somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈশ্বরের ভুল ছায়া : ছড়ার পাড়ে প্লাবন

২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৮:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১. হাংগরের প্রভাত

পাহাড়ের বুক ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ছোট্ট হাংগর, বাঁশের কাঠামো আর পাতা-ছাওয়া ছাদে গড়া। এখানেই এচিং মার্মার বসবাস। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার শেষপ্রান্তে, যেখানে রাস্তা শেষ, সেখান থেকেই শুরু হয় তার জীবন।

প্রতিদিন ভোরে সে জাগে পাখির কিচিরমিচিরে, ঘুমচোখে প্রথম যে দৃশ্য দেখে তা হলো বন ঝোপের ফাঁক দিয়ে ছুটে চলা ছড়ার জল।
"ইনুংপাই, উখুইলাং খুই!" — তার দিদিমা সবসময় বলতেন, “জল যদি হাসে, পাহাড়ও কাঁদে।”

২. বন্ধুত্ব ও অতীত

নুথোয়াই তার শৈশববন্ধু। একসাথে মিঠাছড়ার পাড়ে ছোটবেলায় মাছ ধরেছে, দিঘির কচুরিপানায় গা ভাসিয়েছে। এখন তারা বড় হয়েছে—এচিং জুমের কাজে, আর নুথোয়াই বনে কাঠ কাটে।

আর মিংথু মার্মা? গ্রামের নিঃশব্দ মেয়ে। একসময় তার বাবা ছিল গ্রামের পুরোহিত। এক পাহাড়ি ধসের রাতে, তার পরিবার ছিটকে গিয়েছিল ছড়ার জলে। সেই থেকেই মিংথু “দূরদৃষ্টি” পেয়েছে বলে অনেকেই বিশ্বাস করে।

এচিং কখনো তা মানত না—তবে মিংথুর চোখে যে একটা অদ্ভুত নীরবতা আছে, তা অস্বীকারও করতে পারত না।

৩. স্বপ্ন ও সতর্কতা

সেই রাতটা ছিল কুহেলিকা-ঢাকা। মেঘলা আকাশের নিচে এচিং স্বপ্ন দেখে—

ছড়ায় অদ্ভুত ছায়া-জল নেমে আসছে। কালো জল নয়, যেন নিঃশব্দ গর্জনের মতো এক অদৃশ্য শক্তি।

জল ভাসিয়ে নিচ্ছে জুম, ঘর, পাখি, মানুষ... সব। শিশুরা চুপচাপ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

ঘুম ভাঙে। গলা শুকনো। হৃদয় ধড়ফড়।

সে জানালার বাইরে দেখে—ছড়া এখনও শান্ত। কিন্তু কোথাও যেন কিছু বদলেছে।

৪. অবিশ্বাস ও ধীরে আতঙ্ক

পরদিন সে নুথোয়াইকে বলে:
“ভাই, গতরাতে স্বপ্ন দেখলাম—আমাদের ছড়া বদলে গেছে। মনে হলো ঈশ্বর কিছু ভুল করছেন।”

নুথোয়াই হেসে বলে,
“তুইও দিদিমার মতো পাগল হসনি তো?”

এচিং পরের দিন যায় কারবারী বুড়ো লাকপোর কাছে। বুড়ো শুনে চুপ করে থাকে, তারপর বলে—
“মার্মা পুরাণে ‘তাই-চ্রুং’ আছে। ছায়া যখন জলকে পবিত্র করে ফেলতে চায়, তখন ঈশ্বর চোখ ফিরিয়ে নেয়। হয়তো তুই তাই দেখেছিস।”

কেউই ভয় পায় না।

তবে ছড়ার জল এখন ঘোলা, মাছেরা মরতে শুরু করেছে। পাথরজুড়ে জমে কুচকুচে একধরনের শেওলা, যা এ অঞ্চলে কেউ আগে দেখেনি। শিশুরা রাতে দুঃস্বপ্নে চিৎকার করছে।

এক মহিলা হারিয়ে ফেলেছে নিজের নাম, শুধু বারবার বলছে,
“ওলাঃ ওলাঃ ছাং লুই...”— “ছায়া নামছে... ছায়া নামছে...”

৫. মিংথুর দূরদৃষ্টি

এচিং মিংথুকে জিজ্ঞেস করে—
“তুই তো জানিস কিছু। বল, প্লাবন আসছে?”

মিংথু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, চোখ তুলে এচিংয়ের দিকে তাকায়, বলে—
“আমার পরিবার ছড়ায় হারিয়ে গিয়েছিল। আগেও একবার এমন ছায়া এসেছিল, ঠিক যেমন আজকের ঘ্রাণ।”

সে চুপ করে থাকে।

তারপর ধীরে বলে—
“তুই বিশ্বাস করিস বা না করিস, এবারও ঈশ্বর ভুল করতে চলেছেন।”

৬. ভ্রান্তি ও বোধ

এচিং প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়, কিছুই হবে না।

সে ছেলেমেয়েদের পাহাড় থেকে দূরে যেতে মানা করে, স্বপ্নের কথা নিজেই ভুলে যেতে চায়।

কিন্তু সেই রাতে সে দেখে ছড়ার জল বিপরীত দিকে বয়ে যাচ্ছে। আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মিংথুর বাবার ছায়া।

তখনই সে বুঝতে পারে—
যদি ঈশ্বর ভুল করেন, পাহাড় নিজেই ঠিক করবে। কিন্তু সময় থাকতে পাহাড়িদের বাঁচতে হবে।

৭. উপশম ও প্লাবন

সে জুমের বাঁশ দিয়ে এক মাচাং বানায় উঁচু গুহার মধ্যে। ছোট বাচ্চাদের তুলে রাখে সেখানে।

নুথোয়াই তখনও সন্দিহান। তবে যখন তার নিজের বাড়ির দেয়াল ভেঙে ছড়া ঢুকে পড়ে—তখন আর সন্দেহ থাকে না।

সেই রাতেই “ছায়া প্লাবন” নামে।

না, সেটা কেবল জল নয়।

ঘরঘর করে বয়ে আসে ছড়ার গর্জন। গাছগুলো শব্দ না করেই উপড়ে যায়।

মানুষ চিৎকার করে না—তারা শুধু হারিয়ে যায়, যেন কেবল স্মৃতিতে বাঁচবে।

৮. শেষ পাথেয়

এচিং যখন গুহার পাশে দাঁড়িয়ে, তখন সে দেখছে—সবুজ পাহাড় যেন শবের মতো নিঃশব্দে শুয়ে আছে।

এক শিশু জিজ্ঞেস করে—
“এচিং ভাই, ঈশ্বর কি ভুল করতে পারেন?”

এচিং তাকিয়ে থাকে দূরে।

তারপর বলে—
“হয়তো ঈশ্বর ভুল করেন না। আমরা বুঝি ভুলভাবে। কিন্তু পাহাড় জানে ঠিক কিভাবে স্মৃতি টিকিয়ে রাখতে হয়।”

মিংথু এসে দাঁড়ায় তার পাশে।

সে বলে—
“আজ আমরা বাঁচলাম, কারণ আমরা ভয় পেয়েছিলাম ঠিক সময়ে। ভয় কখনও শুধু দুর্বলতা নয়, এ এক ছায়া... যা বাঁচিয়ে রাখে।”


সমাপ্তি
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৮:২০
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×