?"
'ঈশ্বরের ভুল ছায়া' সিরিজের তৃতীয় পর্বে আমরা হাঁটছি এক নিঃসঙ্গ গবেষকের ছায়ায়, যার হৃদয় আবেগে পূর্ণ, কিন্তু যার স্পর্শে আবহাওয়া বদলে যায়।
সে চেয়েছিল বোঝাতে, শেষে চেয়ে বসে নিয়ন্ত্রণ।
আর প্রকৃতি?
সে কখনো ক্ষমা করে না, সে জবাব দেয়... বাতাসের ভাষায়।
এবার, আপনি শুনবেন?
গল্প শুরু হচ্ছে।"
১. বাতাস ও বুকে জমা বিষণ্ণতা
সকালটা ছিল অস্বাভাবিকভাবে নীরব। পাহাড়ের গায়ে ছায়া-পড়া ঘরটায় বসে রুদ্র তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে—চা-বাগানের অস্পষ্ট সবুজ, কুয়াশার নিচে গুম হয়ে যাওয়া পাতা, আর দূরে জেগে থাকা সিংহ-আকৃতির এক টিলা।
প্রকৃতি এখানে কথা বলে। কেবল কেউ শোনে না।
কিন্তু রুদ্র শোনে।
সিলেট শহরের প্রাণ থেকে খানিক দূরে এই গবেষণা কেন্দ্র। এখানে রুদ্র একা থাকে, কারণ তার গবেষণার বিষয় “মানব আবেগ ও স্থানীয় জলবায়ুর সাময়িক মিথস্ক্রিয়া”। কেউ হাসে শুনে। কেউ ভাবে, পাগলের প্রলাপ। কিন্তু রুদ্র জানে, তার মন কেমন আছে, সেটার উপর প্রকৃতি কেমন আচরণ করছে।
সেদিন সকালে তার বুক ভার হয়ে ছিল। কোনো কারণ ছাড়াই। সে ডায়েরির পাতায় লিখছিল—
"মানুষের আবেগ একধরনের তড়িৎ? যদি প্রকৃতি তা অনুভব করে..."
ঠিক তখন, বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা জানালার কাঁচে পড়ে। তারপর শুরু হয়—নিঃশব্দ অথচ ক্রমাগত।
২. মাধবীর আগমন
মাধবী প্রথম এসেছিল এক পূর্ণিমা রাতে।
চা-বাগানের লাল মাটির পথ ধরে হেঁটে এসে রুদ্রর উঠোনে দাঁড়িয়েছিল সে। পরনে শাড়ি, হাতে একটা কাঁসার থালা—ভাঙা হাঁসি নিয়ে বলেছিল,
“এইটা তোমার জন্য। তুমি এখানে থাকো অথচ এলাকার মানুষকে চেনো না, ওটা ভালো না।”
সে বলেছিল, তার ঠাকুরদা পাহাড়ের উপরে গাছপালা বোঝার কাজ করতেন। সেই সূত্রে প্রকৃতির প্রতি টান। মাধবী এখন চা-বাগানের শিশুদের শেখায় কীভাবে বৃষ্টি আসে, পাতায় গান বাজে।
তাদের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল এক কাপ চায়ের ধোঁয়া থেকে। আর তার পর থেকে মাধবী প্রায়ই আসত। কখনো লেবু পাতা আনত, কখনো পাহাড়ি মধু। কথা হতো। প্রকৃতি নিয়ে। গান নিয়ে।
একদিন হঠাৎ রুদ্র বলেছিল,
“তুমি গেলে, এই পাহাড় নিঃশব্দ হয়ে যায়।”
মাধবী হেসে বলেছিল,
“তুমি যেন হাওয়ার মতো কথা বলো।”
৩. নিয়ন্ত্রণের প্রথম ইঙ্গিত
এক রাতে, ঝড় ছিল।
রুদ্রর মন খুব খারাপ ছিল। আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা সংস্থা তার কাজকে “সায়েন্টিফিক্যালি ইনভ্যালিড” বলে বাতিল করে দিয়েছে।
রাগে, হতাশায়, রুদ্র চিৎকার করে উঠেছিল—
“সব ধ্বংস হয়ে যাক!”
