
বাংলাদেশে মাইক্রোক্রেডিট শব্দটি আজ আর নতুন নয়। এটি দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে। এর প্রধান রূপকার নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস মাইক্রোক্রেডিটকে সাধারণ মানুষের জন্য আর্থিক স্বাধীনতার পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্প্রতি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নতুন ভবন উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, “মাইক্রোক্রেডিটই ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ।” প্রশ্ন হচ্ছে—আসলেই কি এটি ভবিষ্যতের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, নাকি এটি প্রান্তিক মানুষকে আরও একটি বন্ধনে বেঁধে রাখার কৌশল?
প্রফেসর ইউনূসের বক্তব্যে একদিকে যেমন ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার সাফল্য এবং স্বচ্ছতা তুলে ধরা হয়েছে, অন্যদিকে একটি নতুন ব্যাংকিং দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে জোরালো যুক্তি দেওয়া হয়েছে। তার মতে, মাইক্রোক্রেডিট হলো 'বিশ্বাসের ব্যাংকিং'—যেখানে জামানত নয়, বরং পারস্পরিক আস্থা ও আত্মমর্যাদাই ঋণ দেওয়ার ভিত্তি।
তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা কি শুধুই ইতিবাচক?
মাইক্রোক্রেডিট: স্বাধীনতা না ঋণের আবরণ?
১৯৮০ ও ৯০ দশকে যখন গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য এনজিও প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করে, তখন তা একটি আশার আলো ছিল। প্রান্তিক নারীরা গবাদিপশু, হস্তশিল্প বা ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছেন এই ঋণের সাহায্যে। অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমা থেকে উঠে এসেছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মাইক্রোক্রেডিটের ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ একপাক্ষিক নয়।
অভিযোগ আছে, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারীরা এক প্রতিষ্ঠানের ঋণ দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধ করেন। কখনো কখনো তাদের ঋণের চক্র এমনই ঘনীভূত হয় যে তারা মূলধন হারিয়ে ফেলে, বাকি থাকে শুধুই কিস্তির বোঝা। অনেকক্ষেত্রে সুদের হারও একধরনের চাপ সৃষ্টিকারী। যদিও মাইক্রোক্রেডিট ‘উন্নয়নমুখী ঋণ’ হিসেবে চিহ্নিত, তবুও নির্দিষ্ট পরিসরে এটি বাণিজ্যিক চেহারা ধারণ করেছে বলেও অনেকে মনে করেন।
মাইক্রোক্রেডিট: ব্যাংক না এনজিও?
প্রফেসর ইউনূসের বক্তব্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—মাইক্রোক্রেডিটকে এনজিও ভাবনা থেকে বের করে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং কাঠামোয় আনতে হবে। তার ভাষায়, “এনজিও থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে ব্যাংকিং মেজাজ আসবে না।” এই বক্তব্য মূলত মাইক্রোক্রেডিটের ভবিষ্যত কাঠামোর দিক নির্দেশ করে। একটি আলাদা আইন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে, এটি হয়তো একটি খণ্ডিত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ হিসেবেই থেকে যাবে।
তবে এই দৃষ্টিভঙ্গিরও সমালোচনা রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ক্ষুদ্রঋণকে ব্যাংকিং কাঠামোয় নিয়ে গেলে তার সহজলভ্যতা ও মানবিক দিকটি হারিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে দরকার ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা—যাতে প্রতিষ্ঠানও টিকে থাকে, এবং ঋণগ্রহীতার উপর অযথা চাপও না পড়ে।
পথ কোথায়?
মাইক্রোক্রেডিট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু এই ব্যবস্থাকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে কার্যকর করতে হলে তার কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। শুধু ঋণ বিতরণ নয়, বরং ঋণগ্রহীতাদের প্রকৃত অর্থনৈতিক সক্ষমতা গড়ে তোলা, প্রশিক্ষণ দেওয়া, এবং প্রয়োজনমাফিক ঋণপুনর্গঠন প্রক্রিয়া তৈরি করাই হবে টেকসই সমাধান।
সুতরাং, মাইক্রোক্রেডিট আসলেই ভবিষ্যতের ব্যাংকিং হবে কিনা, তা নির্ভর করবে—আমরা কীভাবে এটি পরিচালনা করি তার উপর। এটি যেন ঋণের জালে পরিণত না হয়, বরং অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হয়—এই হোক আমাদের লক্ষ্য।
আপনার মন্তব্য বা অভিজ্ঞতা থাকলে শেয়ার করুন। আলোচনায় সবাইকে স্বাগত।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০২৫ রাত ৯:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