ঠিক তখনই উঠোনের পাশের শুকনো গাছটি ঝড়ের আগে হেলে পড়ে জানালার কাঁচ ভেঙে দেয়।
প্রথমে রুদ্র ভেবেছিল, কাকতাল।
কিন্তু পরে যখন এক ভোরে মাধবী ফোন ধরেনি, রুদ্র মন থেকে ফিসফিস করে বলেছিল, “তুমি কেঁদে ওঠো”—আর সকালবেলা গোটা চা-বাগান কুয়াশায় ঢেকে যায়।
তৃতীয়বার, সে পরীক্ষার মতো করে বাতাসে বলেছিল,
“আলো নিভে যাক।”
আর তার ডেস্কের ল্যাম্প নিভে যায়।
৪. দম্ভ ও দ্বন্দ্ব
“তুমি প্রকৃতিকে ভালোবাসো না রুদ্র, তুমি এখন তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাও। সে কোনো যন্ত্র না। এটা খেলা না।” —মাধবীর কণ্ঠ ছিল শান্ত, কিন্তু কঠিন।
রুদ্র বলেছিল,
“তাহলে কী করবো? এই শক্তি তো আমি চাইনি! এটা কি অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ?”
“জানো রুদ্র,” মাধবী চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “যারা বাতাসকে নির্দেশ দেয়, তারা শেষমেশ নিজের দিক হারিয়ে ফেলে।”
রুদ্র তখন তুঙ্গে। সে এখন বাতাস থামাতে পারে, মেঘ ডেকে আনতে পারে, ঝড় থামিয়ে দিতে পারে।
লোকেরা তাকে ডাকে “প্রকৃতির ঋষি”।
কিন্তু সেই রাতে রুদ্র বিছানায় ঘুমাতে পারেনি। জানালার বাইরে পাহাড় নিঃশব্দ, অথচ হঠাৎ করেই এক ভয়ানক মেঘ নামল।
রুদ্র বলেছিল, “থেমে যাও।”
বাতাস বলল না কিছু। পাতারা শুধু কাঁপতে লাগল। নদী গর্জন করল।
৫. বিচ্যুতি
মাধবী চলে গেল।
একটা ছোট চিরকুট রেখে গেলো: “তুমি ভালো থেকো, রুদ্র। প্রকৃতি কারো সম্পত্তি নয়। যতক্ষণ ভালোবাসা ছিল, ততক্ষণ সে তোমার কথা শুনেছে। এখন সে তোমার শাসনের বিরুদ্ধে।”
রুদ্র একা হয়ে গেল।
চা-বাগান মরতে শুরু করল, পাহাড়ে ভূমিধস নামল। শহরের মানুষ বলল—
“সে অভিশপ্ত। বাতাসের ওপর খেলা করেছে।”
রুদ্রর মুখ শুকিয়ে গেল, কণ্ঠ নিঃশব্দ। প্রকৃতি এখন আর কথা বলে না, সে আঘাত করে।
৬. আত্মত্যাগ
শেষবার রুদ্র দেখেছিল মাধবীকে বনজ কুয়াশার মাঝে—এক নৌকায় বসে সে গাইছিল, যেন বাতাসও তার গানের তালে দুলছে। রুদ্র চিৎকার করে ডাকল, কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
রুদ্র একদিন উঠে গেল পাহাড়ের চূড়ায়।
চোখ বন্ধ করল। এবং বলল,
“ক্ষমা চাই... আমি প্রকৃতিকে ভালোবাসিনি, তাকে বোঝার চেষ্টা করিনি। আমি কেবল শাসন করতে চেয়েছি।”
তারপর সে নিজের সমস্ত শক্তি বাতাসে ছেড়ে দিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে—
পাতারা মর্মর ধ্বনি তোলে, গাছের ডালে ফুল ফোটে, পাখিরা রুদ্রর কাঁধে বসে। নদী কাঁপে একবার। তারপর স্তব্ধতা।
৭. পরিণতি
রুদ্রকে কেউ আর দেখেনি।
তবে নির্দিষ্ট কিছু দিনে, যখন চা-বাগানে হালকা বৃষ্টি পড়ে আর বাতাস হেসে ওঠে—তখন কিছু বৃদ্ধ চা শ্রমিক বলেন,
“ঐ হাওয়ায় এখনো রুদ্রর কণ্ঠ মিশে আছে... সে এখন সত্যিকারের প্রকৃতির আত্মা।”
আর মাধবী?
সে এক পাহাড়ি স্কুলে বাচ্চাদের প্রকৃতি নিয়ে গান শেখায়। তার গানের মাঝখানে, হঠাৎ বাতাস যদি কোমলভাবে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়—তখন সে জানে, রুদ্র এখনো শোনে।
কেবল আর শাসন করে না।
শেষ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২৫ রাত ৮:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




